ছাত্রদের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দলের সূচনা হয়েছে, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করি, একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তাদের ভূমিকা থাকবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদে সবারই প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান অগণতান্ত্রিক সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার হবে, সংশোধনী হবে। সেটাতে তারাও ভূমিকা রাখবে, আমরাও রাখব, সে প্রত্যাশা আমাদের আছে। 

তবে ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দলটি প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, একটি নতুন রিপাবলিক (প্রজাতন্ত্র), সেকেন্ড রিপাবলিক তারা চায়। সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদের মাধ্যমে তারা একটি নতুন সংবিধান রচনা করতে চায়। আমরা মনে করি, এ কথাগুলো পরস্পরবিরোধী। কারণ, আমাদের একটি সংবিধান আছে। আমরা নতুন করে একটি রাষ্ট্র হিসেবে এখন আত্মপ্রকাশ করিনি।

১৯৭১ সালে আমরা এ রাষ্ট্র পেয়েছি। যেখানে রাষ্ট্র নতুনভাবে স্বাধীন হয় এবং সংবিধান রচিত থাকে না, সেখানে সংবিধান নতুনভাবে রচনা করার জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। এখানে আমাদের একটি রাষ্ট্র আছে, যা স্বাধীন-সার্বভৌম। এখন সেই রাষ্ট্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।

আমাদের এ রাষ্ট্রের প্রথম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে। সেটা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে, আমাদের বিজয় অর্জনের পরে যে গণপরিষদ ঘোষণা করা হয়েছিল আগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে। সেই গণপরিষদের মাধ্যমে একটি সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের রিপাবলিক (প্রজাতন্ত্র) রচনা হয়ে যায়। 

রিপাবলিকের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আবার নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন হবেন। সেই রাষ্ট্রের হেড অব স্টেট থাকবে। সেটা নমিনেটেড (মনোনীত) হোক বা ইলেকটেড (নির্বাচিত) হেড অব দ্য স্টেট হোক। সে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এ রাষ্ট্রের আছে। অর্থাৎ আমরা একটা রিপাবলিকের মধ্যেই আছি। 

এই রিপাবলিকের মধ্যে অনেক সময় অনেক রকমের সিস্টেম পরিবর্তন হয়েছে। যেমন একদলীয় শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব এই রিপাবলিকের চরিত্র পরিবর্তন করেছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের সময় পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য পুনঃস্থাপন করা হয়। তখন বিচার বিভাগের ওপর যে হস্তক্ষেপ বাকশালের মধ্য দিয়ে হয়েছিল, সেটাকে আবার সংশোধিত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্থাপন করা হয় সংবিধানের ৯৬ ধারায়, যেটা এখনো বহাল। 

.

..এভাবে পরবর্তীকালে আমরা প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম থেকে ১৯৯২ সালে সংসদীয় ব্যবস্থায় এলাম। তো এগুলো রিপাবলিকের মধ্যে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন ও সংশোধনী আসে। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন হয়েছে। এগুলো সবই ন্যাচারাল পরিবর্তন হয় সংবিধানের। রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের চাহিদা অনুসারে এসব পরিবর্তন ও সংস্কার আনতে হয়। 

কিন্তু প্রতিবারই যদি আমরা এই সংবিধান সংশোধনগুলোয় একটা রিপাবলিকের ক্রমিক নম্বর দিই, সেটা অসুবিধা। কারণ, এতে রিপাবলিকের পরিবর্তন হয় না। রিপাবলিকের যে চরিত্র, যে বৈশিষ্ট্য, তার মধ্যে কিছু সংস্কার, কিছু সংশোধনী আসে। কিন্তু আমরা একটি রাষ্ট্রে আছি এবং সেই রাষ্ট্র স্বাধীন-সার্বভৌম। তাকে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে আসার জন্য আমরা রিপাবলিকের চলনের মধ্যে, ধরনের মধ্যে, পরিচালনার মধ্যে বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী। 

জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী এটা করতে গেলে যেমন বিভিন্ন আইন লাগে, সংবিধানেও সে রকম পরিবর্তন আনতে হয়, আনব। কিন্তু সেটার জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন নেই; যেহেতু আমরা নতুন রাষ্ট্র নই, একটা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র। দ্বিতীয় রিপাবলিক বলতে তারা (ছাত্রনেতৃত্ব) যেটা বোঝাচ্ছে, তারা সেটা না বুঝে হয়তো নামকরণ করছে। আমাদের এই রিপাবলিকের পরিচালনার জন্য বিভিন্ন রকমের সাংবিধানিক ও আইনি সংশোধনী যেগুলো প্রয়োজন, সেটা আমরা আনব।

