১৯৭১ সালের ২২ মার্চের সমাবেশটি কেন ‘অনন্য’
Published: 22nd, March 2025 GMT
১৯৭১ সালের ১ মার্চে সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনের আনুগত্য কমতে থাকে। একই অবস্থা সামরিক বাহিনীতেও লক্ষ করা যায়। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকেরাও শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দেন।
তৎকালীন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড বইয়ে তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ সময়ে খুব উল্লেখযোগ্য ও উদ্বেগজনক অবস্থা পরিলক্ষিত হয়, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের আনুগত্য সন্দেহের চোখে দেখা হতে থাকে। এ সময়ে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা ঘন ঘন বৈঠকে মিলিত হতে থাকেন। উদ্দেশ্য, সাংবিধানিকভাবে সমস্যার সমাধান না হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি।’
২ মার্চ শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, ‘এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীসহ প্রত্যেক বাঙালির পবিত্র কর্তব্য হচ্ছে গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা না করা। অধিকন্তু তাদের উচিত সবটুকু শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া।’ [হাসান হাফিজুর রহমান (২য় খণ্ড)]
এই নির্দেশের পর পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় কর্মরত বেসামরিক বঙালি কর্মচারীরা অসহযোগ আন্দোলনে শরিক হন এবং তাঁরা কর্মবিরতি পালন করতে শুরু করেন। ১৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক বাঙালি কর্মচারীদের ১৫ মার্চের মধ্যে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয় যে আদেশ অমান্য করলে তাঁদের ছাঁটাই করা হবে, এমনকি ১০ বছরের কারাদণ্ডও দেওয়া হতে পারে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাঙালি কর্মচারীরা এ আদেশ অমান্য করেন। অর্ডন্যান্স ডিপো কর্মচারী ইউনিয়নের মুখপাত্র জানান, ‘গতকাল (১৫ মার্চ) সামরিক বিভাগের অধীনস্থ প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক কর্মচারীর মধ্যে কেউই কাজে যোগদান করেননি।’ (ইত্তেফাক, ১৬ মার্চ ১৯৭১)
সেনাবাহিনীর তৎকালীন ১৪ ডিভিশনের জিওসি খাদিম হোসেন রাজা আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি বইয়ে বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানিরা সকল স্থানীয় প্রশাসনিক সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়। এমনকি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস এবং ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের (বেসামরিক) স্টাফরা কাজ বন্ধ করে দেয়।’
কারা ছিলেন আয়োজকঅসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সামরিক বাহিনীর বেসামরিক কর্মচারীদের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত বা প্রাক্তন সৈনিকেরা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে অংশ নিতেন। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকেরা এককভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে গণমাধ্যমে বিবৃতির মাধ্যমে আন্দোলনের সপক্ষে সমর্থন প্রদান করেন। কখনো কখনো সৈনিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সভার আয়োজন করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৈনিকেরা স্বাধীনতার দাবি জানান। তাঁদের অনেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য অনুরোধ করেন।
■ সমাবেশটি আয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও সৈনিকেরা বিভিন্নভাবে তত্পরতা চালান। ■ পাকিস্তানিরা মনে করে যে বাঙালি সৈনিকেরা সামরিক প্রস্তুতি নিলে তা তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।১৯৭১ সালের ২২ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন প্রাক্তন সৈনিক সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বেলা তিনটায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ছুটিতে থাকা অনেক চাকরিরত সৈনিকও পরিচয় গোপন রেখে সমাবেশে অংশ নেন।
২১ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গিয়েছিল, ২০ মার্চ প্রাক্তন সৈনিকদের কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ জে এম খলিলুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন যে ২২ মার্চ বেলা তিনটায় বায়তুল মোকাররমে প্রাক্তন সৈনিকদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। (দ্য পিপল, ২১ মার্চ ১৯৭১)। অপর একটি পত্রিকা উল্লেখ করে, সভায় সভাপতিত্ব করবেন মেজর জেনারেল (অব.
