এ বছরের ২ মার্চ সফল হলো মানুষের আরও একটি চন্দ্রাভিযান। ফায়াফ্লাই অ্যারোস্পেসের ‘ব্লু গোস্ট’ চন্দ্রযান যখন পা রেখেছে চাঁদের মাটিতে, বাংলাদেশ সময় তখন বেলা ১টা বেজে ৩৪। পূর্বাঞ্চলীয় মান সময় ভোর ৩টা ৩৪। ব্লু গোস্ট, বাংলায় ‘নীল অশরীরী’র বিনয়ী অবতরণ ঘটে চাঁদের লাভানির্মিত মাটির অংশে। চাঁদের নিঃসঙ্গ আগ্নেয়গিরি বিখ্যাত মন্স লাতরেইলে থেকে বেশি দূরে নয়। বহু যুগ আগে লাতরেইলের অগ্ন্যুৎপাতই ওই অববাহিকা তৈরি করে থাকতে পারে। জায়গাটা চাঁদের কেন্দ্রীয় মারে ক্রিসিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। মারে ক্রিসিয়াম প্রায় তিনশ মাইল পরিধির এক সুবিস্তৃত অববাহিকা। নানা দিক থেকে এ মিশন গুরুত্বপূর্ণ। ‘নীল অশরীরী’র এই সফল অবতরণের ফলে পৃথিবীর সাধারণ মানুষ চাঁদের আরও কাছে পৌঁছে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। এ অভিযান নিকট ভবিষ্যতে চাঁদে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের আভাস।
আইজাক আসিমভের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে আমরা পড়েছি, কোনো এক গ্রহের কৃষকের ছেলে দূরগ্রহে ভাগ্যের অন্বেষণে যেতে চেপে বসেছে মহাকাশযানের ইকোনমি ক্লাসে। ভবিষ্যৎ বাস্তবতার এমন রূপরেখাই যেন নিরূপণ করতে চাইল ‘ব্লু গোস্ট’। যে দুটো সম্মিলিত প্রকল্পের আওতায় এ অভিযান, সেগুলো হলো নাসার কমার্শিয়াল লুনার পে লোড সার্ভিস ও আর্টেমিস মিশন। নাসার কমার্শিয়াল লুনার পে লোড সার্ভিসকে বাংলায় বলা যেতে পারে বাণিজ্যিক চন্দ্র পরিবহন পরিষেবা। ওদিকে আর্টেমিস মিশন নিয়ে তো জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। ভবিষ্যতে পৃথিবীর নানান দেশের অংশগ্রহণমূলক চন্দ্রাভিযান সম্পন্ন হবে এই আর্টেমিস মিশনের আওতায়। চাঁদে যাবে মানুষ, যাবে পণ্য, নিয়মিত। ধারণা করা হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতেই চাঁদে একজন নারী ও একজন অশ্বেতাঙ্গ যাবেন এই আর্টেমিস মিশনের আওতায়।
এসব দিক বিচারে ‘নীল অশরীরী’ এই অভিযান নিছক কোনো অনুসন্ধান প্রকল্প নয়। সম্ভবত এটি ‘অ্যানাদার জায়ান্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড’। স্মরণ করা যাক, ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদে পা রাখা নিল আর্মস্ট্রংয়ের উক্তি, “দ্যাট’স ওয়ান স্টেপ ফর আ ম্যান, ওয়ান্ট জায়ান্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড।” চাঁদে আর্মস্ট্রংয়ের এক পা ফেলা ছিল মানবজাতির জন্য অকল্পনীয় দূরত্ব অতিক্রমের সমতুল্য। এটিও তদ্রূপ।
নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক জ্যানেট পেট্রো উচ্ছ্বসিত হয়ে বেশ উচ্চাভিলাষী মন্তব্যই করলেন। ‘এই অবিশ্বাস্য অর্জন কিন্তু একটি বিশেষ দিক আমাদের সামনে উন্মোচন করছে। যা অনস্বীকার্য তা হলো, নাসা ও মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের সবার হয়ে, প্রত্যেকের কল্যাণে মানুষের মহাকাশযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এরই মাঝে নতুন অনেক কিছুই জেনেছি আমরা। আমাদের প্রযুক্তির এই পরাকাষ্ঠা, ফায়ারফ্লাই ব্লু গোস্ট মিশন ১ শুধু মানুষের বৈজ্ঞানিক সঞ্চয়ই বাড়াবে না; ভবিষ্যতে চাঁদসহ মহাকাশে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সব ব্যবহারিক বাধা, আওতা, শক্তি-সাধ্য, সীমাবদ্ধতা, পথরেখাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ও নির্ণয় করা সম্ভব হবে। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে মানুষের মহাকাশ অভিযানে যেসব তথ্য ভীষণ কাজে আসবে আমাদের।’
ব্লু গোস্ট বা নীল অশরীরী দশটি যন্ত্রকে পরিচালিত করবে চাঁদের বুকে ও প্রয়োজনে বায়ুমণ্ডলে। গোটা এক চান্দ্রদিবস চলবে এ অভিযান। এক চান্দ্রদিবস পৃথিবীতে ১৪ দিন।
চাঁদের পথে দীর্ঘ এ যাত্রা শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি। ২ মার্চ চাঁদের বুকে নামার আগ পর্যন্ত এ মহাকাশ প্রকল্প অতিক্রম করেছে অকল্পনীয় দূরত্ব, ২৮০ লাখ মাইল। পৃথিবীতে ২৭ গিগাবাইট ডেটা ডাউনলিংক করে কাজ পরিচালনা জলবৎ তরলৎ, কিন্তু মহাকাশে এর জন্য জটিল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ যান্ত্রিক সামর্থ্য প্রয়োজন। সেই সামর্থ্যেরও প্রমাণ দিয়েছে ফায়ারফ্লাইয়ের এই মহাকাশযান অভিযান। মহাকাশযানের পথপরিক্রমায় জিএনএসএস সুবিধা ব্যবহার করতে হয়। জিএনএসএসের পূর্ণরূপ– গ্লোবাল নেভিগেশিন স্যাটেলাইন সিস্টেম। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পরিচালিত এ সেবা কাজে লাগিয়ে মহাকাশযান তার অবস্থান, আনুমানিক ও আনুপাতিক সময়, পথরেখা জেনে নিতে পারে। অনেকটা যেভাবে জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীতে মানুষ যে কোনো মুহূর্তে তার অবস্থান, গতিপথ, গন্তব্যে পৌঁছানোর আনুমানিক সময় এসব জেনে নিতে পারছে। বলা যেতে পারে সব জিএনএসএস এক ধরনের জিপিএস। কিন্তু সব জিপিএস জিএনএসএস নয়। ব্লু গোস্ট মিশন দুই লাখ ছেচল্লিশ হাজার মাইল দূর থেকে জিএনএসএসের মাধ্যমে তার অবস্থান, সময়সহ আনুষঙ্গিক তথ্য নির্ণয় করতে পেরেছে। এবং এটিও একটি বিশ্বরেকর্ড। জিএনএসএস সংকেত গ্রহণের এখন পর্যন্ত এটাই সর্বাধিক দূরত্ব।
এ অভিযান বেশ কিছু সম্ভাবনা নিরূপণ করতে যাচ্ছে। চাঁদে কোনো ধরনের ভবিষ্যৎ মানববসতি অথবা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের যা কিছু প্রয়োজন, সেসব স্থাপনে চাঁদ কতটা উপযুক্ত? চাঁদের মাটির দ্বিতীয় স্তরে চলবে খননকাজ। আমরা সেখানকার ভূপ্রকৃতি, মাটির গঠন, সহনশীলতা সম্পর্কে জানব ক্রমশ। জানতে পারব চাঁদের বিভিন্ন রকম খনিজ শিলা, সেসবের স্তরবিন্যাস সম্পর্কে। খতিয়ে দেখা হবে পৃথিবীর মতো চাঁদকেও গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবস্থার আওতায় আনা কতটা সম্ভব। মানুষের অনুকূল পরিবেশ তৈরির স্বার্থে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তলিয়ে দেখা হবে। এক.
