কায়রোতে আরব নেতারা কি সত্যিই গাজার পক্ষে থাকবেন
Published: 1st, March 2025 GMT
আরব নেতাদের যাচাইয়ের মুহূর্ত এখন আর মাত্র ১০ দিন দূরে। ৪ মার্চেই সেই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন কায়রোয় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২১ ফেব্রুয়ারি রিয়াদে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ‘ফিলিস্তিন সংকট মোকাবিলায় যৌথ প্রচেষ্টা’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ওপরের সংবাদটি এসেছে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে। সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবিও ছিল। ছবিতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পাশে জর্ডান, মিসর, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন ও কুয়েতের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।
এই সাত দেশের মধ্যে মিসর ও জর্ডান বহু আগেই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।
অন্যদিকে সৌদি আরব ও কাতারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখে। তাই এই নেতারা যখন ট্রাম্পের গাজায় জাতিগত নিধনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন, তখন তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। অতীতে এ ধরনের অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ছিল। এই সন্দেহ আজও রয়ে গেছে।
আগামী কায়রো সম্মেলনে স্পষ্ট হবে, আরব নেতারা কি সত্যিই গাজার পক্ষে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন? নাকি আগের মতোই কেবল কথার ফুলঝুরি শোনাবেন।
সাম্প্রতিক দিনগুলোয় অনেক বিশ্লেষক আরব দেশগুলোর অবস্থান খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। মিসর ও জর্ডানের ক্ষেত্রে মূল উদ্বেগ হলো গাজার ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বিতাড়ন। এ আশঙ্কা বাস্তব হলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনিরা এই সম্ভাবনাকে ‘নাকবা-২’ (দ্বিতীয় বিপর্যয়) বলে অভিহিত করছে। ঘোষণা দিয়েছে প্রতিরোধের।
কাতার দীর্ঘদিন ধরে গাজাকে বিশাল অঙ্কের অনুদান দিয়ে সহায়তা করে আসছে। অন্যদিকে সৌদি যুবরাজ নাকি বলেছেন, তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে প্রস্তুত। তবে শর্ত হলো ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের’ জন্য একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা।
আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তারাও ভবিষ্যতে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানকে সমর্থন করার কথা বলেছে। আসলে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত বরাবরই চরমপন্থী আরব গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে সতর্ক ছিল। কারণ, এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পিত ‘জাতিগত নিধন’ বাস্তবায়িত হলে এসব গোষ্ঠী নতুন শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আরও নড়বড়ে হবে।
তবে উপসাগরীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের নাজুক সম্পর্ক কীভাবে সামলাতে হয়, তা ভালোই জানেন। যখন সৌদি আরব ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিল, তখন একই সময়ে সৌদির সার্বভৌম সম্পদ তহবিল যুক্তরাষ্ট্রে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে একটি ‘মিডল ইস্ট রিভিয়েরা’ গড়ে তোলার ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন কুশনার। তাঁর সঙ্গেই ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী স্টিভ উইটকফ।
এই দুই ব্যক্তি ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন। দাবি করেছেন, আসলে তা গাজার ফিলিস্তিনিদের কল্যাণের জন্যই করা হয়েছে। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, যদি ফিলিস্তিনিরা গাজায় থেকে যায়, তবে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হতে পারে। তবে তারা কখনোই ‘জোরপূর্বক বিতাড়ন’ বা ‘জাতিগত নিধন’ শব্দগুলো ব্যবহার করেননি।
ট্রাম্প ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর জাতিগত উৎখাত ধারণা উত্থাপন করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৈনিক দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার। এতে ফিলিস্তিনিদের গাজার ভেতরেই কিছু নিরাপদ অঞ্চলে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে। সেখানে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে নতুন অবকাঠামো ও বসতবাড়ি নির্মাণ শুরু করা হবে।
তবে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বহু আগেই ইসরায়েলের নিজস্ব জাতিগত উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল। যার কারণে ইসরায়েল গাজার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলোকে নিশানা বানিয়েছে পরিকল্পিতভাবে। ইসরায়েলি বাহিনী পানির সরবরাহ ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকেন্দ্রগুলোও ধ্বংস করেছে। আর তা শুধু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা এবং ফিলিস্তিনে জিম্মি নেওয়ার ঘটনাকে প্রতিহত করার জন্য করা হয়নি; তা বরং দীর্ঘমেয়াদি এক পরিকল্পনার অংশ।
