আমাদের শাসকশ্রেণি যে জনগণের মিত্র নয়, সাধারণ মানুষ তা জানে, মর্মে মর্মে অনুভব করে; কিন্তু কিছু করতে পারে না। তাদের এই দুঃসহ বোঝা ও যন্ত্রণা দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।
সহ্য করা সম্পর্কে সেদিন এক সহকর্মী একটি চমৎকার তুলনা দিচ্ছিলেন। একটি ব্যাঙ যদি পানির পাত্রে থাকে, তাহলে সে মনে করবে ভালোই আছে। পাত্রটিকে যদি নিচ থেকে তপ্ত করা হয় তাহলে গরম পানি ব্যাঙটির জন্য প্রথমে যে অসহ্য মনে হবে তা নয়। ক্রমেই সে দেখবে যে পানির তাপ যত বাড়ছে ততই তার মরণদশা হচ্ছে। কিন্তু সে যে লাফ দিয়ে পাত্রের বাইরে গিয়ে পড়বে সে শক্তিও তার নেই, ততক্ষণে সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত ওই পাত্রেই তার মৃত্যু ঘটবে। ব্যাঙটা যদি হঠাৎ করে কোনো কারণে বাইরে থেকে তপ্ত পানিতে পড়ত তাহলে সে কিন্তু সেখানে থাকত না, সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে বাইরে এসে নিজের প্রাণ বাঁচাতো। তুলনার তাৎপর্যটি সহজ। পানি তপ্ত হচ্ছে, আমরা শক্তি হারাচ্ছি, অগ্রসর হচ্ছি মৃত্যুর দিকে।

তবে মানুষ আর যা-ই হোক ব্যাঙ হতে রাজি হবে না। প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা সে অবশ্যই করবে। প্রাণপণেই করবে। ভরসা সেটাই। অতীতে করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।
জনগণের জন্য দুর্বলতার মূল জায়গাটা হলো এই যে, তারা বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত; তাদের কোনো শক্ত রাজনৈতিক দল নেই। বলা বাহুল্য, এ দল হবে সে দল, যারা সরকার পরিবর্তনকেই একমাত্র কর্তব্য মনে করবে না; যারা গোটা ব্যবস্থাটাকেই বদলাতে চাইবে। কাজটা ডানপন্থিরা করবে না, বামপন্থিদেরই করতে হবে; জাতীয়তাবাদীরা করবে না, করবে যারা প্রকৃতই গণতন্ত্রকামী তারা। জনগণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, বিদ্রোহ করেছে, ভোট দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, সাময়িকভাবে তারা জয়ী হয়েছে বলেও মনে হয়েছে। কিন্তু তাদের অগ্রগতিকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, আন্দোলনে ধারাবাহিকতা থাকেনি। প্রধান কারণ রাজনৈতিক সংগঠনের অভাব।

উদারনীতিকরা এবং বামপন্থি মহলেও কেউ কেউ যে আশা করেন শাসকশ্রেণির একাংশের সাহায্য পাওয়া যাবে অপরাংশের বিরুদ্ধে, তারা অকারণে আশাবাদী এবং তারা জনগণের প্রকৃত বন্ধুও নন, কেননা সংগ্রামটা তো আসলে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধেই; তারাই তো বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তারা কেন আগ্রহী হবে সমাজ পরিবর্তনে।
রাজনীতিকেরা নির্বাচনকে খুবই গুরুত্ব দেয়; সেটাও তাদের জন্য সংগত কাজ বটে, নির্বাচনই হচ্ছে তাদের জন্য ক্ষমতায় ওঠার ও থাকার বৈধ উপায়। নির্বাচন সরকার বদলাতে পারে ঠিকই, সব সময়ে যে পারে তাও নয়, কিন্তু নির্বাচন সমাজ বদলাবে এ কথা কে কবে শুনেছে? আমাদের দেশেও তেমনটি ঘটেনি।

মানুষের ভেতর হতাশা দেখা দিয়েছে, কেননা সমাজ পরিবর্তনের পক্ষের শক্তি দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। বামপন্থিরা অতীতে নানা রকম ভুল করেছে, এখনও তাদের একাংশ ভাবছে শাসকশ্রেণির সঙ্গে থেকেই মানুষকে মুক্ত করতে পারবে। এতে ফল যা হবে তা হলো, ওই বামপন্থিরা জনগণের আস্থা এবং নিজেদের শক্তি দু’টোই হারিয়ে হয় একেবারেই বিলীন নয়তো অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে। জনগণের পক্ষে তাদের কাছ থেকে আশা করবার তেমন কিছু থাকবে না।

এরই মধ্যে আবার রয়েছে মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উৎপাত। কেউ কি অস্বীকার করবেন যে, মৌলবাদ ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে না? মৌলবাদীরা জঙ্গি আকার ধারণ করছে, মোটেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু মৌলবাদীদের যে এমন বাড়বাড়ন্ত তার কারণ কী, রহস্যটা কোথায় সেটা দেখতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, মৌলবাদ তথা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ চাঙ্গা হচ্ছে শাসকশ্রেণির কার্যকর আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে। সত্য কেবল এটা নয় যে, শাসকশ্রেণি এদের ব্যবহার করে, নিজেদের স্ফীত করার লক্ষ্যে। সত্য এটাও যে, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের যে সামাজিক ভূমি সেটা তৈরি এবং তাতে বারিসিঞ্চনের কাজটিও শাসকশ্রেণিই করে, কখনও কখনও হয়তোবা করে থাকে ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই। ওই দুই কর্ম তারা সম্পন্ন করে দুই পন্থায়– এক.