সমাবেশটি আয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা বিভিন্নভাবে তত্পরতা চালান। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য উত্সাহিত করেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ রেজা একাত্তরের স্মৃতিচারণ বইয়ে বলেন, ‘২২শে মার্চ সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের বিরাট সমাবেশ হলো বায়তুল মোকাররামের সামনে। এই সমাবেশে নেতৃত্ব দিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ ও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী। সমাবেশের ব্যবস্থাপনায় অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইং অফিসার আলমের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলো। জনাব আলম তখন ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা অফিসার। বস্তুত তাঁরই অক্লান্ত একক প্রচেষ্টায় এই সমাবেশ সফল হয়েছিলো। ২৫শে মার্চ রাতেই তিনি নিহত হন পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে।’
২২ মার্চের সমাবেশ সম্পর্কে দৈনিক পাকিস্তান উল্লেখ করে, ‘প্রতিদিনের অসংখ্য সমাবেশের স্মৃতিবাহী বায়তুল মোকাররমে গতকাল (২২ মার্চ) সোমবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এক অনন্য অনুষ্ঠান। অন্য সব সভা অন্য সব অনুষ্ঠান থেকে এই সমাবেশ ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ সমাবেশ ছিল অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্যময়। এই একটি সমাবেশ এবং সমাবেশ শেষে একটি মিছিল যেন এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল গতকাল ঢাকাবাসীদের মনে। এক একটি সমাবেশ যেন তাদের হৃদয়ে সঞ্চার করেছিল এক দুর্দমনীয় সংগ্রামী প্রেরণা। হাজার হাজার মানুষ কাল ছুটে এসেছিল এই সমাবেশ এই মিছিলের আকর্ষণে। এই একটি সমাবেশ, এই একটি মিছিল যেন ছিল ঢাকাবাসীদের বহু আকাঙ্ক্ষিত। এই সমাবেশ ও মিছিলটি ছিল প্রাক্তন সৈনিকদের, স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের মিলিত সমাবেশ ও মিছিল।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ২৩ মার্চ ১৯৭১)
লে. কমান্ডার জয়নাল আবেদীন সমাবেশের উপস্থিতি সম্পর্কে উল্লেখ করেন, ‘১৯৭১ সালের ২২শে মার্চ প্রায় ঊনসত্তর জন সাহসী ও নির্ভীক অফিসার ও সাবেক সতেরো হাজার কর্মচারী নিয়ে বায়তুল মোকাররমে মিছিল বের করি।’ (দৈনিক বাংলা, ২৩ মার্চ ১৯৭৫)
সমাবেশের বক্তব্যওই সভায় সভাপতিত্ব করেন মেজর জেনারেল (অব.) ইসফাকুল মজিদ। সভা পরিচালনা করেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। ‘জয় বাংলা’ সংগীতের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হয়। এ সময় সমবেত সৈনিকেরা ‘অ্যাটেনশন’ বা ‘সাবধানে’ দাঁড়িয়ে থাকেন। সভায় বক্তৃতা করেন কমান্ডার শাহাবুদ্দিন, মেজর খাজা হাসান আসকারী, মেজর শফিউল্লাহ, লে. কমান্ডার ইমাম হোসেন, মেজর আফসারউদ্দিন, মেজর জামাল আতহার, লে. কমান্ডার ফারুক, লে. কমান্ডার জয়নাল আবেদীন, ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট খলিলুল্লাহ, ক্যাপ্টেন আহসানউদ্দিন, করপোরাল মাহমুদুন্নবী প্রমুখ। প্রাক্তন সৈনিকদের কথা শোনার জন্য বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে বিপুল জনসমাগম হয়।
সভাপতির ভাষণ সম্পর্কে পত্রিকায় উল্লেখ ছিল, ‘সভাপতির ভাষণে মেজর জেনারেল মজিদ বলেন, “আমরা সৈনিক। কথার চাইতে কাজে বেশি বিশ্বাস করি”। তিনি আরও বলেন যে, “বাংলার মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত যে কোনো মানুষের সহিত প্রাক্তন সৈনিকেরা কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সংগ্রাম করিয়া যাইবে”।’(আজাদ, ২৩ মার্চ ১৯৭১)
কর্নেল ওসমানী তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে দেশ ও জাতির প্রতি এই প্রাক্তন সৈনিকদের যথেষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তিনি তাঁদের প্রতি বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। (দৈনিক পাকিস্তান, ২৩ মার্চ ১৯৭১)