কায়রোয় অনুষ্ঠেয় আরব লিগের সম্মেলনে স্পষ্ট হয়ে যাবে, গাজার পুনর্গঠন ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে আরব নেতারা কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরা কি কেবল বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন, নাকি বাস্তব পদক্ষেপ নেবেন—তা তখনই বোঝা যাবে।
এখন, হামাসের ভবিষ্যৎ কী হবে? যদি কোনো চুক্তি হয়, গাজার শাসনভার কে নেবে? হামাস ইঙ্গিত দিয়েছে যে শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নিশ্চিত করতে তারা প্রশাসন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে। তবে তাদের জায়গায় কে আসবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। একই সঙ্গে হামাস জানিয়ে দিয়েছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের বিকল্পটি ধরে রাখবে।
আরব আমিরাতের ইচ্ছা পশ্চিম তীর শাসনকারী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজার শাসনভার নিক। যদিও অন্য আরব দেশগুলো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসন মেনে নেবেন না।
এসব প্রশ্নই প্রমাণ করে, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যেকোনো আলোচনা অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও অনিশ্চিত। আপাতত শুধু এটাই আশা, আগামী ১৫ মাস গাজার জন্য আগের ভয়াবহ ১৫ মাসের মতো হবে না।
আব্বাস নাসির ডনের সাবেক সম্পাদক
ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র আরব ন ত র জন য জ ত গত
এছাড়াও পড়ুন:
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান উপদেষ্টার
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা যখন নতুন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই সময় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর প্রতি আস্থা পুনর্গঠন, আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার এবং যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি এ আহ্বান জানান।
আরো পড়ুন:
পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন বিল্ডিং’ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি: পরিবেশ উপদেষ্টা
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ উপদেষ্টার নির্দেশ
পরিবেশ উপদেষ্টা মঙ্গলবার পাকিস্তানের ইসলামাবাদে এসডিপিআই’র বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইন দি ইমারজিং ওয়ার্ল্ড ডিজঅর্ডার’-এ অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “বায়ুদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, পানি নিরাপত্তা এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের মতো যৌথ সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়াকে এখনই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”
নদী শাসন, ন্যায্য পানি বণ্টন এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সহায়তা জোরদারের ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
উপদেষ্টা বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ঘন-ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহসহ আকস্মিক দুর্যোগের পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা হ্রাস ও কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার মতো ধীর গতির জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশেন একাই তার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের ঘাটতি স্পষ্ট করে। যদি অর্থ না-ও আসে, আমরা অপেক্ষা করে থাকব না।”
সম্মেলনের বিষয়বস্তুকে ‘সময়সাপেক্ষ ও গভীরতাসম্পন্ন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শাসন ব্যবস্থার নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক কাঠামো আজ সংকটে, বহুপাক্ষিকতা দুর্বল হচ্ছে, বৈষম্য, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যবস্থাকে নতুনভাবে গঠন করছে।”
তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কা থেকে নেপাল পর্যন্ত জনগণের বিক্ষোভ প্রমাণ করে বর্তমান শাসন মডেল জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ। তারা যুক্ত, সচেতন এবং প্রভাবিত হওয়ার মতো নয়—তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছে নতুন বিশ্বব্যবস্থা।”
সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী প্রফেসর আহসান ইকবাল, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, জাপানের আইজিইএস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর কাজুহিকো তাকেওচি, পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. ইকবাল হোসেন খান, এসডিপিআই চেয়ারম্যান অ্যাম্বাসাডর শফকত কাকাখেল, এসডিপিআই নির্বাহী পরিচালক ড. আবিদ কাইয়ুম সুলেরি এবং এআইওইউ-এর ড. ইরশাদ আহমদ আরশাদ।
ঢাকা/আসাদ/সাইফ