কেউ কাউকে মানেন না, ভেঙে পড়েছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা
Published: 30th, March 2025 GMT
রাজশাহী মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। দলের মধ্যে প্রকাশ্যে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। যাঁদের কেউ কাউকে মানছেন না। এক পক্ষের কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকেন আরেক পক্ষের নেতারা। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে পৃথকভাবে। এই বিভক্তির কারণে দ্বন্দ্ব–সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা। ঘটছে প্রাণহানিও।
দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ এনে ১৭ মার্চ রাজশাহীতে থাকা বিএনপির তিন কেন্দ্রীয় নেতাকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছেন মহানগরের নেতারা। এ নিয়ে দলের মধ্যে তোলপাড় চলছে। এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলছেন অনেকেই। ওই চিঠিতে মহানগর বিএনপিকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড কমিটিকে বাদ দিয়ে নিজস্বভাবে দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি পালনের অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য চিঠি দেওয়ার পরও ২১ মার্চ নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে কর্মসূচি পালন করেছেন তিন নেতা।
ওই তিন নেতা হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহীর সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান (মিনু); বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন (বুলবুল) এবং বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহসম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক (মিলন)। তাঁরা দীর্ঘদিন নগর বিএনপির শীর্ষ পদে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা এই তিন নেতা ‘সতর্কীকরণ চিঠিকে’ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। মহানগর কমিটির এমন চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার নেই বলে দাবি করেছেন তাঁরা। তবে মহানগর কমিটির নেতারা বলছেন, কেন্দ্রের নির্দেশেই তাঁরা এই চিঠি দিয়েছেন। এই নিয়ে দলে এখন চরম টানাপোড়েন চলছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ আলীকে আহ্বায়ক ও মামুন অর রশিদকে সদস্যসচিব করে নগর বিএনপির ৯ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এতে সাতজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। তাঁরা হলেন নজরুল হুদা, দেলোয়ার হোসেন, মো.
তিন ভাগে বিভক্ত কর্মসূচি
বিএনপি দলীভাবে পালন করে থাকে এমন দিবসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। গত ৭ নভেম্বর এই দিবসে মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ নগরজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। ৮ নভেম্বর নগর বিএনপির চার যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন, আসলাম সরকার, জয়নাল আবেদীন ও ওয়ালিউল হকের নেতৃত্বে পৃথক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। পরদিন ৯ নভেম্বর নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা ও সদস্যসচিব মামুনুর রশিদের নেতৃত্বে পৃথক আলোচনা সভা হয়।
আবার নগর বিএনপির কর্মসূচিতে ডাক পাচ্ছেন না কেন্দ্রীয় এই তিন নেতা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শহীদ পরিবারের সঙ্গে ৭ মার্চ সৌজন্য সাক্ষাৎ ও দোয়া অনুষ্ঠান ছিল নগরের ভুবনমোহন পার্ক শহীদ মিনারে। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সেখানে তাঁরা ডাক পাননি।
এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মহানগর বিএনপি আয়োজিত দলের বিভাগীয় শোভাযাত্রায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান (দুদু)। এই সমাবেশেও ওই তিন কেন্দ্রীয় নেতাকে দেখা যায়নি।
পাল্টা কমিটির পর তৃণমূলে অসন্তোষ
গত ২৪ অক্টোবর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব নগরের সাত থানার আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। কিন্তু পাল্টা কমিটি দেন চার যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন, আসলাম সরকার, জয়নাল আবেদীন ও ওয়ালিউল হক। এই কমিটি করার পরে দলের অসন্তোষের কথা কেন্দ্রে চলে যায়। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম এসে তাদের মীমাংসা করে দেন। পাল্টা কমিটির আহ্বায়কদের যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটি পুনর্গঠন করে দেওয়া হয়।
তবে এ নিয়ে দলে এখনো অসন্তোষ রয়েছে। একাংশের নেতা–কর্মীরা বলছেন, সাতটি থানার একটিতেও ভালো কমিটি হয়নি। এই কমিটি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নগরের মতিহার থানার পাল্টা কমিটিতে আহ্বায়ক হয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি স্নাতকোত্তর। অন্যদিকে বর্তমান আহ্বায়কের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সনদই নেই। সাইফুল বলেন, তারেক রহমান ঘোষণা দিয়েছেন কমিটিতে আসবেন শিক্ষিত ও ক্লিন ইমেজের নেতারা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
বোয়ালিয়া (পশ্চিম) থানার পাল্টা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন গুলজার হোসেন। তিনি বলেন, তাঁদের কমিটি ছিল নির্যাতিত ও ত্যাগী বিএনপি নিয়ে। নতুন কমিটি হয়েছে সুবিধাভোগীদের নিয়ে হয়েছে।
নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুন
আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ধরিয়ে দেওয়ার জের ধরে ৬ মার্চ রাতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বিএনপির দুই পক্ষ। নগরের দড়িখোরবনার মোড়ে এই সংঘর্ষে গোলাম হোসেন নামের এক রিকশাচালক নিহত হন। এ ঘটনায় করা মামলায় নগরের শাহ মখদুম থানা বিএনপির আহ্বায়ক সুমন সরদার, চন্দ্রিমা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ফাইজুর হক, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মীর তারেকসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১৫-১৬ জনকে আসামি করা হয়। নগর বিএনপির সদস্যসচিবের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান।
১৫ মার্চ বিকেলে নগরের বোয়ালিয়া থানায় বিএনপিপন্থী এক ব্যবসায়ীকে ধরিয়ে দেওয়া ও ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা নিয়ে মহানগর বিএনপির নেতারা দুই ভাগ হয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান।
নেতাদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
সরকার পতনের পর পর সরকারি সম্পত্তি জালিয়াতির অভিযোগে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদাসহ দুজনের বিরুদ্ধে ৮ আগস্ট আদালতে মামলা করেছেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমান মহানগর কমিটির সদস্যসচিব জাসদ করেছেন, জাতীয় পার্টি করেছেন। এই কমিটি আসার পরে তাঁরা কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানায় না। এরা ভূমিদস্যুতা, মারামারি, চাঁদাবাজি—এসবে ইন্ধন দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। তিনি অভিযোগ করেন, মামুন অর রশিদের ইন্ধনে নগরের দড়িখোরবনার মোড়ে একজন মানুষ খুন হয়ে গেল। তাঁদের সঙ্গে তাঁরা চলতে পারেন না।
মামুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বললেন, ‘মিজানুর রহমান মিনু আমার বড় ভাই। তবে তিনি যে অভিযোগগুলো করেছেন, এগুলো সত্য নয়।’ আহ্বায়ক এরশাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, থানা কমিটি নিয়ে পাল্টা কমিটি হয়েছিল, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম এসে সেগুলো মিটমাট করে দিয়ে গেছেন। আর কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, ‘যাঁরা বলছেন যে তাঁদের আমরা সতর্ক করতে পারি না, তাঁরা কথাগুলো কেন্দ্রে গিয়ে বলুক।’
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগের বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, তাঁরা এখন যে কর্মসূচি পালন করেন, এটা দলের চেয়ারপারসনের কর্মসূচি। সেখানে কমিটির কয়েকজন নেতা ছাড়া সবাই যাচ্ছেন। তাঁকে দলের চেয়ারপারসন মনোনীত করেছেন। তিনি ছাড়া কেউ তাঁকে অপসারণ করতে পারেন না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম জ ন র রহম ন সদস যসচ ব ন ব এনপ র কম ট কম ট র কর ছ ন সরক র সদস য বলছ ন নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাতে ‘টর্চলাইট জ্বালিয়ে’ দুই পক্ষের সংঘর্ষ, ইউএনও-ওসিসহ আহত ৩০
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে পূর্ববিরোধের জের ধরে দুটি গ্রামবাসীর সংঘর্ষে ইউএনও, ওসিসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার রাত ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত উপজেলার সদর ইউনিয়নের চানমনিপাড়া ও মোঘলটুলা গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। এ সময় বসতবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশাররফ হোসাইন ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হাসান আহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে আটক করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে মুঠোফোনের চার্জার কেনাবেচা নিয়ে চানমনিপাড়া ও মোঘলটুলা গ্রামের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর জের ধরে দুই পক্ষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছিল। গতকাল সন্ধ্যায় চানমনিপাড়া গ্রামের প্রয়াত হেলাল মিয়ার স্ত্রী হালিমা বেগম (৪২) ও তাঁর ছেলে সাইফুল ইসলাম (২০) গ্রামের অদূরে একটি চালকলে চাল ভাঙাতে যান। সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মোঘলটুলা গ্রামের তৌহিদ মিয়া (২০) হালিমা বেগমকে কটূক্তি করেন। এর প্রতিবাদ করেন তাঁর ছেলে সাইফুল ইসলাম। এ নিয়ে সাইফুল ও তৌহিদের মধ্যে হাতাহাতি হয়।
এর জের ধরে গতকাল রাত আটটার দিকে উভয় পক্ষের লোকজন দা, বল্লম, লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে দুই গ্রামের মাঝখানের সড়কে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় অন্ধকারে অনেকের হাতে ছিল টর্চলাইট।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ইউএনও মোশাররফ হোসাইন, ওসি রফিকুল হাসানসহ পুলিশের একটি দল। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ইউএনও এবং রাত ১০টার দিকে ওসি ইটের আঘাতে আহত হন। ইউএনও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি ডান হাঁটুর নিচে আঘাত পেয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ওসি রফিকুল হাসান। তাঁর ডান চোখের ওপরে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তাঁকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) তপন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সরাইল থানার ওসি রফিকুল হাসান ঘটনাস্থলে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তাঁকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে আটক করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে।
ইউএনও মোশাররফ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে সরাইলে সংঘর্ষে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনা আমি মেনে নিতে পারিনি। সংঘর্ষের ঘটনা শুনে না গিয়ে পারলাম না। কথায় কথায় সংঘর্ষের সংস্কৃতি থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।’