পান থেকে চুন খসলেই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেন সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ থানার মল্লিকপুর গ্রামের আঁখি দাস। তাঁর স্বামী অতুল দাস কয়েক দিন পরপরই যৌতুকের দাবি করতেন। একদিন শাস্তি হিসেবে আঁখিকে গৃহবন্দি করে ফেলেন। ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেন অতুল। আঁখির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। গৃহবন্দি আঁখিকে রক্ষায় স্থানীয় এক ব্যক্তি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে চালু করা জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে কল দেন। তাৎক্ষণিক সুনামগঞ্জ দক্ষিণ থানা পুলিশে কর্তব্যরত কর্মকর্তা বিষয়টি জানতে পেরে ফোর্স নিয়ে আঁখিকে উদ্ধার করেন। পরে তাঁকে বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
পারিবারিক সহিংসতার শিকার ২০ বছরের সোনিয়াকেও উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ থানা পুলিশ। জেলার রূপগঞ্জের তারাব ইউনিয়নে স্বামী সোহেল ভূঁইয়ার সঙ্গে তিনি থাকতেন। যৌতুকের দাবিতে সোহেল প্রায়ই সোনিয়াকে মারধর করতেন। হেল্পলাইনে কল দিয়ে সবকিছু জানালে স্থানীয় প্রশাসন তাঁকে দ্রুত উদ্ধার করে।
শুধু পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীই নন, বাল্যবিয়ের শিকার কন্যাশিশুও জাতীয় এ হেল্পলাইনে কল করে সেবা পেয়েছে। তাদের মধ্যে মিরসরাইয়ের মেহি (১৬), চাঁদপুরের কচুয়ার বিলকিস (১২), নওগাঁর পত্নীতলার আইরিন (১৫), মানিকগঞ্জের জুঁই (১৩), চট্টগ্রামের নিপা আক্তার (১৬), নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জিরতলী ইউনিয়নের মুনিয়া (১৪), কক্সবাজারের শাহীনুর (১৭), সিলেটের গোরাইনঘাট উপজেলার হাবিবা (১৪), রংপুরের শোভা রানী (১৪), জামালপুরের সাজনী (১৪), মুন্সীগঞ্জের সাদিয়া আক্তার (১৭), নোয়াখালীর ফারহানা আকতার (১৫), পাবনার তিন্নি (১৩) ও ভোলা জেলার চরফ্যাসন উপজেলার ঝুমুরসহ (১৩) অসংখ্য কন্যাশিশু তাদের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে। ১০৯ নম্বরে দিনে দিনে ভুক্তভোগীসহ সেবাগ্রহীতার কলের সংখ্যাও বাড়ছে।
প্রতিদিন এ সেন্টারে গড়ে সাত হাজার কল আসে। কেউ উদ্ধারের সহযোগিতা চেয়ে, কেউ কল দেন তথ্য পেতে। আবার অনেক কিশোরীই বাল্যবিয়ে রোধে সহযোগিতা পেতে কল দেয়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে চালু করা হেল্পলাইন ১০৯-এ আসা ফোনকলের অর্ধেকই হলো পারিবারিক সহিংসতাকেন্দ্রিক। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ হেল্পলাইন পরিচালনা করে থাকে।
জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ১০৯ হেল্পলাইনে ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪২৬ ফোনকল আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কল আসে জুলাইয়ে– ৮২ হাজার ৭১টি। জাতীয় এ হেল্পলাইনের মাধ্যমে ২০২৪ সালে স্বাস্থ্যসেবা পান ৮ হাজার ৩০৮ জন, কাউন্সেলিং করানো হয় ১৪ হাজার ৬৬৫ জনকে, ১৮ হাজার ১১৭ জন পুলিশি সহায়তা পান, আইনি সহায়তা পান ৫৬ হাজার ১৬৯ জন, তথ্যসেবা পান ১৮ লাখ ১৬ হাজার ১৪ জন। ৩২ হাজার ১৫৩ জন অন্যান্য সেবা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ২০২৪ সালে পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত ৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৮টি ফোনকল ছিল। বাকি কলগুলো ছিল শারীরিক হেনস্তা, অপহরণের ঘটনায় সাহায্য চেয়ে কল, যৌন হেনস্তা, বাল্যবিয়ে, অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় সাহায্য চেয়ে কল, মানসিক নির্যাতন, পাচার, এসিডদগ্ধের ঘটনা এবং অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কিত। অর্থাৎ গত বছর সবচেয়ে বেশি কল আসে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের। দিনে গড়ে এ সম্পর্কিত কল এসেছে ১ হাজার ২৬১টি। চলতি বছরের প্রথম মাসেই সহযোগিতা চেয়ে কল আসে ৭৯ হাজার ৭১৭টি। এর মধ্যে তথ্য সহযোগিতা পেয়েছেন ৬৯ হাজার ২৫৬ জন।
জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রোগ্রাম অফিসার ও হেল্পলাইন ইনচার্জ রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘সহযোগিতা চেয়ে পরিবারের সদস্যরা বেশি কল দেন। বেশির ভাগ কল আসে পারিবারিক সহিংসতাকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন চাঞ্চল্যকর কেসগুলো, অর্থাৎ বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের ঘটনা হেল্পলাইন সেন্টার থেকেই তদারকি করা হয়। দৈনিক গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার কল আসে।’ তিনি জানান, জনবলের সংকট রয়েছে। বর্তমানে তিন শিফটে ৪০ জন ২৪ ঘণ্টা কাজ করলে প্রয়োজন ৮০ জনের।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নারীর প্রতি অর্থনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। গত চার বছরের মধ্যে এ সহিংসতা সম্পর্কিত কল বেশি এসেছে ২০২৪ সালে। বছরটিতে ৪ লাখ ৬০ হাজারের বেশি কল আসে। এর আগে ২০২১ সালে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৯১টি, ২০২২ সালে ৩ লাখ ৬ হাজার ৬৬০টি এবং ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৭টি কল আসে।
উই ক্যান অ্যালায়েন্সের জাতীয় সমন্বয়ক জিনাত আরা হক সমকালকে বলেন, পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে, যে ভাবনা নিয়ে পারিবারিক কাঠামোগুলো তৈরি হয়, সেগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে না। ছেলেরা বাইরে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কিংবা ক্লান্ত থাকলে ঘরে এসে বউকে নির্যাতন করে। আবার কোনো কোনো ছেলের বউকে ভালো লাগলেও তাঁর পরিবারের মানুষকে পছন্দ করে না। এসব কারণে সহিংসতা বাড়ছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক মনে করেন, পারিবারিক সহিংসতাসহ নারীর প্রতি সব বৈষম্য প্রতিরোধে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র প র ব র ক সহ সহয গ ত র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিশেষ অনুষ্ঠান
জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ও নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশের কনস্যুলেট জেনারেল কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত এই বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) এই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, যুবসমাজ শুধু আমাদের ভবিষ্যৎই নয়, বাংলাদেশে তারা আমাদের ‘বর্তমান’। এক বছর আগে, তাদের হাত ধরেই সমতা, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের দাবি সার্বজনীন জন-আকাঙ্ক্ষায় রূপ নেয়।
আরো পড়ুন:
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস খোলার সিদ্ধান্ত সরকারের বড় অসতর্কতা: মঞ্জু
গাজাকে নিশ্চিহ্ন করার কোনো ন্যায্যতা থাকতে পারে না: গুতেরেস
তৌহিদ হোসেন আরো বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য- সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।
তিনি তার বক্তব্যে বিগত এক বছরে বর্তমান সরকারের গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাকে বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন বলেন, তারুণ্যের প্রতি আস্থা রাখলে তারা জাতি গঠনের কেন্দ্রে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, যারা এক সময় মিছিলের অগ্রভাগে ছিল, আজ তারা নীতিনির্ধারণে অংশ নিচ্ছে, আর আগামী দিনের দিকনির্দেশনা ঠিক করতে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশে তারুণ্যের নেতৃত্ব জাতিসংঘের যুববিষয়ক নীতি ও কার্যক্রমের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল গণআন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানমালার আলোকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের মিলনায়তনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কিত তথ্যচিত্র এবং পোস্টার, দেয়াললিখন ও আলোকচিত্র প্রভৃতির প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নবযাত্রায় যুব সমাজের অনন্য অবদানকে উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তাবৃন্দসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে এই বিশেষ আয়োজনে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের ইয়ুথ অফিসের প্রতিনিধি ড. সুধা বালাকৃষ্ণণ বক্তব্য রাখেন।
ড. বালাকৃষ্ণণ তার বক্তব্যে বলেন, জাতিসংঘ সমাজ পরিবর্তনে যুবসমাজের সত্যিকারের অংশগ্রহণকে সর্বদাই উৎসাহিত করে থাকে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের অগ্রভাগে থাকা যুবশক্তি তাই অন্যান্য সমাজের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তিন সমস্যার দুই-জাতি-ভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘের একটি উচ্চ-পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণের জন্য পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বর্তমানে নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন।
ঢাকা/হাসান/ফিরোজ