মানুষ কল্পনাপ্রবণ, স্বপ্নবাজ বলেই মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার স্পর্ধা রাখে। নিকি ফক্সের কথা শোনা যাক। তিনি নাসার ওয়াশিংটন দপ্তরের সহযোগী প্রশাসক। বললেন, ‘মানুষ ভবিষ্যতে এই মহাভুবনের আরও বহু অংশ যেন জয় করতে পারে, সেই উৎসাহ ও স্বপ্নের পথ নির্মাণ করছে নাসা। চাঁদে এই প্রাযুক্তিক সাফল্য আমাদের সেই পথনির্মাণেরই অংশ।’ একটি নতুন শব্দের অবতারণা ঘটতে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে। লুনার ইকোনমি। চান্দ্র অর্থনীতি। সেই আভাস মিলল নিকি ফক্সের কথায়– ‘চাঁদভিত্তিক অর্থনীতিরও ভিত তৈরি হচ্ছে। এর জন্য নাসা কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে পাশে পেয়েছে। আসছে দিনের এই অর্থনীতি দৃঢ় ভিতের পর দাঁড়িয়ে যেতে পারে।’ v
নাসার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত টিয়েরনান ডি ডয়েলের নিবন্ধ
অনুসরণে হামিম কামাল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র আওত য় জ প এস আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে প্রতি কেজি আলুর হিমাগারভাড়া কমল ৭৫ পয়সা
রাজশাহীতে হিমাগারে আলু সংরক্ষণে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ সোমবার আলুচাষি, ব্যবসায়ী ও হিমাগারমালিকদের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হিমাগারে প্রতি কেজি আলু রাখার জন্য ভাড়া দিতে হবে ৫ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে শ্রমিকের খরচ ৫০ পয়সা। সেই হিসাবে প্রতি কেজি আলুর হিমাগারভাড়া কমেছে ৭৫ পয়সা।
এর আগে গত মার্চে সরকার প্রতি কেজি আলু রাখার ভাড়া ৬ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর পর থেকে এ নিয়ে রাজশাহীর আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা বাড়তি ভাড়ায় আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে কয়েক দফা তাঁরা রাজপথে আন্দোলনও করেছেন। অন্যদিকে হিমাগারমালিকদের দাবি ছিল, প্রতি কেজি আলুর ভাড়া ৮ টাকা করা হোক।
রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন এবং রাজশাহী জেলা আলুচাষি ও আলু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজশাহীতে হিমাগার থেকে বাড়তি ভাড়া না দিলে আলু ছাড়া হবে না। এর প্রতিবাদে ঈদের পর নতুন করে আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করে আসছেন। তাঁদের দাবি, আলু রাখার খরচ আগের বছরের মতো চার টাকা করতে হবে। এ নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তাঁরা। হিমাগার মালিকপক্ষ এ নিয়ে আলোচনায় বসার তাগিদ দিয়ে আসছিল।
এরই মধ্যে আলুচাষিনেতারা ১৪ জুন সেনাবাহিনীর কাছে এ নিয়ে একটি অভিযোগ দেন। পরে বিষয়টি আমলে নিয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আজ দুপুরে সভা ডাকা হয়। সভায় সব পক্ষের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে এ বছর সরকার নির্ধারিত প্রতি কেজি আলুর হিমাগারভাড়া ৬ টাকা ৭৫ পয়সার বদলে ৫ টাকা ৫০ পয়সা ও শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা রাখা হবে। আর পেইড বুকিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা দিতে হবে আলু রাখা চাষি ও ব্যবসায়ীদের। পরে বিকেলে ক্যান্টনমেন্টে হওয়া এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিকভাবে পাস করার জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সভা হয়।
সভায় আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, হিমাগার মালিক সমিতি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি, পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীকাল মঙ্গলবার রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে নতুন ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি সব হিমাগারে প্রচার করা হবে।
এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এবার আলুর দাম কম। আবার এ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘাতের আশঙ্কা ছিল। এ নিয়ে একটি অভিযোগ পান তাঁরা। পরে দুই পক্ষকে নিয়ে সভা হয়। সভায় সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত বিকেলে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আরেকটি সভার মাধ্যমে পাস হয়েছে।
রাজশাহীর আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মিঠু আহমেদ বলেন, শুরু থেকেই তাঁরা বাড়তি ভাড়ার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। কয়েক দিন ধরে তাঁরা হিমাগার থেকে আলু নিতে পারছিলেন না। হিমাগারগুলোয় বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছিল। এ নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও অবহিত করেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত একটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রহমান সিডস স্টোরেজের ব্যবস্থাপক আবদুল হালিম বলেন, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি কেজি আলু রাখতে খরচ পড়বে ৫ টাকা ৫০ পয়সা আর শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা। এ ছাড়া যাঁরা আগে থেকেই টাকা দিয়ে অগ্রিম বুকিং দিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আলুর কেজিপ্রতি শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা দিতে হবে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, নতুন সিদ্ধান্ত সব হিমাগারমালিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হবে।
আরও পড়ুনরাজশাহীতে হিমাগারে ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ-সমাবেশ১৫ জুন ২০২৫