শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর শাসনামলে ভারতপন্থি হয়ে থাকার তকমা জোটে বাংলাদেশের কপালে। কিন্তু ২০২৪-এ ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। এখন সুযোগ এসেছে সেই ভারতপন্থি খোলস থেকে বেরিয়ে স্বকীয় পরিচয় তৈরি করার। সম্ভাবনার এই সময়ে একটি প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে–  দুই অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সামলে কীভাবে নিজের দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ? 

 এককালে চীন-ভারত শক্তিমত্তার তুলনাসূচক তর্কে উভয়ের সমকক্ষ হওয়ার ধারণা চালু ছিল। বর্তমানে ভারতকে যদি হাতি ধরা হয়, তবে চীনকে বলা চলে তিমি। এমনকি চীন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অগ্রগামী।

উদ্বৃত্ত অর্থ কিংবা সঞ্চয়ের পরিমাণ, অবকাঠামোগত প্রকল্পে ঋণদান, নগদ অর্থ সহায়তা, ঋণ কিংবা সুদ মওকুফ, সুদহার কমানো, সুদ ফেরতদানের কিস্তির সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ ও বিলম্বিতকরণ এসব আর্থিক সক্ষমতায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশের প্রয়োজন পূরণে চীনের এই সামর্থ্যকে শেখ হাসিনা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে বিষয়টি না দেখার ভান করে তাতে নীরবে সায় দিয়েছে। ৫ আগস্ট হাসিনার পতন হওয়া মাত্রই চীন নবগঠিত ইউনূস সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশ ঘুরে যায়।

হাসিনার পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করতে থাকে। গত ৭ নভেম্বর চীনের আমন্ত্রণে বিএনপির চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত পলিটিক্যাল পার্টি প্লাস কো-অপারেশন সম্মেলনে যোগ দেয়। এখন প্রশ্ন হলো, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই ঘনিষ্ঠতাকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখবে? অর্থাৎ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কত দূর পর্যন্ত গড়াতে পারবে?  

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করতে চলেছেন, তা চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এই দ্বৈরথে চীনের উত্থান সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে অথবা চীন পরাজিত হয়ে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আরও দীর্ঘকাল বিশ্বনেতা হিসেবে টিকে থাকবে কিনা অথবা চীন তাকে টপকে যাবে কিনা, সেই ফয়সালা চটজলদি দৃশ্যমান হবে না। এ লড়াই দীর্ঘ কয়েক দশক পর্যন্ত চলতে পারে। 

বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণ না বাড়লে এ দেশে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা পণ্যের ক্রেতা তৈরি হতে পারবে না। তাই চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ঋণ কিংবা নগদ অর্থ সহায়তা গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে না। এভাবে চীন-মার্কিন দ্বৈরথে ভারসাম্যমূলক নীতি বজায় রাখার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে।  

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনা উত্থান ঠেকানোর তৎপরতার অভিঘাত অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও রাজনৈতিক উত্তেজনা-অস্থিরতা তৈরি করবে। সেই চাপ মোকাবিলায় কীভাবে ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণের কৌশল অবলম্বন করা যায়, সে জন্য জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রস্বার্থ রক্ষা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। বাংলাদেশ রয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ঝুঁকিতে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের আতঙ্ক থেকে এ দেশের জনমত চীনের সঙ্গে সখ্য গড়তে আগ্রহী।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারলে চীন-বাংলাদেশ আরও গভীর সম্পর্ক তৈরি হতে পারবে। অন্যদিকে চীন-মার্কিন দ্বৈরথে বাংলাদেশ শামিল না হয়ে বরং চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতা নিরসনে বাংলাদেশ সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করতে পারে। এ দেশ হতে পারে পূর্ব-পশ্চিমের বিরোধ মীমাংসার নিরপেক্ষ কেন্দ্রভূমি। ঢাকা হতে পারে শান্তি সংলাপের কেন্দ্রস্থল। এর জন্য এ দেশে প্রয়োজন উপযুক্ত নেতৃত্ব ও যথাযথ কর্মকৌশল।

এ পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের চীন সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সফরে দুই দেশ তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টা চীনের তৈরি পোশাক কারখানা, বৈদ্যুতিক যানবাহন, হালকা যন্ত্রপাতি, উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রনিকস, চিপ উৎপাদন এবং সৌর প্যানেল শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তর সহজ করতে বেইজিংয়ের সহায়তা চান। চীনা উপপ্রধানমন্ত্রী দিং শুয়েশিয়াং জানান, ২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে, যা বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের দুই বছর পর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এ বছরের গ্রীষ্মকাল থেকে বাংলাদেশ থেকে চীনে আম রপ্তানি শুরু হবে। বেইজিং কাঁঠাল, পেয়ারা এবং অন্যান্য জলজ পণ্য আমদানি করতেও আগ্রহী, যাতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যের বিশাল ব্যবধান কমানো যায়। চীন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আরও বেশি স্কলারশিপ দেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

সফরের অংশ হিসেবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে একটি অত্যন্ত সফল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। শি জিনপিং বলেছেন, বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে চীন। চীনা উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে স্থানান্তরে উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশের উত্থাপিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চীন ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে। এর মধ্যে চীনা ঋণের সুদের হার কমানো ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার বিষয় রয়েছে। সব মিলিয়ে ভারত, চীন ও ‍যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে বাংলাদেশ স্বকীয় অর্থনৈতিক বলয় গড়ে তুলবে এমন প্রত্যাশা জনসাধারণের। 

রাজু আলীম: কবি, সাংবাদিক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক টন ত ইউন স র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সিদ্ধিরগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের র‌্যালি

সিদ্ধিরগঞ্জে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে র‌্যালি আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল। বৃহস্পতিবার (১ মে) সকাল সাড়ে ১০টায় নীট কনসার্নের সামনে থেকে র‌্যালিটি শুরু হয়ে নবীগঞ্জ ঘাটে গিয়ে শেষ হয়। র‌্যালিতে নেতৃত্ব দেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্য সচিব মো. আমিনুল ইসলাম শিপলু।

এতে আরও উপস্থিত ছিলেন থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রোমান, মো. সজিব, মো. তুষার, মাহবুবুর রহমান মিলনসহ স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্যান্য নেতাকর্মীরা।

র‌্যালি শেষে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মো. আমিনুল ইসলাম শিপলু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে আবুল কাউসার আশার নির্দেশনায় ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের পক্ষ থেকে এই আয়োজনটি করা হয়েছে। 


আমার শ্রমিক ভাইদের দাবি আদায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সব সময় কাজ করে যাবে। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আমরা কখনও পিছপা হবো না।’
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