তামিম রক্ষা পেলেন, আমাদের করণীয় কী
Published: 25th, March 2025 GMT
বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল খেলার মাঠে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারকা এই ক্রিকেটারের জন্য হেলিকপ্টার আনা হলো। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। নিকটস্থ কেপিজে ফজিলাতুন্নেছা বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কার্ডিয়াক টিম তাঁকে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে পরবর্তী সময়ে হার্টে দুটি রিং পরায়।
আমি নিজে চিকিৎসক। বর্ণনা থেকে বুঝলাম, তামিম ইকবাল ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক বা অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে যে চিকিৎসাটি প্রদান করা হয়েছে, চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় তাকে বলা হয় প্রাইমারি পিসিআই। এতে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ে বিশেষায়িত ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে অ্যানজিওগ্রাম করে কালপ্রিট ভ্যাসেল, মানে আক্রান্ত রক্তনালিতে রিং বা স্টেন্ট পরিয়ে দেওয়া হয়।
উন্নত বিশ্বের এ চিকিৎসাটি এখন বাংলাদেশে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। এই প্রাইমারি পিসিআইয়ের মাঝখানে তামিম ইকবালকে লম্বা সময় সিপিআর, মানে বুকে চাপ দিয়ে হার্টের কার্যকারিতা চালু করার চিকিৎসাসহ ডিসি শক দিয়ে তাঁর বন্ধ হয়ে যাওয়া হার্টকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ক্রিকেট তারকা। তবে তিনি এখনো সংকটমুক্ত নন।
বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে, যেখানে হৃদ্রোগের সব চিকিৎসা ও সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। একসময় একটা অ্যানজিওগ্রাম করার জন্য অন্তত পাশের দেশ ভারতে যেতে হতো।একজন তারকা ক্রিকেটার হওয়ার সুবাদে এবং কেপিজে হাসপাতালে কার্ডিয়াক সুবিধা থাকার কারণে হয়তো তামিম দ্রুততম সময়ে এই উন্নত চিকিৎসা পেয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেন। গর্বের কথা বলি। যে প্রাইমারি পিসিআই চিকিৎসাটি বাংলাদেশে তামিমের ক্ষেত্রে সফলভাবে দেওয়া হয়েছে, ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো উন্নত দেশে কোনো খেলোয়াড় এ রকম অসুস্থ হলেও সেই একই চিকিৎসা তাঁদের দেওয়া হবে। অর্থাৎ হৃদ্রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন গর্ব করতে পারে। তামিমের সফল চিকিৎসার এ ঘটনা বাংলাদেশের চিকিৎসার আধুনিকায়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন দেবী শেঠি বাংলাদেশে এসে এ দেশের হৃদ্রোগ চিকিৎসার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তামিম ইকবাল একজন ভিআইপি। তাই দ্রুততম সময়ে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পেয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। একজন সাধারণ মানুষের হার্ট অ্যাটাক হলে তিনি কোথায় যাবেন? কী চিকিৎসা নেবেন? তাঁদের জন্য তো আর হেলিকপ্টার চলে আসবে না।
এ ক্ষেত্রেও ভালো সংবাদ আছে। বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে, যেখানে হৃদ্রোগের সব চিকিৎসা ও সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। একসময় একটা অ্যানজিওগ্রাম করার জন্য অন্তত পাশের দেশ ভারতে যেতে হতো। অথচ আজ বাংলাদেশে অ্যানজিওগ্রাম, অ্যানজিপ্লাস্টি (রিং পরানো), বাইপাস সার্জারি, ভাল্ভ সার্জারি, এমনকি বুক না কেটে মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি সফলতার সঙ্গে প্রতিদিন সম্পন্ন হচ্ছে।
তবু আকস্মিক মৃত্যু থেমে নেই। এর একমাত্র কারণ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। হৃদ্রোগে আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদ্রোগে মারা যান, যার ৫৪ শতাংশের জন্য উচ্চ রক্তচাপ দায়ী। এ ছাড়া তামাক ব্যবহার ও বায়ুদূষণ হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদ্রোগে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে তামাকের কারণে হৃদ্রোগে বছরে ১৯ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
বুকে ব্যথা, চোয়ালে ব্যথা, ঘাম হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, অবসন্নতার মতো উপসর্গ বা কোনো উপসর্গ ছাড়াই আকস্মিক হার্ট বিকল হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। হার্টের অসুখ নিয়ে অনেক রোগী হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। পথিমধ্যেই মারা যায়। তাহলে এ রকম পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
বুকে ব্যথা হলে গ্যাসের ব্যথা ভেবে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে হৃদ্রোগের সব সাপোর্ট আছে, এমন হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। ঢাকার বাইরে কিছু কিছু বিভাগীয় শহরে ক্যাথল্যাব ও কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা আছে। বাংলাদেশে বেসরকারি হেলিকপ্টার যৌক্তিক মূল্যে অত্যন্ত সহজলভ্য। মনে রাখতে হবে, হার্টের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বুকে ব্যথা নিয়ে সঠিক সময়ে কোনো কার্ডিয়াক হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি।
তাহলে করণীয় কী? উত্তর একটাই, নিয়মিত হেলথ চেকআপ। আপনার দেহে উপসর্গ থাকুক আর না থাকুক, বছরে কমপক্ষে দুবার হেলথ চেকআপ করতে হবে। এ ছাড়া সুষম খাদ্যাভ্যাস, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস, ওজন কমানো, ধূমপান ও তামাকজাতীয় পণ্য বর্জনের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। আর দরকার এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড।
ডা.
আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ততম সময় ত ম ম ইকব ল র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।
নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
প্রামাণিক উৎসমহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।
সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।
মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।
হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।
এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।
এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতিমহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)
সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)
তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)
তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)
আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদামহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।
আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)
আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।
তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)
তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।
তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)
হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথামহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।
মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।
সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে