দেশে চলমান অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীর। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা মাঝেমধ্যেই প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা আগে ঘোষণা দিয়ে গত শুক্রবার প্রথমবারের মতো বিশাল জমায়েতের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা দেখায়। এখনই শক্ত হাতে মোকাবিলা না করা হলে এ ধরনের গোষ্ঠীর আস্ফালন ভবিষ্যতে আরও দৃশ্যমান হবে। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

শুক্রবার জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে থেকে ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি শুরু করে হিযবুত তাহ্‌রীর। প্রথমদিকে পুলিশের দুর্বল বাধা অতিক্রম করে তারা পল্টন মোড় হয়ে বিজয়নগরের দিকে এগিয়ে যায়। এর পর পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে এবং লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের প্রস্তুতি ও প্রতিরোধের ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন।

অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো.

সাজ্জাত আলী গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, বায়তুল মোকাররম মসজিদের গেটেই হিযবুত তাহ্‌রীরের মিছিল প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। তবে মুসল্লিদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় তা করা হয়নি। উত্তর গেটে প্রচুর মুসল্লি ছিল, তখন কাঁদানে গ্যাস বা কোনোভাবে তাদের প্রতিরোধ করতে চাইলে মুসল্লিদের নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইসলামের নামে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সংগঠনে যুক্ত করে হিযবুত তাহ্‌রীর। 

ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয় কথিত জিহাদে। বিগত সরকারের সময় নিষিদ্ধ অবস্থাতেই হিযবুত গোপনে কার্যক্রম ও বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে খিলাফতের দাবি সংবলিত ব্যানার লিফলেট নিয়ে সভা করে তারা। একই দিনে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনেও সভা করে। আগস্টে বন্যার সময় ‘ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদ’ শীর্ষক ব্যানারে ঢাকায় বড় বিক্ষোভ মিছিল করে সংগঠনটি। ৯ সেপ্টেম্বর তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আবেদন করে তারা। এসব কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হওয়ায় তারা আরও সাহসী হয়ে শুক্রবারের কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।

পুলিশ সদরদপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর সমকালকে বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। শুক্রবার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের কোনো গাফিলতি বা শৈথিল্য ছিল না। এর আগে তারা কোনো কোনো সময় হঠাৎ করেই কর্মসূচি পালন করায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

উগ্রবাদ নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কয়েক কর্মকর্তা জানান, শুক্রবারের মিছিলে হিযবুতের বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন। এত মানুষকে শুধু আইন প্রয়োগ করে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ জন্য তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উগ্রবাদের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।  

আরও শক্ত পদক্ষেপের আহ্বান
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশে যে অস্থিরতা চলছে, তা থেকে এখনও আমরা বের হতে পারিনি। এর ফলে কিছু মানুষ সংগঠিত হয়ে যে কোনো বাড়িতে লুট করতে পারে, মব জাস্টিসের নামে পিটিয়ে মারতে পারে, মামলায় যে কাউকে আসামি করতে পারে, সেটা নিয়ে বাণিজ্যও করতে পারে। হিযবুত তাহ্‌রীরের এত বড় কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিষ্কার। নানা গোষ্ঠী এটার সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। নিষিদ্ধ সংগঠন বা নতুন নতুন নামে কেউ হাঙ্গামা বাধানোর পাঁয়তারা করতেই পারে। অনেক পক্ষেরই মদত থাকতে পারে, যারা একটা অস্থিরতা তৈরি করতে চাচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আরও শক্ত পদক্ষেপ আশা করছি।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি– এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। সেনাবাহিনী বা অন্য বাহিনী তো সহায়তাকারী ফোর্স। পুলিশ যদি কর্মক্ষম না হয়ে ওঠে, ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, অন্যরা তো আর বেশি পুলিশিং করতে পারবে না। মব জাস্টিসের নামে যা হচ্ছে, এটা যদি সরকার দৃশ্যত কঠোর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারে, তাহলে কোনো ইস্যুতেই সফলতা দেখানোর সম্ভাবনা কম। 

