সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতিসাধনের সঙ্গে জড়িত যে কাউকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার অঙ্গীকার করেছেন।

সিরিয়ায় কয়েক দিনের সংঘর্ষে ব্যাপক প্রাণহানির পর গতকাল রোববার এমন অঙ্গীকার করেন শারা। অভিযোগ আছে, গত কয়েক দিনে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সংখ্যালঘু আলাউইত সম্প্রদায়ের শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এটি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের সম্প্রদায়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, গত শুক্রবার ও শনিবার পশ্চিম উপকূলে আলাউইত সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে চালানো ‘নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে’ ৮৩০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর এই সহিংসতার ঘটনাকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে সহিংসতায় প্রাণহানির সংখ্যা ঠিক কত, তা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।

গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাত করে শারার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। পরে শারা সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।

গতকাল সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বক্তব্যে শারা দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে ধরারও অঙ্গীকার করেন।

সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাব অনুসারে, গত কয়েক দিনের সংঘর্ষে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর ২৩১ জন সদস্য এবং ২৫০ জন আসাদপন্থী যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষের ঘটনায় মোট প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজার ৩১১।

আরও পড়ুনসিরিয়ায় ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা, মরদেহ পড়ে আছে খোলা মাঠে১১ ঘণ্টা আগে

গতকাল শারা বলেন, আজ তাঁরা যখন এই সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, তখন তাঁরা একটি নতুন বিপদের মুখোমুখি। আর তা হলো, সাবেক সরকারের যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁরা এবং তাঁদের বিদেশি সমর্থকেরা নতুন সংঘাত উসকে দেওয়ার, দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যার লক্ষ্য হলো দেশকে বিভক্ত করা। ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ধ্বংস করা।

শারার ভিডিও বক্তব্যটি সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানায় প্রকাশ করা হয়েছে। বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, তাঁরা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করছেন যে বেসামরিক নাগরিকদের রক্তপাত অথবা জনগণের ক্ষতিসাধনে জড়িত ব্যক্তি, নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের অপব্যবহারকারী যে কাউকে তাঁরা কঠোরভাবে এবং নমনীয়তা ছাড়াই জবাবদিহির মুখোমুখি করবেন।

কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবেন না উল্লেখ করে দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যাঁদের হাত সিরিয়ার মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, তাঁরা শিগগির বিচারের মুখোমুখি হবেন।

এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে একটি পোস্ট দেন শারা। সেখানে তিনি বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতার তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আরও পড়ুনসিরিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাচ্যুত আসাদের অনুগত যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নিহত ১০০০২১ ঘণ্টা আগে

শারা তাঁর দেশে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে দেশটির উপকূলীয় প্রদেশ লাতাকিয়া ও তারতুসে নৃশংসতা চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

এদিকে রাজধানী দামেস্কের একটি মসজিদ থেকে দেওয়া এক ভাষণে শারা বলেন, ‘খোদা চাইলে আমরা একসঙ্গে এ দেশে বসবাস করতে পারব।’

সিরিয়ার একটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, লাতাকিয়া, জাবলা ও বানিয়াস শহরের চারপাশে গতকাল সংঘর্ষের তীব্রতা কমেছে।

গত বৃহস্পতিবার সরকারি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলার পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে সরকারি বাহিনী ও আসাদের অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।

সিরিয়ায় প্রাণঘাতী সহিংসতার প্রতিবাদ জানাতে দেশটির শত শত মানুষ রাজধানী দামেস্কে জড়ো হয়েছিলেন। গতকাল বিক্ষোভকারী ব্যক্তিরা দামেস্কের মারজেহ স্কয়ারে প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হন।

আরও পড়ুনসিরিয়ায় অভিযানে আলাউইত সম্প্রদায়ের ১৬২ জন নিহত, অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান শারার০৮ মার্চ ২০২৫

এদিকে সংঘর্ষের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে বসবাসকারী সিরিয়ার শত শত বেসামরিক মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। লাতাকিয়া ও তারতুস প্রদেশ ছিল বাশার আল-আসাদের সাবেক ঘাঁটি। তিনি আলাউইত সম্প্রদায়ের মানুষ।

আরও পড়ুনসিরিয়ায় আসাদের অনুসারীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষ, ৭০ জনের বেশি নিহত০৭ মার্চ ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ঘর ষ র বর ত গতক ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস

স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।

মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’

সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

অনাহারে মৃত্যু ১৫৪

গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।

গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।

বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।

গাজায় স্টিভ উইটকফ

শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