সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছিলেন, তখন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর শয্যাপাশে ছিলেন তাঁর দুই সন্তান মুনিজে মঞ্জুর ও সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও তিনি কথা বলেছেন দুই সন্তানের সঙ্গে। বলেছেন তাঁর ইচ্ছার কথা, জীবনের ভালো লাগার কথা। জীবনদর্শন, দেশ ও মানুষকে নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা।

সিঙ্গাপুর সময় আজ বুধবার সকাল ৯টা ৩১ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৩১ মিনিট) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

সিঙ্গাপুর থেকে বাবার মরদেহ নিয়ে দেশে ফেরার জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষারত সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বাবার সঙ্গে শেষ মুহূর্তে ভাইবোনের কথোপকথনের কথা জানান প্রথম আলোকে। নাসিম মঞ্জুর বলেন, কথা বলতে বলতেই চোখ বুজেছেন বাবা। যাঁকে তিনি আব্বু বলেই সম্বোধন করতেন। ছেলের প্রতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর শেষ কথাটি ছিল ইংরেজিতে।

নাসিম মঞ্জুর বলেন, মৃত্যুর ২০-৩০ সেকেন্ড আগে আব্বু আমাকে বললেন ‘টেক মি হোম, দ্যাট ইজ ইয়োর জব।’ এ কথা বলেই চোখ বুজেছেন আব্বু।

ছেলেকে বলা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর শেষ বাক্যটির বাংলা অর্থ, ‘আমাকে ঘরে নিয়ে চলো, এটাই তোমার কর্তব্য।’ সেই কর্তব্য পালনে বাবার কথা অনুযায়ী, মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে অপেক্ষায় রয়েছেন সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, তাঁর বোন মুনিজে মঞ্জুরসহ অন্য সদস্যরা। সিঙ্গাপুর সময় আজ রাত ৮টা ২০ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজে বাবার মরদেহ নিয়ে রওনা দেবেন তাঁরা। বাংলাদেশ সময় ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে তাঁদের। নাসিম মঞ্জুর জানান, বিমানবন্দর থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে গুলশানে তাঁদের বাসায়। সেখানেই রাতে মরদেহ রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কারণ, আব্বু ঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন—কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললেন নাসিম মঞ্জুর।

মৃত্যুর আগে দেশ, ব্যবসা নিয়েও দুই সন্তানের সঙ্গে কথা বলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। দিয়েছেন উপদেশ। নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘মৃত্যুর আগে আমাদের (ভাই-বোন) প্রতি আব্বুর উপদেশ ছিল জীবনে যা কিছুই করো, সব সময় মনে রাখবে, আগে দেশ, তারপর ধর্ম। আব্বু আমাদের আরও বলেছেন, মুসলমান হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। কিন্তু অন্য সব ধর্মের প্রতিও আমি খুবই শ্রদ্ধাশীল। কারণ, আমাদের সবার রক্ত এক। ধর্ম যার যার নিজের, মানুষ হিসেবে কোনো ভেদাভেদ নেই।’ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘মৃত্যুর আগেও আব্বু আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা দিয়ে গেছেন।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন রাজধানীর হাজারীবাগে। হাজারীবাগে অ্যাপেক্স ট্যানারি দিয়ে ১৯৭৬ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে তিনি চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত হন। তাই মৃত্যুর আগে সন্তানদের বলে গেছেন, ‘হাজারীবাগে আমার জীবনের স্বর্ণালি সময় কেটেছে। সেখানে যে সম্মান পেয়েছি, তা জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।’

জীবন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার পথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখার কথাও সন্তানদের বলেছেন তিনি। দেশে ফিরে যেতে চেয়েছেন নিজের প্রতিষ্ঠিত ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আব্বু বলেছেন, আমাকে তোমরা ইস্টওয়েস্টে নিয়ে যাবে। ওখানে অনেক ছেলেমেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাঁরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন।’

এ জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। সেখানেই হবে মরহুমের প্রথম জানাজা। এরপর বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে বনানী কবরস্থানে স্ত্রী নিলুফার মঞ্জুরের কবরে দাফন করা হবে বলে জানান সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মরদ হ ন য় আম দ র বল ছ ন জ বন র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