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট খলিলুল্লাহ বলেন, ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা সৈনিক। শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে আমরা বিশ্বাসী।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় রহিয়াছি। একবার নির্দেশ লাভ করিলে কি করিয়া স্বাধীনতা অর্জন করিতে হয় তাহা আমরা জানি।’ (আজাদ, ২৩ মার্চ ১৯৭১)
সমাবেশে সৈনিকেরা অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিকে সর্বাত্মকভাবে সফল করে তোলা এবং দেশের আসন্ন স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য শপথ গ্রহণ করেন। যাঁরা এই সমাবেশে আসতে পারেননি, সভা থেকে তাঁদেরও আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সভা শেষে সৈনিকেরা ব্যান্ডের তালে তালে কুচকাওয়াজ করে শহীদ মিনারে যান। সৈনিকদের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল মজিদ শহীদ মিনারে পূর্ণ সামরিক কায়দায় পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।
সৈনিকেরা যান মুজিবের বাড়িশহীদ মিনারে কর্নেল ওসমানী বক্তব্য দেওয়ার পর স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদানের জন্য রক্তশপথের অঙ্গীকারনামা পাঠ করেন। তারপর সৈনিকেরা মিছিল করে শেখ মুজিবের বাড়িতে যান। সৈনিকদের মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন মেজর জেনারেল মজিদ ও কর্নেল ওসমানী। বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু করে শেখ মুজিবের বাসভবন পর্যন্ত সারাটি পথে তাঁরা রাস্তার দুই পাশে উদ্বেলিত জনতার হর্ষধ্বনি ও করতালি লাভ করেন।
সৈনিকদের মিছিল শেখ মুজিবের বাড়ির গেটে এসে পৌঁছালে তিনি তাঁদের স্বাগত জানান। সেখান থেকে মেজর জেনারেল মজিদ, কর্নেল ওসমানীসহ চারজন বাড়ির ভেতরে যান এবং তাঁর লাইব্রেরিতে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। প্রতিনিধিদল অসহযোগ আন্দোলনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করে। বৈঠককালে মেজর জেনারেল মজিদ বঙ্গবন্ধুর হাতে সংগ্রাম, শক্তি ও আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে একটি তরবারি তুলে দেন। শেখ মুজিব সসম্মান চুম্বনের মাধ্যমে তরবারিটি গ্রহণ করেন। (আজাদ, ২২ মার্চ ১৯৭১)
সমাবেশের প্রতিক্রিয়া২৪ মার্চ সৈনিকদের সমাবেশকে উপলক্ষ করে ইত্তেফাক পত্রিকা ‘“প্রাক্তন” সৈনিকদের একাত্মতা’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ ছিল, ‘গত পরশু (২২ মার্চ) “বায়তুল মোকাররম” প্রাঙ্গণে প্রাক্তন স্থলসেনা, নাবিক ও বৈমানিকদের এক সমাবেশে সাবেক সৈনিকেরা সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধিকার সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁহারা বলেন, আমরা প্রাক্তন সৈনিকগণ আজ আর “প্রাক্তন” হিসাবে বসিয়া থাকিতে পারি না।
‘সত্য সত্যই আজিকার এই সর্বাত্মক সংগ্রামে “সাবেক” বা “প্রাক্তন” বলিয়া কাহারও আর অবসর যাপনের সুযোগ নাই। সকল শ্রেণীর মানুষ ক্ষেত-খামার, শিল্প-শিক্ষায়তন, বাজার, বিপণী-অফিস-আদালত হইতে রাজপথে নামিয়া আসিয়া পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সমতালে অগ্রসর হইতেছে। দুই-চারিটা ডিভিশন লইয়া এই বাহিনী নয়, সারা বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ লইয়া এই গণ-বাহিনী। প্রাক্তন সৈনিকরাও সামাজিক শ্রেণীগত বৈষম্য বা দলগত বিভিন্নতা বিসর্জন দিয়া এক কাতারে শামিল হইয়াছেন এবং বৃহত্তর জনসমষ্টির সহিত একাত্মতা ঘোষণা করিয়াছেন, ইহা সত্য সত্যই সকল সংগ্রামী পক্ষেই একটি প্রেরণার বিষয়।’ (ইত্তেফাক, ২৪ মার্চ ১৯৭১)
২২ মার্চের সৈনিক সমাবেশ পাকিস্তানিদের বেশ ভাবিয়ে তোলে। তারা মনে করে যে বাঙালি সৈনিকেরা সামরিক প্রস্তুতি নিলে তা তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এবং তাদের আক্রমণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সমাবেশটি সংগঠনে সহায়তা করার জন্য তারা চট্টগ্রামের ইবিআরসির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে সন্দেহ করে। ক্যাপ্টেন (পরে মেজর জেনারেল) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন বইয়ে বলেন, ‘ঢাকায় প্রাক্তন সেনাদের সমাবেশ হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের ওপর শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করে। তারা ধারণা করে প্রাক্তন সেনাদের সমবেত করার পিছনে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের হাত আছে। প্রাক্তন সেনাদের একটি তালিকা রেকর্ড অফিস থেকে তিনি নিয়েছেন। আর ফেরত দেননি। এটা বোধ হয় পাকিস্তানিরা জেনে ফেলে। ফলে তাঁর উপর পাকিস্তানের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে থাকে।’
