পাতাল ফুঁড়ে লবণ চাষ, বিপর্যস্ত কুতুবদিয়া
Published: 6th, March 2025 GMT
খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার ছাড়াও লবণ মানবদেহের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান; যার নির্দিষ্ট মাত্রায় হেরফের হলে মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃদ্যন্ত্রের মতো অঙ্গ বিকলসহ জীবনসংশয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই এই খনিজ বস্তুটি সস্তা হলেও এর ব্যবহারে থাকতে হয় অতি সতর্ক। অথচ নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনের প্রায় নাকের ডগায় এই অতি জরুরি ও অতি বিপজ্জনক খনিজ পণ্যটির অপব্যবহার ঘটে চলেছে। ফলে মাটির ওপর ও নিচের প্রাণপ্রকৃতির সর্বনাশ হচ্ছে; পাশাপাশি লাখো মানুষের জীবন বিষিয়ে ওঠার উপক্রম হয়েছে।
এক মৌসুমে কুতুবদিয়ায় ৩ লাখ টন লবণ উৎপাদন করে যে লাভ হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কৃষি, স্বাস্থ্যসহ নানা পেশার লাখো মানুষের ক্ষতি হচ্ছে দশ গুণ বেশিফজলুল কাদের চৌধুরী, সভাপতি, ধরা, কক্সবাজারপ্রথম আলোর দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে এমনই এক ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা গেছে কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলায়। প্রায় সাত বছর হলো এখানে ধুম পড়ে গেছে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে লবণ উৎপাদনের। অথচ মাটির বাঁধ দিয়ে ঘেরা কুতুবদিয়ার চারদিকেই লোনাপানির অথই সাগর। সেখানে কেন মাটির গভীর থেকে পানি তুলে লবণ তৈরি করতে হবে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় এমন এক কাহিনি, যার পরতে পরতে ওত পেতে আছে অশনিসংকেত।
রোদে শুকিয়ে লবণ চাষ হয়ে আসছে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোয়। কিন্তু কুতুবদিয়ায় গভীর নলকূপের পানি দিয়ে লবণ উৎপাদনের পদ্ধতি কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা উদ্ভাবনের মাধ্যমে হয়নি। এর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায় এক মজার ঘটনা।
২০১৭ সালেও সাগর চ্যানেল থেকে সৃষ্ট খালের পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করতেন কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদারপাড়ার দরবারঘাটের সাদেকুল ইসলাম। সরকারের কাছ থেকে এসব খাল ইজারা নিয়ে লবণচাষিদের লোনাপানি সরবরাহ করতেন এলাকার কিছু মানুষ। নওশাদ নামে এ রকমই একজনের কাছ থেকে লোনাপানি কিনে লবণ চাষ করে আসছিলেন সাদেকুল ইসলাম। প্রতি কানি (৪০ শতক) জমিতে লোনাপানি নিতে তাঁকে দিতে হতো ৪ হাজার টাকা হিসাবে ৮ কানিতে ৩২ হাজার টাকা।
জমি সমতল করে তার ওপর বিছানো হয় পলিথিন। ভূগর্ভস্থ পানি রাখা হয় পলিথিনের ওপর। পানি শুকিয়ে হয় লবণ। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার লেমশীখালী ইউনিয়নের দরবারঘাট এলাকায়.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।