সিরিয়ায় রক্তপাতের ঘটনায় দায়ীদের খুঁজে বের করার অঙ্গীকার শারার
Published: 10th, March 2025 GMT
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতিসাধনের সঙ্গে জড়িত যে কাউকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার অঙ্গীকার করেছেন।
সিরিয়ায় কয়েক দিনের সংঘর্ষে ব্যাপক প্রাণহানির পর গতকাল রোববার এমন অঙ্গীকার করেন শারা। অভিযোগ আছে, গত কয়েক দিনে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সংখ্যালঘু আলাউইত সম্প্রদায়ের শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এটি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের সম্প্রদায়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, গত শুক্রবার ও শনিবার পশ্চিম উপকূলে আলাউইত সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে চালানো ‘নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে’ ৮৩০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর এই সহিংসতার ঘটনাকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে সহিংসতায় প্রাণহানির সংখ্যা ঠিক কত, তা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।
গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাত করে শারার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। পরে শারা সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।
গতকাল সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বক্তব্যে শারা দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে ধরারও অঙ্গীকার করেন।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাব অনুসারে, গত কয়েক দিনের সংঘর্ষে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর ২৩১ জন সদস্য এবং ২৫০ জন আসাদপন্থী যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষের ঘটনায় মোট প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজার ৩১১।
আরও পড়ুনসিরিয়ায় ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা, মরদেহ পড়ে আছে খোলা মাঠে১১ ঘণ্টা আগেগতকাল শারা বলেন, আজ তাঁরা যখন এই সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, তখন তাঁরা একটি নতুন বিপদের মুখোমুখি। আর তা হলো, সাবেক সরকারের যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁরা এবং তাঁদের বিদেশি সমর্থকেরা নতুন সংঘাত উসকে দেওয়ার, দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যার লক্ষ্য হলো দেশকে বিভক্ত করা। ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ধ্বংস করা।
শারার ভিডিও বক্তব্যটি সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানায় প্রকাশ করা হয়েছে। বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, তাঁরা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করছেন যে বেসামরিক নাগরিকদের রক্তপাত অথবা জনগণের ক্ষতিসাধনে জড়িত ব্যক্তি, নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের অপব্যবহারকারী যে কাউকে তাঁরা কঠোরভাবে এবং নমনীয়তা ছাড়াই জবাবদিহির মুখোমুখি করবেন।
কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবেন না উল্লেখ করে দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যাঁদের হাত সিরিয়ার মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, তাঁরা শিগগির বিচারের মুখোমুখি হবেন।
এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে একটি পোস্ট দেন শারা। সেখানে তিনি বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতার তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আরও পড়ুনসিরিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাচ্যুত আসাদের অনুগত যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নিহত ১০০০২১ ঘণ্টা আগেশারা তাঁর দেশে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে দেশটির উপকূলীয় প্রদেশ লাতাকিয়া ও তারতুসে নৃশংসতা চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
এদিকে রাজধানী দামেস্কের একটি মসজিদ থেকে দেওয়া এক ভাষণে শারা বলেন, ‘খোদা চাইলে আমরা একসঙ্গে এ দেশে বসবাস করতে পারব।’
সিরিয়ার একটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, লাতাকিয়া, জাবলা ও বানিয়াস শহরের চারপাশে গতকাল সংঘর্ষের তীব্রতা কমেছে।
গত বৃহস্পতিবার সরকারি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলার পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে সরকারি বাহিনী ও আসাদের অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।
সিরিয়ায় প্রাণঘাতী সহিংসতার প্রতিবাদ জানাতে দেশটির শত শত মানুষ রাজধানী দামেস্কে জড়ো হয়েছিলেন। গতকাল বিক্ষোভকারী ব্যক্তিরা দামেস্কের মারজেহ স্কয়ারে প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হন।
আরও পড়ুনসিরিয়ায় অভিযানে আলাউইত সম্প্রদায়ের ১৬২ জন নিহত, অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান শারার০৮ মার্চ ২০২৫এদিকে সংঘর্ষের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে বসবাসকারী সিরিয়ার শত শত বেসামরিক মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। লাতাকিয়া ও তারতুস প্রদেশ ছিল বাশার আল-আসাদের সাবেক ঘাঁটি। তিনি আলাউইত সম্প্রদায়ের মানুষ।
আরও পড়ুনসিরিয়ায় আসাদের অনুসারীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষ, ৭০ জনের বেশি নিহত০৭ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ঘর ষ র বর ত গতক ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।