আরেকটি হচ্ছে নতুন সংবিধান, আসলে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংবিধান আমরা হাতে পাব সামনে। সেটাও অনেকটা ব্যাপক সংস্কারযুক্ত, সংশোধনীযুক্ত সংবিধান আমরা পাব। যেটাকে আমরা বলব একটা বৃহত্তর কনসাশনেসের (সচেতনতা) মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কার হবে আমাদের সংবিধানের। সেটা আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, আমাদের ৩১ দফায়ও ছিল, বর্তমানে সংস্কার কমিশনগুলোর গঠনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সে উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাসহ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে প্রস্তাব দিয়েছি। এ ব্যাপারে এখনো আলাপ-আলোচনা চলছে। সেই সংবিধানকে আমরা নতুন সংবিধান বলতে পারি। 

এখন যদি আমরা সংশোধিত সংবিধানকে নতুন সংবিধান নামে অভিহিত করতে চাই, তাতে আমাদের আপত্তি নেই, সেটা বলা যায়। কিন্তু এখন সেই নতুন সংবিধানের জন্য যদি আমরা এটাকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করতে চাই, সেটা একটা বাক্যবিলাস ছাড়া আর কিছু হবে না।

এখনো আমরা যদি আবেগপ্রবণ হয়ে বাক্যবিলাসের মধ্যে থাকি, সেটা জাতির জন্য সুসংবাদ নয়। আমি আশা করব, আমাদের নতুন বন্ধুরা, যাঁরা পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিতে এসেছেন—সমাজের পরিবর্তনের জন্য এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য—তাঁদের আমরা অনুরোধ করব, আমরা যেন সম্মিলিতভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ঐক্যের মধ্যে যেন কোনোভাবে ফাটল সৃষ্টি হতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখি।

সালাহ উদ্দিন আহমদ স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র প বল ক র ন র জন য আম দ র এ

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে

ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে’। আধুনিক যুগের বিপ্লব প্রায়ই পুরোনো সংবিধানকে খেয়ে ফেলে। ব্রিটিশ রাজকবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায়, পুরোনো বন্দোবস্ত সরে গিয়ে স্থান করে দেয় নতুন ব্যবস্থাকে। জার্মান আইনবিদ কার্ল স্মিটের ভাষায়, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ অর্থাৎ ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র উদ্ভব ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবি সিয়েসের মতে, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটে।

স্মিটের মতে, ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় যে বা যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি বা তাঁরাই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম শক্তি আইনের বাইরে ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুরোনো আইনব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামো বা বিধিবিধান, কোনো কিছু দিয়েই এই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় না; সেসব থেকে এর চূড়ান্ত বৈধতার নিদান খোঁজাও যায় না। পুরোনো ব্যবস্থা সেই সমাধান দিতেও সক্ষম নয়। বিদ্যমান সবকিছুই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় নয়া সার্বভৌম শক্তির সব সিদ্ধান্তের অধীনে প্রয়োগ হয়।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে এক ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

বাস্তবে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেওয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গাতেই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে।

আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো, এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কিন্তু যত যা–ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়।

২.

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় ঢুকে গিয়েছি, তা ছাত্র–জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বা জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে।

তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে আইয়ুব খান সংবিধান রদ করে ‘আইন (বলবৎকরণ) আদেশ, ১৯৫৮’ জারি করেন। তাতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে মৃত সংবিধান অভিহিত করে রদ করা হলেও সেটিকেই আবার ‘ভেন্টিলেশন’–এ আনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড যত দূর সম্ভব ‘মৃত সংবিধান’ অনুযায়ীই চলবে, তবে সামরিক আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।

১৯৬৯ সালে আইয়ুব নিজেই যখন মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করে সংবিধান রদ করে হুবহু একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৬৯’ দিয়ে।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে মতভেদ এত প্রবল কেন?৩০ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টে জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনের ঙ ও চ—দফার মাধ্যমে ঘোষণাপত্র ও সামরিক আইন বিধিমালা ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ রাখা হয়। এই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত প্রণীত অনেকগুলো ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ বলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়।

এসব সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটানো সাংবিধানিক কাঠামো দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই সম্পন্নের পর গঠিত জাতীয় সংসদে সেগুলো অনুমোদিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে কোনো সংশোধনীই আনা হয়নি, শুধুই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনে আনা সংশোধনীগুলোই অনুমোদন করা হয়।

১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করে দেন এবং আরেক কাঠি সরেস হয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করে এর অধস্তন হিসেবে পূর্ববর্তী সব আইনকানুন, ব্যবস্থা চালু রাখেন। এর অধীনে তিনিও ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ জারি করে সংবিধানে সংশোধনী আনেন, যেগুলো পরে সপ্তম সংশোধনী হিসেবে অনুমোদিত হয়।

১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন জারি করে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১’ নামে। এ আইনের বলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধানকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে কার্যকর রাখা হয়। এরও আগে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েও দেখা যায়, নতুন বন্দোবস্তের আলোকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ১৮(৩) ধারাতেও উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগের সব আইন কার্যকর রাখা হয়।

