চোরাচালানিদের হটস্পট হয়ে উঠেছে সিলেটের সীমান্ত এলাকা। বিজিবি ও পুলিশের কড়াকড়ি অভিযানেও থামছে না চোরাচালান। ফলে সিলেটের ঈদের বাজার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে ভারতীয় পণ্য। প্রায়ই অভিযানে চোরাই পণ্য জব্দ হচ্ছে। এর চেয়ে কয়েকগুণ চোরাই পণ্য চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। এ অবস্থায় ঈদ সামনে রেখে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আছেন দুশ্চিন্তায়। অভিযানে যারা ধরা পড়ছে, তারা বাহক মাত্র। হোতারা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। এতে বিজিবির অভিযান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাত হলেই সরব হয়ে ওঠে সীমান্ত এলাকা। মাদক, চিনি, কাপড়, কসমেটিকস পণ্যসহ বিভিন্ন সামগ্রী আনা-নেওয়া শুরু হয় সিলেট বিভাগের প্রতিটি সীমান্ত দিয়ে। চার জেলাতে হয় এ চোরাচালান। সীমান্তের এপার-ওপারে রয়েছে চোরাচালানের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মূলত সিন্ডিকেট সদস্যদের তথ্যমতে চলে চোরাচালান। কখন কে ডিউটিতে আছে, কীভাবে চালান পার হবে– সবকিছু সিন্ডিকেট থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সীমান্তের আশপাশে চোরাচালানিরা ব্যবহার করে উভয় দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক।
জানা গেছে, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট সীমান্তে মূলত চোরাচালানিরা সক্রিয়। ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়াদের সিন্ডিকেট, আর এপারে দেশীয় সিন্ডিকেট। তাদের কেউ কেউ ওপারে টাকা পাঠানোর দায়িত্বে নিয়োজিত, আবার কেউ কেউ দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ম্যানেজের দায়িত্বে রয়েছেন। আরেকটি পক্ষ রয়েছে পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজের দায়িত্বে। তারা ভারত থেকে গরু, মহিষ, শাড়ি, থান কাপড়, কসমেটিকস, গরম মসলা, চিনি, কমলা, আপেল, সুপারিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আসে। বিশেষ করে ঈদ সামনে রেখে চোরাচালান বেড়েছে কয়েকগুণ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সিলেটে জব্দ হয়েছে ৬০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের চোরাই পণ্য। আর শুধু মার্চেই জব্দ হয়েছে একই পরিমাণ পণ্য। এভাবে চললে চলতি বছর জব্দের পরিমাণ গত বছরকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৪ সালে জব্দ হয় ১৫৬ কোটি টাকার পণ্য। এটি এক বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড। অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসে জব্দ হয়েছে ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকার পণ্য। গেল চার মাসে শুধু শাহপরাণ থানায় ১৭ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য উদ্ধার হয় বলে জানান শাহপরাণ মাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই সানাউল হক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঈদে সিলেটের বাজারে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে সীমান্তে চোরাচালান বেড়ে যায়। সিলেটের বিভিন্ন মার্কেটের শোরুমে এখন থরে থরে সাজানো ভারতীয় পণ্য। চোরাই কারবারে লেনদেন হুন্ডির মাধ্যমে হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, সীমান্তের ওপারে রয়েছে ভারতীয় খাসিয়াদের সুপারি বাগান ছাড়াও বিভিন্ন ফলের বাগান। বিএসএফ-বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে ব্যবহার করা হয় এসব বাগান। এগুলো সীমান্তের লাগোয়া হওয়ায় অনেক সময় সীমান্তরক্ষীদের কিছুই করার থাকে না। ভারত থেকে এক বস্তা পণ্য নিয়ে এলে বাহক পায় ৫০০ টাকা। ভারতীয় খাসিয়া ও বাংলাদেশি কারবারি মিলে চালান আনা-নেওয়ার কাজ করে।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে নিয়ে আসা পণ্য বাংলাদেশে দ্বিগুণ লাভে বিক্রি করতে পারে চোরাকারবারিরা। এ ছাড়া চোরাচালানের পণ্যের মূল্য ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব।
চোরাচালান রোধে সীমান্তে বিজিবির টহল আরও জোরদার করা দরকার বলে মনে করেন সিলেট জেলা সুজন সভাপতি ও সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রশাসক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী।
বিজিবি সিলেট সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে চোরাচালানিরা গরু, মহিষ ও অন্যান্য সামগ্রী বাদ দিয়ে শাড়ি, থ্রিপিস আনছে। সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু লোক পেশা হিসেবে চোরাচালানকে বেছে নিয়েছে। হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, কোনোভাবেই যেন বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আসতে না পারে। এজন্য তিন সেক্টরের ৫৫টি ভিওপিতে জনবল বাড়ানো হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঈদ ব জ র
এছাড়াও পড়ুন:
বাণিজ্যবিরোধ: ভারত কেন ট্রাম্পের নিশানায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের বাণিজ্যনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় পণ্যের ওপর হোয়াইট হাউসের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তুতি নেওয়ার পর থেকেই এ আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে এবং এর পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাম্প যখন বিশ্বের বহু দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছিলেন, তখনই ভারতকে উদ্দেশ করে তাঁর এমন কঠোর অবস্থান সামনে উঠে আসে।
হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
‘ভারতের শুল্ক বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ’, গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জবাবে ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা ট্রাম্পের বক্তব্য ‘লক্ষ্য করেছে’ এবং এর ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যবিরোধ: পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে
আজ থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ধার্য করা ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ঘোষিত সম্ভাব্য শুল্ক থেকে মাত্র ১ শতাংশ কম।
এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ শুল্কের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশ শুল্কের চেয়ে কিছুটা কম।
হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।এ শুল্ক ভারতের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা আরও জটিল করে তুলতে পারে। একাধিক দফা আলোচনার মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া অনেক কোম্পানির নতুন গন্তব্য হয়েছে দেশটি। মে মাসে অ্যাপলের সিইও টিম কুক জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য আইফোন এখন ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে; যাতে উচ্চ শুল্ক এড়ানো যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের (ওটিআর) তথ্যমতে, গত বছর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৯ বিলিয়ন (১২ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার। ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক, রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি ও কৃষিপণ্য।
ট্রাম্প কেন ভারতকে নিশানা করছেন
সম্প্রতি ট্রাম্প একাধিকবার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভারতের ‘অতি উচ্চ’ শুল্ক আরোপের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যও রয়েছে।
বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘বছরের পর বছর আমরা ভারতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, তাদের শুল্ক অত্যন্ত বেশি।’
এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্টদেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে ভারত কিছু পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করেছে।
ওটিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পণ্যবাণিজ্যে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের ঘাটতি দেখেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। তুলনামূলকভাবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন (২৯ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের বাণিজ্যঘাটতিতে ছিল।
আরও পড়ুনভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা, ইরানের পণ্যের বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ ৩১ জুলাই ২০২৫ট্রাম্প আরও ক্ষুব্ধ যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।
‘এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা’, বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ট্রাম্প।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত সরকার ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে তুলনামূলকভাবে মৃদু, তবে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
ভারতের ওপর ধার্য করা শুল্কহার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম।বুধবার দেওয়া এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিকভাবে লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’
আগস্টের শেষ দিকে দুই দেশের মধ্যে আরেক দফা বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুনভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আলাদা ‘দণ্ড’৩০ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্কে ভারতের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কী বলছেন অর্থনীতিবিদেরা১৪ ঘণ্টা আগে