সুখ খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি না তো?
Published: 20th, March 2025 GMT
সুখ কী—এ প্রশ্নের উত্তর হাজারজনের কাছ থেকে হাজার রকম আসতে পারে; কিন্তু এর পরও এই রকমফেরের মধ্যে একটি ‘মিল’ও খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটি অর্থসংক্রান্ত। অর্থাৎ কম–বেশি রেস্ত আপনার পকেটে থাকতে হবে। প্রতিবছর বিশ্বের সুখী দেশের যে তালিকা প্রকাশিত হয়, তাতে অর্থকড়ির তুলনামূলক চিত্রই মূলত প্রতিফলিত হয়। উদাহরণ—২০২৪ সাল পর্যন্ত ফিনল্যান্ডের টানা সপ্তমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের জায়গা দখল করে নেওয়া।
প্রতিবছরের ২০ মার্চ যে বিশ্ব সুখ দিবস পালন করা হয়, তার প্রস্তাবে জাতিসংঘের বক্তব্য ছিল, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সংগত ও ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির অবতারণা, যা বিশ্বের সব মানুষের সুখ ও কল্যাণকে উৎসাহিত করবে।’ অর্থাৎ জাতিসংঘও অর্থের গুরুত্বকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
কিন্তু এই ২০২৫ সালে এসেও তিন বেলা পেট পুরে খেতে পায় না—এমন মানুষের সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়। আর সেই গল্পের কথাও তো সবার জানা। যার সম্পদ–টম্পদ কিছুই ছিল না, এমনকি ছিল না একখানা জামাও, তাই তিনি ‘সুখী’। তা হলে চালচুলোর ঠিকঠিকানা না থাকা ‘পকেটবিহীন’ এসব মানুষের জীবনে সুখ বলতে কি কিছু নেই? আর যদি কিছু থেকেও থাকে, তা পরিমাপের মানদণ্ডই বা কী হতে পারে?
রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘জীবনের সুখ খুঁজিবার গিয়া জীবনের সুখ নাশা।’ তাহলে কি সুখের জন্য হাপিত্যেশ না করাও এক অর্থে ‘সুখে’ থাকা? প্রশ্নটা যতটা সহজে করা গেল, উত্তরটা হয়তো তত সহজে দেওয়া সম্ভব নয়।
গণমানুষের নজিরবিহীন অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের। ওই দিন সারা দেশের রাজপথে যেন জনজোয়ার নেমেছিল। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সেই উদ্যাপনে একজনকেও কি দেখে মনে হয়েছিল, তিনি ‘সুখী’ নন? কীসের প্রাপ্তিতে তাঁদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল অমন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস? এর উত্তর অজানা নয় কারও, স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তি, যার অপর নাম ‘স্বাধীনতার সুখ’। তাহলে বোঝা গেল, মানুষ শুধু ভাত-রুটিতে বাঁচে না। আরও কিছু লাগে—মানবিক মর্যাদা, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার। মনের খিদেও মেটাতে হয়।
‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ তৈরির ক্ষেত্রে এসবের কিছুই যে আমলে নেওয়া হয় না, তা কিন্তু নয়। সুখী দেশের তালিকা করার ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন, পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে শূন্য থেকে ১০ সূচকে নম্বর পরিমাপ করা হয়। এর সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয় প্রতিটি দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চর্চা, উদারতা, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রা।
ফিনল্যান্ডের বার বার সুখী দেশের শীর্ষ স্থানটি ধরে রাখার পেছনে হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির সুখবিষয়ক গবেষক জেনিফার ডি পাওলার বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ফিনল্যান্ডের মানুষের এতটা সুখী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ, প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন। এ ছাড়া ‘সফল জীবনের’ সংজ্ঞা নিয়ে তাঁদের অধিকতর বোঝাপড়াও সুখী হওয়ার একটি কারণ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। উদাহরণ হিসেবে এই গবেষক বলেন, যেখানে মার্কিন মুলুকে সাফল্যকে প্রায়ই অর্থনৈতিক অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেখানে ফিনল্যান্ডবাসী প্রাধান্য দেন কল্যাণমূলক সমাজ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর প্রতি আস্থা, ন্যূনতম মাত্রার দুর্নীতি, বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার ওপর।
২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ছিল ১২৯তম অবস্থানে। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এ অবস্থান ছিল ১১৮। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের অবনমন ঘটে ১১ ধাপ। তারও আগের বছর ২০২২ সালে বাংলাদেশ ছিল তালিকার ৯৪ নম্বরে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অবস্থান লাফিয়ে লাফিয়ে কমছিল।
অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের অবস্থান এবারের প্রতিবেদনে যা–ই থাকুক না কেন, দেশের মানুষ এখন গড়পড়তা অনেকটাই নির্ভার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, দেশের ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিজমের জগদ্দল পাথরটিকে তারা ঠেলে সরিয়ে দিতে পেরেছে। কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষের অসহিঞ্চুতা, ঠিক-বেঠিক নিয়ে সবক দেওয়ার অপচেষ্টা, নারীর প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ ‘নতুন স্বাধীনতা’র গায়ে কালোর ছিটা হয়ে লাগছে বটে; কিন্তু তা স্থায়ী হওয়ার নয়। কেননা, ময়লা ধুয়ে সাফসুতরো করার মানুষই এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এ বছর বিশ্ব সুখ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কেয়ারিং অ্যান্ড শেয়ারিং’। অর্থাৎ সুখের স্থায়িত্ব আসে একে অপরের প্রতি যত্নশীল হওয়া থেকে, একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বোধ থেকে। মানুষের যূথবদ্ধ তথা সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার ধারণাকেই আরেক দফা পোক্ত করে এবারের প্রতিপাদ্য।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে ঢুকে পড়েছে বিশ্ব। এরপর কি সুখের সংজ্ঞাও বদলাবে? কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা ছিল এআইয়ের কাছে। উত্তর দিল, ‘সুখ হলো ভালো থাকার এমন এক অবস্থা যা ইতিবাচক আবেগ, তৃপ্তি ও জীবনের সঙ্গে সন্তুষ্টির অনুভূতির যোগফল।’ অর্থাৎ সময়ের নিয়মে সময় বদলাবে, কিন্তু পানি কখনো ওপর দিকে গড়াবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবস থ ন জ বন র হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।
অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।