ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ার কারণ
Published: 27th, March 2025 GMT
ঘরে বসে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ কাজ তরুণ প্রজন্মের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। একসময় শীর্ষ ৩-এ থাকলেও সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, এ খাতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। মার্কিন সাময়িকী সিইওওয়ার্ল্ড গত বছরের ১৯ এপ্রিল ফ্রিল্যান্স কাজের জন্য সেরা ৩০টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে বাংলাদেশ ছিল ২৯তম অবস্থানে। তালিকায় শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। বাংলাদেশ থেকে ভালো অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া। এমনকি আমাদের থেকে নানা সূচকে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানও আমাদের ওপরে রয়েছে।
২০১০ সালের দিকে ফ্রিল্যান্সিং কাজের জনপ্রিয় একটি প্ল্যাটফর্মের তালিকায় আউটসোর্সিংয়ে ঢাকা তৃতীয় শীর্ষ নগরী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপরই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’-এ নজর দেয়। বিগত সরকার নানা চটকদার নামে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার নাম করে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সরকারের আইসিটি বিভাগ– বাড়ি বসে বড়লোক, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং, ফিল্যান্সার টু এন্টারপ্রেনিউর, মোবাইল অ্যাপস প্রশিক্ষক ও সৃজনশীল অ্যাপস উন্নয়ন, হাইটেক পার্কের অধীনে বিভিন্ন ধরনের আইটি প্রশিক্ষণ, নারীর দক্ষতা উন্নয়নে হার পাওয়ার, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লেভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্সসহ অগণিত প্রকল্প হাতে নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ও স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেপ) প্রকল্পের আওতায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। এর পর ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণে যুক্ত হয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরও ‘শিক্ষিত কর্মপ্রত্যাশী যুবদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে এ খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির সুযোগ ছিল। কিন্তু তা সেভাবে কাজে লাগানো যায়নি।
ঢাকঢোল পিটিয়ে আইসিটি বিভাগ এ খাত থেকে ২০১৮ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিল; ২০২৫ সালে এসেও সেটি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। আইসিটি খাত থেকে আয়ের অঙ্ক দুই বিলিয়ন ডলারও ছাড়ানো যায়নি। দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা প্রকট। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, দেশে বর্তমানে ৭ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে রয়েছে। এর মধ্যে ২৬ লাখ মানুষ বেকার। ২৪ লাখ মানুষ প্রতিবছর চাকরির বাজারে ঢুকছে। স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস)-২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা ১ কোটি ২৯ লাখ তরুণ এখন নিষ্ক্রিয়। মানে তারা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই; এমনকি কোনো প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। বিবিএস নিষ্ক্রিয় তরুণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ধরেছে ১৫ থেকে ২৪ বছর (প্রথম আলো, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। দেশের তরুণ সমাজের বড় অংশ বেকার। হতাশায় ডুবন্ত এসব তরুণের জন্য সত্যিকার অর্থে নিদান হতে পারে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের বেকার তরুণদের কথা ভাবতেই হবে। এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি গড়ায় নজর দিতে হবে। আইসিটিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি তৈরির পুরো কার্যক্রমকে একটি ছাতার নিচে আনতে হবে। আইসিটি বিভাগের আওতায় প্রশিক্ষণ-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অথরিটি/সংস্থা চালু করা জরুরি। এ সংস্থাটির কাছে থাকতে হবে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর পুরো ডেটাবেজ। নিবন্ধনের জন্য আইসিটি বিভাগের ‘প্রশিক্ষণ বাতায়ন’ নামে প্ল্যাটফর্ম থাকলেও তেমন হালানাগাদ তথ্য নেই। এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম কার্যকর থাকলে দক্ষ ব্যক্তি নিবন্ধন করতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একাধিক ট্রেনিংয়ে যুক্ত হতে পারবেন না। এতে ট্রেনিং কোম্পানির ফাঁকিবাজি বন্ধ হবে। আবার কতসংখ্যক তরুণ প্রশিক্ষণ নিল, তারা কোথায় কী করছে, তাও এখান থেকে জানা যাবে।
যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বছরের পর বছর দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে আসছে, এ রকম প্রশিক্ষণদাতা প্রফেশনাল কোম্পানিগুলোকে কাজ দিতে হবে। তাতে এসব প্রতিষ্ঠান যেমন দক্ষ ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তেমনি দক্ষ জনশক্তি গড়তেও তারা ভূমিকা রাখতে পারবে। জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে দক্ষ কোম্পানির সঙ্গে রাজনৈতিকসহ নানা বিবেচনায় অদক্ষ কোম্পানির যুক্ত হওয়া কীভাবে ঠেকানো যায়, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। কোম্পানির হাতে যখন কাজ থাকবে তখন তারা বাজার থেকে যোগ্য কর্মী খুঁজে নেবে। না পেলে নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তুলবে। কাজ আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। সরকারের বিনামূল্যে ট্রেনিং দেওয়ার কাজটি যারা পাবে তাদের কার্যক্রম কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে, যেন কোনোভাবেই এ ট্রেনিং নামকাওয়াস্তে না হয়।
দেশের তরুণ সমাজের কাছে ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ যেন আলাদিনের চেরাগ। সরকারি-বেসরকারিভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ বিষয়টিকে এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে, যেন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর টুকটাক প্রশিক্ষণ নিলেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার পকেটে পুরতে পারবে। কিছু অসৎ প্রতিষ্ঠান এ রকম প্রলোভন দেখিয়ে উল্টো প্রতারণা করছে। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সরকারকে কঠোর হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তি দিতে এর চেয়ে ভালো আর সহজ বিকল্প এই সময়ে কিছু আছে বলে মনে হয় না। তরুণ প্রজেন্মের কথা মাথায় রেখে এ খাতে দক্ষ কর্মী তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকার মনোযোগী হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ র ল য ন স আউটস র স প রকল প র জন য সরক র আইস ট
এছাড়াও পড়ুন:
‘রাজশাহীর “চাঁদাবাজদের” তালিকায় উল্লেখিত ৬ ব্যক্তি জামায়াতের জনশক্তি নয়’
রাজশাহীতে ‘চাঁদাবাজদের’ তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা-কর্মীর নাম আসায় প্রতিবাদ জানিয়েছে দলটি। আজ মঙ্গলবার দলটির রাজশাহী মহানগরীর আমির কেরামত আলী ও সেক্রেটারি ইমাজ উদ্দিন মণ্ডলের এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি শাহাদৎ হোসাইন।
সম্প্রতি রাজশাহীর ‘চাঁদাবাজ’ হিসেবে ১২৩ জনের একটি তালিকা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এটি পুলিশের নাকি সরকারের অন্য কোনো সংস্থার তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এতে ‘চাঁদাবাজ’ হিসেবে ১২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। ওই তালিকার ৬ জনের নামের পাশে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়। পরে ওই তালিকা নিয়ে গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তালিকাটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
আরও পড়ুনরাজশাহীতে ১২৩ ‘চাঁদাবাজের’ তালিকা নিয়ে তোলপাড়, আছেন বিএনপি–জামায়াতের ৫০ জন২৮ জুলাই ২০২৫জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ফেসবুকসহ কিছু অনলাইন পোর্টালে রাজশাহীর ১২৩ জন চাঁদাবাজ শীর্ষক তালিকায় ৬ জনের নামের পাশে জামায়াতকর্মী হিসেবে উল্লেখ আছে। এসব মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। ১২৩ জন চাঁদাবাজের এই কাল্পনিক তালিকা কতটুকু সঠিক ও নির্ভরযোগ্য—সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ, তালিকাটি কারা তৈরি করেছেন, সেটির উল্লেখ নেই।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এই তালিকার ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। মূলত জামায়াতে ইসলামীর ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যেই কোনো কুচক্রী মহল এই অপপ্রচার চালিয়েছে। তালিকায় যাঁদের নামের পাশে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে দলটির কোনো জনশক্তির নাম, পিতা ও ঠিকানার সঙ্গে মিল নেই। তাঁরা জামায়াতে ইসলামী রাজশাহী মহানগরীর কোনো পর্যায়ের জনশক্তিও নন। জামায়াতে ইসলামীর কোনো জনশক্তি চাঁদাবাজি করে না এবং কাউকে তা করতেও দেওয়া হবে না।