হিযবুত তাহ্‌রীরের ৩৬ সদস্য গ্রেপ্তার
গত শুক্রবার থেকে হিযবুত তাহ্‌রীরের অন্তত ৩৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার অন্যতম সংগঠক সাইফুল ইসলামও রয়েছেন। গতকাল এ তথ্য জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, আমরা সমাবেশের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। হিযবুত তাহ্‌রীরের অনেক সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সংগঠনটির সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে পুলিশ।

পল্টন থানার মামলায় রিমান্ডে ১৭ 
পল্টন এলাকায় হিযবুত তাহ্‌রীরের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতের ঘটনায় ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ২ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার মোহাম্মদপুর, আদাবর ও উত্তরখান থেকে হিযবুত তাহ্‌রীরের আরও চার সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

হিযবুত তাহ্‌রীরের মিছিল থেকে গ্রেপ্তার ১৭ জনকে গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর আগে আসামিদের কাঠগড়ায় নেওয়ার সময় আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ ও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ স গঠন গ র প ত র কর শ ক রব র সদস য সরক র আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে একের পর এক অঘোষিত ভাগাড়, বর্জ্য ফেলে পরিবেশদূষণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাড়াতলী এলাকা। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার এই এলাকায় গেলে দূর থেকেই নাকে ভেসে আসে উৎকট দুর্গন্ধ। মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনের পাশে চোখে পড়ে সারি সারি ময়লার স্তূপ। মহাসড়কের পাশ যেন হয়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে।

শুধু হাড়াতলী এলাকাই নয়; ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের বেশ কয়েকটি স্থানে এমন অঘোষিত ভাগাড় গড়ে উঠেছে। মহাসড়কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে কুমিল্লা জেলার অংশ। এর মধ্যে অন্তত ২০টি স্থানে একইভাবে ময়লা ফেলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান মহাসড়কের পাশে তাদের সংগ্রহ করা ময়লা ফেলছে। এতে মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে আবর্জনার স্তূপ দিন দিন বাড়তে, মহাসড়ক পরিণত হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে। এভাবে পরিবেশদূষণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে করতে না পারে, তাহলে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের কাজটা কী? মানুষ তো ট্যাক্স দেয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য। এভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেলা একধরনের অপরাধও। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে এসব বিষয়ে কঠোর হওয়া দরকার।

হাড়াতলী এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, প্রায় দুই বছর আগে স্থানটিতে ময়লা ফেলা শুরু করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। এরপর সেটি ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভাগাড়ে। দিন যত গেছে, ময়লা ফেলার জায়গাটির আকার ততই দীর্ঘ হয়েছে। এ কারণে ওই স্থান দিয়ে হেঁটে চলাচল করা বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন আশপাশের বসবাসকারীরা। ভাগাড়ের আশপাশে অন্তত তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও ময়লার দুর্গন্ধে নাকাল।

এভাবে পরিবেশদূষণ বন্ধে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করছি। তবে এ বিষয়ে মূল দায়িত্বটা পালন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে।মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব, উপপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়লা ফেলতে আমরা বারবার বাধা দিয়েছি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। সিটি করপোরেশন সবুজে ঘেরা এলাকাটির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখনো প্রতিদিন ময়লা বাড়ছে। সিটি করপোরেশন বলে, তারা নাকি এখন ময়লা ফেলে না। তাহলে আমাদের প্রশ্ন, ময়লা কারা ফেলছে?’

স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রেণিকক্ষে বসা যায় না দুর্গন্ধের জন্য। একটু বাতাসেই নাকে ভেসে আসে ময়লার দুর্গন্ধ। কলেজে প্রবেশের সময় নাক চেপে ধরে আসতে হয়। এ ছাড়া পরিবেশও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাড়াতলীতে তিন মাস ধরে তাঁরা আবর্জনা ফেলছেন না। সিটি করপোরেশনের ফেলা ময়লাগুলো ভেকু দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এখন রাতের আঁধারে আশপাশের লোকজন এবং বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মহাসড়কের পাশে ময়লা ফেলছে। যারা ময়লা ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার প্রবেশমুখ বালুজুড়ি এলাকায় ময়লার ভাগাড়

সম্পর্কিত নিবন্ধ