ট্রাম্প আমেরিকায় পেরেস্ত্রোইকা নিয়ে আসছেন
Published: 18th, March 2025 GMT
আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের সঙ্গে ১০ বছরের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে দেশটি থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর দুই বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ চুক্তিটি ভেঙে যায় (এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়)। সাম্রাজ্যের কবরস্থান হিসেবে আফগানিস্তানের যে পরিচিতি, সেটা আরও সংহত হয়।
এর ৩০ বছর পর ২০২১ সালে তালেবানের সঙ্গে ২০ বছরের যুদ্ধ সমাপ্তি ঘোষণা করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তালেবান হলো মুজাহিদিনের উত্তরসূরি। চার বছর পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন একটা পদক্ষেপ নিলেন, যেটা কার্যকরভাবে আটলান্টিক জোট বা ন্যাটোর পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছে।
পরাশক্তির মধ্যে শীতল যুদ্ধ আফগানিস্তানের বাইরে বাকি বিশ্বজুড়ে সমান্তরালে চলেছিল। ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসে এবং এতে সমাজতন্ত্রের প্রতি ব্যাপক মোহভঙ্গ ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত সমাজ পুনর্গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ পেরেস্ত্রোইকা চালু করেন।
একইভাবে রোনাল্ড রিগ্যানের জামানা অবসানের পর মার্কিন ভোটারদের একটা অংশের মধ্যে প্রচলিত ব্যবস্থা নিয়ে সংশয় বাড়তেই থাকে। বৈষম্য বাড়তে থাকে। মনে হতে থাকে, আমেরিকান ব্যবস্থাটিতে শাসকশ্রেণির অভিজাত অংশ ভোটের ফলাফল কারচুপি করেন। মার্কিন ব্যবস্থাটিকে খোলনালচে বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৬ সালে ডোনাল্ঢ ট্রাম্প প্রথম দফায় নির্বাচিত হন।
মতাদর্শ ভেঙে ফেলা১৯৭৯ সালে পেরেস্ত্রোইকা ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেন সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ। স্থবির হয়ে পড়া সোভিয়েত ব্যবস্থার আধুনিকায়নের লক্ষ্য থেকে তিনি এ ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত নাগরিকদের রুটির জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো। প্রায়ই তাঁরা রেশনের দোকানগুলোর তাক শূন্য পেতেন। ফলে সমাজতন্ত্রের প্রতি তাদের বিশ্বাস মুছে যেতে থাকে।
সোভিয়েত সরকার আবাসন, শিক্ষা, পরিবহন ও বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিত। কিন্তু সামরিক খাতে ব্যয় ছিল জাতীয় বাজেটের ১২ থেকে ১৭ শতাংশ। ফলে ভোগ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে বাজেট, সেখান থেকে সম্পদ সামরিক খাতে চলে যাচ্ছিল। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের প্রতি যে দমনমূলক নীতি নেওয়া হয়েছিল, তাতে পুঁজিপতিদের জীবন নিস্তেজ ও প্রেরণাহীন হয়ে পড়েছিল।
ব্রেজনেভের উত্তরসূরি মিখাইল গর্বাচেভ পেরেস্ত্রোইকার পাশাপাশি ‘গ্লাসনস্ত’ বা ‘খোলা নীতি’ প্রবর্তন করেন। যাহোক, তাঁর আমলারা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সংস্কারে বাধা দেন এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেন।
গর্বাচেভ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে বাজার উদারীকরণের যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, সেটা উল্টো ফল নিয়ে আসে। অনিশ্চয়তা ও পণ্য সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। মূল্যস্ফীতি দেখা যায় এবং জীবনযাপনের মান খারাপ হয়। গর্বাচেভের উত্তরসূরি বরিস ইয়েলৎসিন মার্কিন অর্থনীতিবিদদের নির্দেশনায় রাশিয়াকে হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা থেকে পুরোপুরি বাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করেন। এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার অর্থনীতি ৫০ শতাংশ সংকুচিত হয় এবং লাখ লাখ মানুষ গরিব হয়ে পড়েন।
ট্রাম্প ও পুতিন দুজনেই নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের উত্তরসূরি। তাঁরা দুজনেই এখন নতুন যে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর ঘটছে, তার মূল খেলোয়াড়। বিশ্বায়ন শেষ হচ্ছে না, কিন্তু বিশ শতকের পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র, বাম বনাম ডান, রংক্ষণশীল বনাম প্রগতিশীল—মতাদর্শিক লড়াই চলমান থাকবে। ফলে রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি বাস্তববাদী ও জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে—এমন একটি কৌশল দরকার হবে।রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রাতারাতি বেসরকারীকরণ করতে গিয়ে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে শিল্পগুলো চলে যায়। বিপুল পরিমাণ সম্পদ তাঁরা বিদেশে পাচার করে দেন। জাতীয় সম্পদের এই অবাধ লুটপাট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতা গ্রহণের পর বন্ধ হয়। তিনি নব্য উদারীকরণকে উল্টে দেন এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ‘সবার আগে রাশিয়া’ নীতি চালু করেন।
রাশিয়া এই সংস্কার উদ্যোগ নেওয়ার তিন দশক পর ডোনাল্ড ট্রাম্প আমলাতন্ত্রের রাশ টেনে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ১৯৮০-এর দশক থেকে সেখানকার মানুষদের মোহভঙ্গ বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশের বেশি মার্কিন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক পথে চলছে না।
রিগ্যানের নেতৃত্বে যে নব্য উদারবাদী নীতি চালু হয়েছিল, সেখানে বিশ্বায়নের ব্যাপারটি ছিল সীমাহীন। এই নীতি মার্কিন অর্থনীতির মূল ভিত্তি শিল্প খাতকে শিল্পশূন্য করে তোলে। যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্যোক্তাদের প্রান্তিক করে ফেলে শ্রমিকদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছিল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র উল্টোটা করেছে। ফলে সম্পদ ওপরের স্তরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং শ্রমিকদের মজুরিতে স্থবিরতা নেমে আসে।
২০০০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ শ্রমিককে তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দুটি করে কাজ করতে হয়েছে। আর অন্যদিকে নির্বাহীরা শ্রমিকদের চেয়ে গড়ে ৩০০ গুণ বেশি মজুরি পেয়েছেন।
বৈশ্বিক ব্যবসার স্বার্থের একজন শতকোটিপতি হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প শ্রমজীবীশ্রেণির হতাশাকেই প্রতিধ্বনিত করেছেন। ২০২৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি তার পুরোনো যুদ্ধ জোরালো করেছেন, সরকারি চাকরির সংখ্যা কমিয়েছেন, মন্ত্রণালয়গুলো পুনর্গঠন করেছেন এবং অভূতপূর্ব ধরনের খরচ কমানোর আন্দোলন শুরু করেছেন।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্প ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। প্রথম মেয়াদে তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা পাঠালেও এ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তিনি পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা নিরর্থক হবে।
মিখাইল গর্বাচেভ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন ব যবস থ কর ছ ন র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস
স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’
সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অনাহারে মৃত্যু ১৫৪গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।
গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।
বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।
গাজায় স্টিভ উইটকফশুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।