এসব দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, যারাই একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে, তারা পূর্বের সংবিধান বা আইনি কাঠামোর যেটুকু মানতে চায়, সেটুকুই নিতে পারে। চাইলে পুরোটাই নিতে পারে, না চাইলে পুরোপুরি বাদও দিতে পারে। একবার পূর্ববর্তী সংবিধানের কিছু নিয়েছে বলেই তা সব সময় মেনে চলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

প্রকৃতপক্ষে এটা অভ্যুত্থানের একটা মূলনীতি; পূর্বের কাঠামো থেকে যত দূর সম্ভব বেরিয়ে আসা। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব না হয়, তত দিন আগের রাষ্ট্রকাঠামোর কলকবজাগুলো প্রয়োজনমতো গৃহীত বা বর্জিত হয়। তাদের এই ম্যান্ডেট দেয় অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী।

৩.

এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরেকটা বয়ান নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিপ্লবী চরিত্র’ নষ্ট হয়ে গেছে।

ফরহাদ মজহারের এ রকম বক্তব্যে যুক্তি আছে কি নেই, তাঁর চেয়ে বড় কথা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সরকারের বৈধতা, শাসনতান্ত্রিক পরম্পরার ব্যাপারগুলোতে এটাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এর কারণটি হলো, কাঠামো বদলে গেলেই বৈধতার নতুন পথ তৈরি হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অনেক জাতীয় পার্লামেন্ট সদস্যকে (এমএনএ) অযোগ্য ঘোষণা করে। তারপর সেসব আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বেশির ভাগ আসনে পছন্দের প্রার্থীদের একতরফাভাবে জিতিয়ে আনে।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পূর্বের পার্লামেন্ট সদস্যরাই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। একই সময় পাকিস্তানেও একটি গণপরিষদ গঠিত হয় ’৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত দুজন এমপি ছিলেন নুরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের গণপরিষদে আবার এই দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের অভিপ্রায় বদলে গিয়েছিল বলেই নতুন কাঠামোর জন্ম হয়েছিল, বৈধতার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।৪.

আধুনিক কালে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নাগরিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ। শুরুতেই জনগণ ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে জুলাই-উত্তর নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সার্বভৌম ক্ষমতা সুসংহত করেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চলতি সংবিধানের আওতায় শপথ নিলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবী চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, ৩৬ জুলাই এখানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ও একটা ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’র জন্ম দিয়েছে।

‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ সার্বভৌম ক্ষমতাকে বাছাই করার ম্যান্ডেট দেয়, কী করতে হবে আর কী না করলেও চলবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মতামত নেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে কিছু ভাবনা১৮ আগস্ট ২০২৫৫.

তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে? এর জবাব হলো, সেটা হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে। এটাও সার্বভৌম ক্ষমতার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে? সেখানে কি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত?

লক্ষণীয়, ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য রায় পেয়েছিলেন। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভোট পেয়েছিল ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবেই এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বও সেই গণপরিষদের ছিল না।

আবার গণপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল আদেশ পাস করে এর তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে ২০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ফলে ওই গণপরিষদের পক্ষে স্বাধীনভাবে জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সর্বোপরি ওই গণপরিষদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি; এ দেশে বারবার ঘটা গণ–অভ্যুত্থান, সংবিধান স্থগিত, সংবিধান পুনর্লিখনের মতো ঘটনাগুলো থেকেই তা বোঝা যায়। এর ফলে জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ দিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়।

 এ রকম পটভূমিতে জুলাই সনদের আইনগত অবস্থান বা এর বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ হিসেবেই ধরতে হবে জুলাই সনদকে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়েই এর বাস্তবায়ন হওয়াই মানানসই হয়।

আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ফেরত আসার পর জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বা এর মুখাপেক্ষী করা হলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা তার কর্তৃত্ব হারাবে। এতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জুলাই সংঘটিত হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার অধীনেই জুলাই অভ্যুত্থানের বৈধতা-অবৈধতার বিচার বা পর্যালোচনার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়০৮ আগস্ট ২০২৫

আবার পরবর্তী সংসদই কেবল এগুলো বাস্তবায়ন করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী, এটাও অলঙ্ঘনীয় কোনো ব্যাপার নয়।

পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে; একইভাবে জুলাই সনদ আগে বাস্তবায়ন করে পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।

কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজপথে হওয়া রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়। কিছু ফয়সালা জাতীয় ঐকমত্য, কিছু নির্বাচনে আর কিছু সংসদে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীতলতা। জুলাই সনদ প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

মিল্লাত হোসেন আইন–আদালত, সংবিধান বিষয়ে লেখক ও গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি?
  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে