বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, কুমিল্লায় বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণ
Published: 17th, March 2025 GMT
লাকসামের কান্দিরপাড় ইউনিয়নের আমুদা গ্রামে ২০০৮ সালের ২৫ মে ধর্ষণের শিকার হয় ১৫ বছরের এক কিশোরী। এ ঘটনায় জড়িত একই বাড়ির কবির হোসেনকে আটক করে পুলিশে দেন গ্রামবাসী। মামলা করেন ওই কিশোরীর দাদা। ডাক্তারি পরীক্ষা ও ডিএনএ প্রতিবেদনেও ধর্ষণের আলামত মেলে। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে যায় ধর্ষক কবির। ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পুলিশ মামলার অভিযোগপত্রও দেয়। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেই কিশোরীর বয়স এখন ৩২। আছেন স্বামী ও দুই সন্তান; থাকেন সিলেটে। মামলার বাদী তাঁর দাদা বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। এরই মধ্যে বিচারের প্রতীক্ষায় কেটে গেছে প্রায় ১৭ বছর।
কুমিল্লায় নারী ও শিশু ধর্ষণ মামলার রায়ে দীর্ঘসূত্রতার এমন নজির অসংখ্য। নারীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য বলছে, ধর্ষণ মামলার রায় পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রায়ের আগেই আপস করা হয়। এসব কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। ফলে কুমিল্লায় সাম্প্রতিক বছরে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা।
মামলা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার তদন্তে ধীর গতি, একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন ও কিছু ধর্ষণ ঘটনার ডিএনএ প্রতিবেদন পেতে দেরি, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, আসামিদের জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা হওয়া ও আলামত নষ্টের কারণে ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণ না পাওয়ার মতো ঘটনায় ধর্ষণের মতো অপরাধ ক্রমেই বাড়ছে। কুমিল্লায় গেল ৯ বছরে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩ হাজার।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের (কুমেক) ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ধর্ষণের ডাক্তারি পরীক্ষার পরিসংখ্যান বলছে, ৪ থেকে ৫ বছরের শিশু থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ২০১৬ সাল থেকে চলতি মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত কুমিল্লায় ২ হাজার ৯২৮ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালে যেখানে জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ছিল ২৬৭টি; ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩০-এ। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ২৯৭, ২০১৯ সালে ৩৫৬, ২০২০ সালে ৩৬৭, ২০২১ সালে ৩৬৫, ২০২২ সালে ৪১৮, ২০২৩ সালে ৩৫০, ২০২৪ সালে ৩৫৫ এবং চলতি বছরের ১২ মার্চ পর্যন্ত ৯০টি নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ঘটেছে ৪৩, ফেব্রুয়ারিতে ৩৪ এবং ১২ মার্চ দুপুর পর্যন্ত ১৩টি।
২০২৩ সালের ২ জুন দুপুরে দেবিদ্বারের ফতেহাবাদ ইউনিয়নের সাইচাপাড়া গ্রামের ইকবাল শাহ প্রতিবেশী এক প্রবাসীর মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। ঘটনা জানাজানি হলে বিষয়টি মীমাংসার জন্য চাপ দেন স্থানীয়রা। পরে তার মা বাদী হয়ে ৬ জুন রাতে দেবিদ্বার থানায় মামলা করেন। ১৮ জুন ঢাকার মিরপুর থেকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় ধর্ষক ইকবাল। এ ঘটনায় শিশুটির ডাক্তারি পরীক্ষা করা হলেও দেরির কারণে ধর্ষণের আলামত মেলেনি। কাপড়চোপড় থেকেও ডিএনএর নমুনা পাওয়া যায়নি। পরে পুলিশ ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও আদালতের নির্দেশে আবার সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। মামলার একমাত্র আসামি ইকবাল শাহ এখন জামিনে মুক্ত। পৌনে দুই বছরেও মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি বলে ওই শিশুর মা জানিয়েছেন।
২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর চকলেটের লোভ দেখিয়ে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের কৃষ্ণনগরে ৪ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে নির্মাণাধীন বাড়ির কার্নিশে সিমেন্টের ব্যাগে মুড়িয়ে রাখে মেহরাজ হোসেন তুষার নামে এক যুবক। ঘটনার ১৪ দিন পর পুলিশ মেহরাজ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। পরে সে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়। গত ১৫ জানুয়ারি মেহরাজের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক নাজমুল হক শ্যামল। ওই শিশুর পরিবারের অভিযোগ, একমাত্র আসামির জবানবন্দিতে হত্যা ও ধর্ষণের স্বীকারোক্তি থাকার পরও চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচারের রায় পেতে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে ছয় বছরেরও বেশি সময়।
কুমেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা.
নারীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এইড কুমিল্লার নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, অনেক ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একাধিকবার বদল হয়। চাপ দিয়ে মামলা আপস করা হয়। তাই আইনের প্রয়োগ করতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
১৭ বছরেও লাকসামের আমুদা গ্রামের এক কিশোরী ধর্ষণ মামলার রায় না হওয়া প্রসঙ্গে কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন বদিউল আলম বলেন, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। ভিকটিম কিশোরীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। মামলার বাদীও মারা গেছেন। এতে সময়মতো মামলার সাক্ষী হাজির করা হয়নি, তাই রায় দেরি হচ্ছে। মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ১০ এপ্রিল।
কুমিল্লা বার সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মিজানুর রহমান বলেন, আপিল করতে অনেক মামলার নথি উচ্চ আদালতে নেওয়া হয়। সব প্রক্রিয়া শেষ করতে গিয়ে মামলার রায় দিতে দেরি হয়।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।