পাকিস্তানিদের এই শঙ্কা গবেষক রিচার্ড সিজন ও লিও ই রোজের গবেষণায়ও উদ্ঘাটিত হয়েছে। তাঁরা উল্লেখ করেন, প্রাক্তন সৈনিকদের একটি সভা সেনা কর্তৃপক্ষের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়ে, সেখানে দুজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি অফিসার, মেজর জেনারেল এম ইউ (এম আই হবে) মাজিদ ও কর্নেল এম এ জি ওসমানী ভাষণ দেন। তাঁরা বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থন জানান এবং মুজিবের আশীর্বাদের জন্য মিছিলসহ তাঁর ধানমন্ডির বাসায় যান।
এই সমাবেশের পর পাকিস্তানি বাহিনী ২৩ মার্চের মধ্যে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে এবং ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
●মুহাম্মদ লুৎফুল হক গবেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবসরপ র প ত স ন ক ১৯৭১ স ল র কম ন ড র ২২ ম র চ স ব ধ নত ন কর ন অন ষ ঠ অফ স র র জন য ই একট গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
শিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয় কাউকে কাউকে আনন্দিত করেছে, কাউকে শঙ্কিত বা চিন্তিত করেছে। তবে প্রায় সবাইকে অবাক করেছে। অবাক হওয়ারই কথা। কারণ, কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ছাত্র সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় দিতে পারত না, তাদের এ ধরনের জয় বিস্মিত করার মতো ব্যাপার বৈকি।
এই ফল দেখে কিছু মানুষ এ কারণে খুশি যে কয়েক দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দলের একচেটিয়া আধিপত্য শেষ হয়ে গেল। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, ছাত্রশিবিরের এ জয়ে অনেকে কেন শঙ্কিত বা চিন্তিত?
সম্ভবত এর প্রধান কারণ ছাত্রশিবির জামায়াতে ইসলামীর একটি অঙ্গসংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জামায়াত একটি প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক দল। ১৯৭১ সালে তাঁরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেই ছিল না, দলটি ছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সমর্থনপুষ্ট। দলটি কেবল মৌখিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়নি, ইতিহাস বলে, তারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে গণহত্যায় সহায়তা করেছিল।
আরও পড়ুনশিবিরের বিজয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কি নতুন ধারার সূচনা হলো১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫এ কারণে তাদের বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিবর্জিত করা একটি স্বাধীন দেশের পক্ষে খুব স্বাভাবিক ছিল। তাই এ দেশে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতার পর অন্তত প্রথম কয়েক বছর রাজনীতি করতে পারেনি। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর পটপরিবর্তন হতে শুরু করে। কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভাব সেই পরিবর্তনকে আরও বেগবান করে।
মূলত জিয়াউর রহমান নতুন দল সৃষ্টির জন্য একটি বিরাট জাল ফেলেছিলেন এবং সেই দলে সব মতের লোকদের অন্তর্ভুক্তি এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিল। তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাঁর নতুন দলে এমন ব্যক্তিদের এনেছিলেন, যাঁরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের সাফাই গাওয়ার জন্য। এই আজিজুর রহমানকে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানান।
জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিজয়ীদের উচ্ছ্বাস। এখানেও শিবিরের বড় সাফল্য অর্জিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩ সেপ্টেম্বর