আরব অঞ্চলে মুদ্রা ব্যবহারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং তা একাধিক পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। শুরু হয়েছিল বিনিময় প্রথা থেকে। পরে ধাতু ও কাগজের মুদ্রার মাধ্যমে তা বিকশিত হয়। ইসলামের আগমনের পর, মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ঘটে, যা নতুন আরবি-ইসলামি পরিচয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন হয়ে ওঠে।

মক্কা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। তখনকার বাইজান্টাইন ও পারস্য সভ্যতার মতো বহু রাষ্ট্র ও সভ্যতার সঙ্গে শহরটি যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। এই যোগাযোগের কারণে আরবরা প্রথমে পারস্য ও বাইজান্টাইন মুদ্রার মাধ্যমে লেনদেন করতে শুরু করে। পরে আরবরা তাদের নিজেদের প্রাথমিক মুদ্রা তৈরি করে। আবদুল হক আল-আইফা তাঁর ইসলামি ইতিহাসে মুদ্রার উন্নয়ন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, প্রথম দিকে যে-সকল আরব রাষ্ট্র নিজেদের মুদ্রা তৈরি করেছিল, তারা হলো, সাবা ও হাদরামাউত (ইয়েমেন) এবং নাবাতীয় রাজ্য (জর্দান)।

ইসলামের প্রথম যুগে মুদ্রা

বাইজান্টাইন ও পারস্য তখন দুই বৃহত্তম সাম্রাজ্য। বাইজান্টাইনের মূল মুদ্রা ছিল দিনার ও পারস্যের সাসানীয়দের ছিল দিরহাম। এই দুই মুদ্রাই ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব উপদ্বীপে ব্যবহার করা হয় এবং ইসলামি শাসনামলের প্রথম কয়েক বছরে বিশেষ করে উমাইয়া আমল পর্যন্ত তা চালু থাকে। বাইজান্টাইন দিনার ছিল স্বর্ণ নির্মিত এবং পারস্যের দিরহাম ছিল রৌপ্য নির্মিত।

ইতিহাসবিদদের গবেষণা অনুযায়ী রাসুল (সা.

) বা প্রথম খলিফা আবু বকরের (রা.) শাসনামলে কোনো মুদ্রা তৈরি হয়নি। তবে খলিফা উমরের (রা.)-এর শাসনামলে প্রথমবারের মতো ইসলামি মুদ্রার উৎপাদন শুরু হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুদ্রা শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি নবজাত রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুনযুবকের সৎ কাজ এবং পাথর সরে যাওয়া০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ওমর (রা.) পারস্যের দিরহামের অনুসরণে আরবি মুদ্রা প্রস্তুত করেছিলেন, যার ওপর নির্দিষ্ট বাক্যাংশ যেমন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ খোদাই করা ছিল। এর পর খলিফা ওসমানের (রা.) শাসনামলেও একই মুদ্রা ব্যবহার হতে থাকে। সে-মুদ্রায় কুফি লিপিতে লেখা ছিল ‘বিসমিল্লাহ রাব্বি’।

আলির (রা.) শাসনামলে বসরা শহরে মুদ্রা প্রস্তুত করা হলেও তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে উমাইয়া আমল থেকে ইসলামি মুদ্রাব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে, যা ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিরাট বিপ্লবের সূচনা করে।

ইসলামি দিনারের উদ্ভব

ইসলামি দিনার কেবল একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ছিল না, বরং এটি ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার একটি প্রতীক। এর মাধ্যমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংঘর্ষের সূচনা ঘটে।

যুদ্ধের কারণে উমাইয়া শাসক আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানকে বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান দ্বিতীয়ের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী শান্তি রক্ষা করতে তিনি সপ্তাহে ১,০০০ দিনার পরিশোধ করতে বাধ্য ছিলেন, যাতে শাম (সিরিয়া) অঞ্চলের সীমান্তে তারান আক্রমণ না করে।

আরও পড়ুনবান্দার ডাকে আল্লাহর সাড়া ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কিন্তু যখন আবদুল মালিক নতুন মুদ্রা উদ্ভাবনের করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন জাস্টিনিয়ান ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি হুমকি দেন যে, তিনি মুদ্রায় এমন কিছু শব্দ খোদাই করবেন যা রাসুল (সা.)-এর অবমাননা করবে। তবে আবদুল মালিক ইসলামি স্বর্ণমুদ্রা দিনার চালু করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাইজান্টাইন মুদ্রার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। ফলে শান্তিচুক্তি ভঙ্গ হয়ে যায় এবং একটি নতুন যুদ্ধ শুরু হয়।

যুদ্ধে ইসলামি রাষ্ট্র বিজয়ী হয় এবং ইসলামি দিনার সরকারি মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ এর অর্থনৈতিক প্রভাব পুরো ইসলামি বিশ্বে বিস্তৃত হয়। পরে দিনার পশ্চিমা ভাষায় ‘ম্যানকাস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব

৭৭ হিজরিতে প্রথম স্বতন্ত্র ইসলামি মুদ্রা চালু হওয়ার ফলে ইসলামি রাষ্ট্র বাইজান্টাইনদের অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়। জগতে একটি একক মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি করে, যা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহার হতে শুরু করে। এর ফলে অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজতর হয় এবং বিভিন্ন মুসলিম জাতির মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ স্থাপন করে।

এ ছাড়াও ইসলামি মুদ্রা গুণগত মান, সঠিক ওজন এবং বিশুদ্ধতার জন্য পরিচিতি লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রা বাজারে এ আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জন করে। ইউরোপ, ভারত ও চীনের মতো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালু করতে করতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুনযে সাহাবির কোরআন তিলাওয়াতে মুগ্ধ হন ফেরেশতারা২৮ জানুয়ারি ২০২৫

ইসলামি অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কর ও জিজিয়া ইসলামি মুদ্রায় পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাজারের উন্নয়ন সাধিত হয়। এই মুদ্রা ব্যাপকভাবে বিদেশি ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করে। একই সঙ্গে ইসলামি মুদ্রায় শুধু আরবি লেখা থাকায় তা আরবি ভাষার প্রসার এবং ইসলামি সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে আরও শক্তিশালী করে। এতে থাকা ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ ইসলামি সমাজের অর্থনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।

 সূত্র: আলজাজিরা ডট নেট

আরও পড়ুন সুন্দর বিচার৩০ জানুয়ারি ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র প রস য ব যবস ইসল ম প রথম আবদ ল

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস

স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।

মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’

সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

অনাহারে মৃত্যু ১৫৪

গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।

গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।

বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।

গাজায় স্টিভ উইটকফ

শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