দেশে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে: শিক্ষক নেটওয়ার্ক
Published: 5th, March 2025 GMT
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, হয়রানি, হিংসা–বিদ্বেষসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে চলেছে। নারীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। এমন অবস্থায় প্রতিটি নিপীড়ন ও অন্যায্যতার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার এবং শাস্তি দিতে হবে।
আজ বুধবার এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এ দাবি জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ জন ছাত্রীকে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী কায়দায় বহিষ্কার করা হয়েছে, যেটি নারীর প্রতি কাঠামোগত (সিস্টেমেটিক) নিপীড়নেরই একটি রূপ বলে আমরা মনে করি। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ন্যক্কারজনকভাবে নারীবিদ্বেষী কথা বলেছেন এবং সেটির সঙ্গে ধর্ম ও আইনের ভুলভাল ব্যাখ্যাকে কৌশলে যুক্ত করে দিয়েছেন।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি “বহিষ্কৃত” ছাত্রীদের ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত না করে এবং কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই দুই বছরের যে বহিষ্কারাদেশ দিয়েছিল, সিন্ডিকেট সভার পরেও প্রশাসন তা বহাল রেখেছে। যদিও এবার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এটি স্পষ্ট যে প্রথম দফায় সেই সুযোগ না রেখে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হয়নি, ফলে সেই শাস্তি বহাল রাখারও যৌক্তিকতা নেই।’
এ ঘটনায় সহকারী প্রক্টরদের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত সহকারী প্রক্টররা ছাত্রীদের গালাগাল করে ও “আওয়ামী লীগের দোসর” ট্যাগ দিয়ে তাদের নিরাপত্তাকে যেভাবে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন এবং প্রক্টর প্রতিবাদী ছাত্রীদের বিরুদ্ধে যে যৌন হয়রানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, প্রশাসন সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ছাত্রীরা ফেসবুকে যেসব “স্লাট শেমিং” ও “বুলিংয়ে”র শিকার হয়েছেন, সে ক্ষেত্রেও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রীদের প্রতি প্রক্টরিয়াল বডির বিদ্বেষ ও তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনের উদাসীনতা থেকে এটি স্পষ্ট যে বর্তমান তদন্ত কমিটির পক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব নয়।’
আরও বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে এবং বাইরে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায় ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘একটি নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে হামলা করা হয়েছে। এই হামলার সময় প্রতিবাদী ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়ন করেছে নতুন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। গণ–অভ্যুত্থানের আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে সারা দেশেই স্বৈরাচারী সরকারের আক্রমণে নাজেহাল হয়ে পড়েছিল, তখন রাস্তায় নেমে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের এই অবদান এতটা অনস্বীকার্য হওয়ার পরেও তাদের কাউকেই সেভাবে কোনো স্তরেই মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি নতুন ছাত্রসংগঠনেও না। স্বভাবতই তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষোভকে প্রশমন করতে যেভাবে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ন্যক্কারজনক।’
দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব’ তৈরি করে বিষোদ্গার তৈরির সমালোচনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা বলেছে, ‘দেশে “মব ইনজাস্টিস” তৈরি করে বিষোদ্গারের চর্চা তো বন্ধ হচ্ছেই না, উল্টো তা দিন দিন বাড়ছে এবং এবার এর শিকার বানানো হয়েছে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে। ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপানের তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনর্থক ইস্যু তৈরি করে “ব্যাডাগিরি”র এক ন্যক্কারজনক নজির স্থাপন করেছেন কতিপয় পুরুষ, যাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন এক বয়স্ক ব্যক্তি। একটা পর্যায়ে এই মব ওই ছাত্রীদের ওপর নানাভাবে হেনস্তা করার পাশাপাশি তাদের ওপর মবের চরিত্র অনুযায়ী হামলা করে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন করে।’
ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতির পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এক নারীকে ধর্ষণের খবর প্রকাশের নিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সেই ঘটনাটির কোনো সুরাহা এখনো পর্যন্ত করা হয়নি। উপরন্তু আমরা দেখলাম, ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে কতিপয় মিডিয়ার সাংবাদিক অকল্পনীয়ভাবে ভুক্তভোগীর কাছে গিয়ে ধর্ষণের ঘটনা জানতে চেয়েছেন এবং খুব স্বভাবতই সেই ভুক্তভোগী ধর্ষণের ঘটনাটি নাকচ করে দিয়েছেন। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে সাফাই দিয়ে এমন দুর্ঘটনাকে লঘু করে দেখানোর অপচেষ্টা করেছে। এই সমাজে এমন ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষে ঘটনার আদ্যোপান্ত সামনে আনা কত বড় চ্যালেঞ্জ, তা এ ঘটনাটি থেকে পরিষ্কার। অথচ কতিপয় মিডিয়া অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণভাবে এই ঘটনাকে জনপরিসরে উপস্থাপন করে উল্টো ভুক্তভোগীর জীবনকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।’
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবির সমালোচনা করেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
এমন অবস্থায় ৯ দফা দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তাদের দাবিগুলো হলো—
অবিলম্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ ছাত্রীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার। প্রক্টরের পদত্যাগ এবং পুনরায় একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিন ও সংলগ্ন এলাকায় নতুন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া।
লালমাটিয়ায় মব তৈরি করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করা দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে শাস্তির আওতায় আনা। পাশাপাশি সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য কোনো ‘যদি-কিন্তু’ ছাড়া প্রত্যাহার করা।
বাসে ডাকাতি ও নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলানোর প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী বহিষ্কারের প্রতিবাদে ১৫৪ নাগরিকের বিবৃতি‘অনুগত’ ছাত্রদের সহকারী প্রক্টর বললেন, ‘চাপ দাও, দাবি আদায় করো’ধূমপান করায় হট্টগোল, তরুণীকে উদ্ধার করে থানায় আনল পুলিশরাতে সড়ক অবরোধের পর বৃহস্পতিবার বিক্ষোভের ডাক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরনতুন ছাত্রসংগঠনের আত্মপ্রকাশের সময় কী নিয়ে বিক্ষোভ, মারামারি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ওপর ন ত কর র ঘটন ঘটন ট তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
খাদি কাপড়ের জিআই স্বীকৃতিতে আনন্দে ভাসছেন কুমিল্লাবাসী
কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক খাদি কাপড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দিত জেলার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, অবশেষে পেয়েছেন সেই সুখবর। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বীকৃতির এই সনদ দেওয়া হয়।
কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রামঘাটলা থেকে শুরু করে রাজগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ৩০০ খাদি পোশাকের দোকান। কান্দিরপাড়ের খাদি বসুন্ধরা দোকানের স্বত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, শৈল্পিক ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি এখন দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। ঐতিহ্যের খাদিতে এখন লেগেছে আধুনিকতা ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। শত বছরের বেশি পুরোনো খাদির আরও অনেক আগেই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। অবশেষে স্বীকৃতি মিলেছে, এতেই আনন্দিত সবাই।
একই এলাকার খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, ‘কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ খাদির এমন স্বীকৃতিতে আনন্দিত। শত বছর পার হলেও এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা।’
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদিশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য আওয়াজ ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সে সময় ভারতবর্ষের মানুষ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে খাদি পোশাক ব্যবহার শুরু করেছিলেন। খাদের (গর্তে) চরকায় বসে এ কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ হয় ‘খাদি’। শুরুতে মহাত্মা গান্ধী নিজেও কুমিল্লায় এসে খাদের চরকায় বসে খাদি কাপড় তৈরিতে উৎসাহ দেন।
এই গবেষক আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নিলে কুমিল্লার খাদিশিল্প সংকটে পড়ে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাল ধরেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লার খাদি ও বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের জিআই স্বীকৃতির জন্য তখন থেকেই কাজ শুরু হয়। কুমিল্লার ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত তিনটি পণ্যের মধ্যে দুটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। যে একটি বাকি আছে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি পাবে বলে তিনি আশাবাদী।