বৈষম্য বৃদ্ধি; দুই. দারিদ্র্য সৃষ্টি। বৈষম্য ও দারিদ্র্য আবার পরস্পর নির্ভরশীল, বৈষম্য যত বাড়ে সমষ্টিগত দারিদ্র্যও তত বাড়ে এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধিও বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হয় বৈকি।
শাসকদের শোষণ প্রক্রিয়া দারিদ্র্য বৃদ্ধি করে। এবং স্বাভাবিক নিয়ম এটা যে, যত দারিদ্র্য বাড়বে তত বাড়বে মানুষের অসহায়তা। মানুষ যত অসহায় হবে ততই দেখবে যে তার কোনো আশ্রয় নেই, তাকে যেতে হবে ধর্মের কাছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির সঙ্গে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ বৃদ্ধির এই অন্তরঙ্গ যোগসূত্রটি অনেকে বুঝতে চান না, এবং না বুঝে ভাবেন যে কেবল বিরক্তি প্রকাশের দ্বারাই বাস্তবতাকে তারা পাল্টে দিতে পারবেন। সেটা হওয়ার নয়, সেটা হচ্ছে না।

ওদিকে শাসকশ্রেণির মানুষদের নিজেদের মধ্যেও প্রবণতা আছে ধর্মের কাছে আশ্রয় খোঁজার। তাদের জীবনে যে শূন্যতা রয়েছে, রয়েছে স্থূল বস্তুতান্ত্রিকতা, কারও কারও মধ্যে রয়েছে অপকর্মের স্মৃতি, তা তাদের ‘আধ্যাত্মিক’ করে তোলে। তদুপরি রয়েছে আত্মপরিচয়ের সংকটও। এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেও যে এরা বিনোদন লাভের উপায় করে তোলে, এমন অভিযোগও মিথ্যা নয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দিয়ে, মাদ্রাসা খুলে, প্রতিযোগিতামূলক ও আন্তরিকতাহীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এদের অনেকেই সন্তুষ্টচিত্তে মনে করে যে পরকালের জন্য পুঁজি সঞ্চয় করছে; ইহকালের সুখটাকে পরকালেও প্রলম্বিত করবে বলে তারা ভরসা রাখে। 

যেটা প্রয়োজন তা হলো, মুক্তির সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই সংগ্রাম একাত্তরে শুরুও হয়নি, শেষও হয়নি। একাত্তরের আন্দোলন একটি চরম রূপ ধারণ করেছিল মাত্র, সংগ্রামটা এখনও আছে, স্তিমিত আকারে হলেও। তাকে বেগবান ও গভীর করা প্রয়োজন; করতে হবে শাসকশ্রেণির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, তার বিরুদ্ধে এবং সমাজে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনবার লক্ষ্যে। সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল সম্ভব হবে দেশবাসীকে স্বাধীন করা; তখন সমাজে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে, সর্বস্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী উৎপাত এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন দুটোই প্রতিহত হবে। স্বাধীনতা আত্মসাতের ভয় একেবারে উধাও না হলেও অনেকটা কমে যাবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ব মপন থ জনগণ র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্প কানাডাকে ‘ভেঙে ফেলতে’ চেয়েছিলেন

সাধারণ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পরে সোমবার রাতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি তার ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুলোধুনো করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডাকে ‘ভেঙে ফেলতে’ চেয়েছিলেন।

লিবারেলদের এই বিজয় এক অলৌকিক রাজনৈতিক পুনরুত্থান এবং কার্নির জন্য একটি যুগান্তকারী বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কারণ কার্নির পূর্বসুরি জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের ওপর সমর্থন তুলে নিয়েছিল জগমিত সিংয়ের নেতৃত্বাধীন মধ্য-বামপন্থি নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি। এর পর গত বছরের ডিসেম্বরে হঠাৎ করে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে লিবারেল পার্টির ২১ এমপি ট্রুডোকে পদত্যাগ করতে প্রকাশ্যে আহ্বান জানান। জনগণের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ট্রুডো। পরে ঘোষণা আসে আগাম নির্বাচনের। 

ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর কানাডার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। কানাডার সার্বভৌমত্ব নিয়েও হুমকি দিতে ছাড়েননি তিনি। দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প। 

কার্নি তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেন,  ট্রাম্প “আমাদের ভেঙে ফেলতে চান, যাতে আমেরিকা আমাদের মালিক হয়। তবে এটা কখনও হবে না।”

তিনি বলেন, “আমেরিকান বিশ্বাসঘাতকতার ধাক্কা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু আমরা কখনই শিক্ষা ভুলব না।”

নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যদিও আমরা সরকারকে জবাবদিহি করার এবং আরও ভালো বিকল্প প্রস্তাব করার আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করব, তবুও আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক এবং অন্যান্য দায়িত্বজ্ঞানহীন হুমকি উপেক্ষা করার সময় কানাডাকে সবসময় প্রথমে রাখব।”

দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “রক্ষণশীলরা বিতর্কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং আমরা সারা দেশে আমাদের জনগণের জীবন উন্নত করার জন্য সর্বোত্তম যুক্তিগুলো তুলে ধরতে থাকব।”

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সাথে পুলিশের মতবিনিময়
  • শততম ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখতে চান ইয়ামাল
  • ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সিপিবি নেতার সৌজন্য সাক্ষাৎ
  • রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত স্থগিতের দাবি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের
  • ট্রাম্প কানাডাকে ‘ভেঙে ফেলতে’ চেয়েছিলেন
  • নির্মাতার ঘোষণার অপেক্ষায় চিত্রাঙ্গদা
  • শিশুর মাথা ঘামে কেন
  • কাঠফাটা রোদ্দুরে তপ্ত হাওয়া
  • গান নিয়েই আমার সব ভাবনা