ঘরে বসে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ কাজ তরুণ প্রজন্মের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। একসময় শীর্ষ ৩-এ থাকলেও সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, এ খাতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।  মার্কিন সাময়িকী সিইওওয়ার্ল্ড গত বছরের ১৯ এপ্রিল ফ্রিল্যান্স কাজের জন্য সেরা ৩০টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে বাংলাদেশ ছিল ২৯তম অবস্থানে। তালিকায় শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। বাংলাদেশ থেকে ভালো অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া। এমনকি আমাদের থেকে নানা সূচকে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানও আমাদের ওপরে রয়েছে।

২০১০ সালের দিকে ফ্রিল্যান্সিং কাজের জনপ্রিয় একটি প্ল্যাটফর্মের তালিকায় আউটসোর্সিংয়ে ঢাকা তৃতীয় শীর্ষ নগরী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপরই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’-এ নজর দেয়। বিগত সরকার নানা চটকদার নামে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার নাম করে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সরকারের আইসিটি বিভাগ– বাড়ি বসে বড়লোক, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং, ফিল্যান্সার টু এন্টারপ্রেনিউর, মোবাইল অ্যাপস প্রশিক্ষক ও সৃজনশীল অ্যাপস উন্নয়ন, হাইটেক পার্কের অধীনে বিভিন্ন ধরনের আইটি প্রশিক্ষণ, নারীর দক্ষতা উন্নয়নে হার পাওয়ার, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লেভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্সসহ অগণিত প্রকল্প হাতে নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ও স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেপ) প্রকল্পের আওতায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। এর পর ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণে যুক্ত হয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরও ‘শিক্ষিত কর্মপ্রত্যাশী যুবদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে এ খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির সুযোগ ছিল। কিন্তু তা সেভাবে কাজে লাগানো যায়নি।

ঢাকঢোল পিটিয়ে আইসিটি বিভাগ এ খাত থেকে ২০১৮ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিল; ২০২৫ সালে এসেও সেটি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। আইসিটি খাত থেকে আয়ের অঙ্ক দুই বিলিয়ন ডলারও ছাড়ানো যায়নি। দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা প্রকট। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, দেশে বর্তমানে ৭ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে রয়েছে। এর মধ্যে ২৬ লাখ মানুষ বেকার। ২৪ লাখ মানুষ প্রতিবছর চাকরির বাজারে ঢুকছে। স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস)-২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা ১ কোটি ২৯ লাখ তরুণ এখন নিষ্ক্রিয়। মানে তারা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই; এমনকি কোনো প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। বিবিএস নিষ্ক্রিয় তরুণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ধরেছে ১৫ থেকে ২৪ বছর (প্রথম আলো, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। দেশের তরুণ সমাজের বড় অংশ বেকার। হতাশায় ডুবন্ত এসব তরুণের জন্য সত্যিকার অর্থে নিদান হতে পারে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং। 
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের বেকার তরুণদের কথা ভাবতেই হবে। এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি গড়ায় নজর দিতে হবে। আইসিটিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি তৈরির পুরো কার্যক্রমকে একটি ছাতার নিচে আনতে হবে। আইসিটি বিভাগের আওতায় প্রশিক্ষণ-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অথরিটি/সংস্থা চালু করা জরুরি। এ সংস্থাটির কাছে থাকতে হবে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর পুরো ডেটাবেজ। নিবন্ধনের জন্য আইসিটি বিভাগের ‘প্রশিক্ষণ বাতায়ন’ নামে প্ল্যাটফর্ম থাকলেও তেমন হালানাগাদ তথ্য নেই। এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম কার্যকর থাকলে দক্ষ ব্যক্তি নিবন্ধন করতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একাধিক ট্রেনিংয়ে যুক্ত হতে পারবেন না। এতে ট্রেনিং কোম্পানির ফাঁকিবাজি বন্ধ হবে। আবার কতসংখ্যক তরুণ প্রশিক্ষণ নিল, তারা কোথায় কী করছে, তাও এখান থেকে জানা যাবে। 

যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বছরের পর বছর দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে আসছে, এ রকম প্রশিক্ষণদাতা প্রফেশনাল কোম্পানিগুলোকে কাজ দিতে হবে। তাতে এসব প্রতিষ্ঠান যেমন দক্ষ ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তেমনি দক্ষ জনশক্তি গড়তেও তারা ভূমিকা রাখতে পারবে। জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে দক্ষ কোম্পানির সঙ্গে রাজনৈতিকসহ নানা বিবেচনায় অদক্ষ কোম্পানির যুক্ত হওয়া কীভাবে ঠেকানো যায়, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। কোম্পানির হাতে যখন কাজ থাকবে তখন তারা বাজার থেকে যোগ্য কর্মী খুঁজে নেবে। না পেলে নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তুলবে। কাজ আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। সরকারের বিনামূল্যে ট্রেনিং দেওয়ার কাজটি যারা পাবে তাদের কার্যক্রম কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে, যেন কোনোভাবেই এ ট্রেনিং নামকাওয়াস্তে না হয়। 

দেশের তরুণ সমাজের কাছে ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ যেন আলাদিনের চেরাগ। সরকারি-বেসরকারিভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ বিষয়টিকে এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে, যেন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর টুকটাক প্রশিক্ষণ নিলেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার পকেটে পুরতে পারবে। কিছু অসৎ প্রতিষ্ঠান এ রকম প্রলোভন দেখিয়ে উল্টো প্রতারণা করছে। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সরকারকে কঠোর হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তি দিতে এর চেয়ে ভালো আর সহজ বিকল্প এই সময়ে কিছু আছে বলে মনে হয় না। তরুণ প্রজেন্মের কথা মাথায় রেখে এ খাতে দক্ষ কর্মী তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকার মনোযোগী হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।

হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.

com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ফ র ল য ন স আউটস র স প রকল প র জন য সরক র আইস ট

এছাড়াও পড়ুন:

হাদিকে গুলিবর্ষণের নিন্দা, সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি মির্জা ফখরুলের

ঢাকায় সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে আসন্ন নির্বাচনে সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আজ শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে ওসমান হাদিকে গুলি করার পর বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে এ আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল। বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘অবিলম্বে প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করে নিয়ে আইনের আওতায় আনার জন্য দাবি জানাচ্ছি এবং এই সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, অবিলম্বে সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।’

জুলাই অভ্যুত্থানের পর গড়ে ওঠা আলোচিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হাদি ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রচার চালাচ্ছেন। আজ দুপুরে বিজয়নগরে একটি মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তি তাঁকে গুলি করে পালিয়ে যায়। হাদি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছেন।

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন রেখে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিনই এই হামলাকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র মনে করছেন বিএনপির নেতারা।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি একটা অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি যে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য সেই শক্তি আবার চক্রান্ত শুরু করেছে। কিছুদিন আগে দেখেছেন, চট্টগ্রামে আমাদের একজন ক্যান্ডিডেটকে গুলি করেছিল।’

নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে সন্ত্রাসমুক্ত করতে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা মনে করি যে এটা চক্রান্তের অংশ। এটাকে এখনই বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

সম্ভাব্য প্রার্থী হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামীকাল শনিবার সারা দেশে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন বলেও জানান মির্জা ফখরুল।

আমি একটা অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি যে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য সেই শক্তি আবার চক্রান্ত শুরু করেছে। কিছুদিন আগে দেখেছেন, চট্টগ্রামে আমাদের একজন ক্যান্ডিডেটকে গুলি করেছিল। —মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

নির্বাচনের পর একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের কমিটমেন্ট আছে যে এই নির্বাচন এবং নির্বাচনের পরে আমরা সকল দলকে নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করব, সে ব্যাপারে আমাদের কমিটমেন্ট শক্তিশালী রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিকেই রায় দেবেন। এখানে আমরা মনে করি উগ্রতার স্থান থাকবে না।’

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভাসানী জনশক্তি পার্টি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব।

মির্জা ফখরুল মাওলানা ভাসানীকে স্মরণ করে বলেন, ‘মাওলানা ভাসানীর নাম বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা—এক অনন্য রাজনৈতিক চরিত্র। ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে তিনি কোনো বিভেদ দেখেননি। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্র।’

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাবলু। বক্তব্য দেন দলটির মহাসচিব আবু ইউসুফ সেলিমসহ অন্য নেতারা।

আরও পড়ুনওসমান হাদি ‘লাইফ সাপোর্টে’: ঢাকা মেডিকেলের পরিচালকের দপ্তর২ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনদেশ অত্যন্ত সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে: তারেক রহমান১০ মিনিট আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাদিকে গুলিবর্ষণের নিন্দা, সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি মির্জা ফখরুলের