তিন ভাইয়ের আলাপে নরসুন্দর জীবনের সেকাল-একাল
Published: 8th, April 2025 GMT
প্লাস্টিকের মোড়া পেতে এক সারিতে পাশাপাশি বসে আছেন তিন ভাই। অপেক্ষা, কেউ আসবেন চুল কিংবা দাড়ি কাটতে। কিন্তু তাঁদের কাছে চুল কিংবা দাড়ি কাটানো মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে যা কামাই করেন, তাতে টেনেটুনে দিন যাচ্ছে নরসুন্দর তিন ভাইয়ের। অথচ কয়েক দশক আগেও কাজের চাপে মানুষকে দাঁড় করিয়ে রেখেও চুল–দাড়ি কেটে দিতে পারতেন না। আর এখন দীর্ঘ অপেক্ষায় মেলে না ভোক্তা।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের ঘাগড়া গোপালপুর গ্রামের প্রয়াত হরিন্দ্র চন্দ্র শীলের ছয় ছেলের মধ্যে ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল (৭০), হীরেন্দ্র চন্দ্র শীল (৬৫) ও রবীন্দ্র চন্দ্র শীল (৬০) নরসুন্দরের কাজ করেন। এই তিন ভাই রাজীবপুর ইউনিয়নের শাহগঞ্জ বাজারের পাশে পাশাপাশি বসে কয়েক দশক ধরে নরসুন্দরের কাজ করছেন। একসময় এখানে ১৫ থেকে ২০ জন নরসুন্দর থাকলেও রাস্তার পাশে এখনো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা।
গতকাল রোববার বেলা তিনটার দিকে কথা হয় নরসুন্দর তিন ভাইয়ের সঙ্গে। বেলা আড়াইটার দিকে বসলেও সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কোনো কাজ পাননি তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে সবার বড় ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীলের দুই পাশে অন্য দুই ভাই বসেছেন। বর্গাচাষি তিন ভাইয়ের ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। অন্যের জমি বর্গা করে সেখানে কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাহগঞ্জ বাজারের পাশে রাস্তায় বসে নরসুন্দরের কাজ করেন তাঁরা।
চার ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ধীরেন্দ্র। বয়স হলেও তিনি এখনো বাজারে এসে কাজের জন্য বসে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে এখানে এসে বসে থাকেন, যদি কাজ পান এই আশায়। এক-দুইটা শেভ করলে পকেট খরচটা চলে কোনো মতন। উপার্জন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মানুষ আধুনিক সেলুনে চলে যান, রাস্তায় বসে কেউ কাজ করতে চান না। সেলুন দেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই। বয়স্ক কেউ এলে রাস্তায় বসে কম খরচে কাজ করিয়ে যান। ৩০ বছর আগেও কাজের চাপে তাঁদের তিন ভাইয়ের অস্থির অবস্থা ছিল।
তিন ভাইয়ের আরেক ভাই হীরেন্দ্র চন্দ্র শীলের দুই মেয়ে ও তিন ছেলে। তিনি বলেন, ১৩ বছর বয়সে তিনি এই পেশায় আসেন। তখন চার পয়সায় শেভ, ১২ পয়সায় চুল কাটা হতো। আর এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় চুল কাটেন এবং ১০ টাকায় দাড়ি কাটেন। গত ২০ বছর ধরে তাঁদের কাছে আসা ভোক্তার সংখ্যা কমে গেছে। এখন দিনে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাঁর। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত কাজের আশায় এখানে বসে থাকেন। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু তাঁদের আয় কমেছে। তাই কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে তাঁর। এই বয়সে অন্য কোনো কাজ করবেন, সে উপায়ও নেই।
তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট রবীন্দ্র চন্দ্র শীলের দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে আলাদা থাকেন। তাই স্ত্রীকে নিয়ে নিজের সংসার তাঁর। তিনি বলেন, তাঁদের কিছু পুরোনো গ্রাহক আছেন। তাঁদের বাইরে কেউ চুল–দাড়ি কাটাতে আসেন না। দিনে তিনি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা উপার্জন করতে পারেন। এ দিয়েই চলে সংসার। আগে অনেকে তাঁদের মতো রাস্তায় বসে কাজ করলেও এখন ঘর নিয়ে সেলুন দিয়েছেন। তাঁরা তিন ভাই পথেই পড়ে আছেন। তাঁদের মৃত্যুর পর হয়তো আর কেউ এভাবে রাস্তায় বসে চুল–দাড়ি কাটাবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
বাণিজ্যবিরোধ: ভারত কেন ট্রাম্পের নিশানায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের বাণিজ্যনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় পণ্যের ওপর হোয়াইট হাউসের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তুতি নেওয়ার পর থেকেই এ আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে এবং এর পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাম্প যখন বিশ্বের বহু দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছিলেন, তখনই ভারতকে উদ্দেশ করে তাঁর এমন কঠোর অবস্থান সামনে উঠে আসে।
হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
‘ভারতের শুল্ক বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ’, গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জবাবে ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা ট্রাম্পের বক্তব্য ‘লক্ষ্য করেছে’ এবং এর ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যবিরোধ: পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে
আজ থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ধার্য করা ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ঘোষিত সম্ভাব্য শুল্ক থেকে মাত্র ১ শতাংশ কম।
এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ শুল্কের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশ শুল্কের চেয়ে কিছুটা কম।
হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।এ শুল্ক ভারতের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা আরও জটিল করে তুলতে পারে। একাধিক দফা আলোচনার মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া অনেক কোম্পানির নতুন গন্তব্য হয়েছে দেশটি। মে মাসে অ্যাপলের সিইও টিম কুক জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য আইফোন এখন ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে; যাতে উচ্চ শুল্ক এড়ানো যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের (ওটিআর) তথ্যমতে, গত বছর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৯ বিলিয়ন (১২ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার। ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক, রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি ও কৃষিপণ্য।
ট্রাম্প কেন ভারতকে নিশানা করছেন
সম্প্রতি ট্রাম্প একাধিকবার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভারতের ‘অতি উচ্চ’ শুল্ক আরোপের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যও রয়েছে।
বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘বছরের পর বছর আমরা ভারতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, তাদের শুল্ক অত্যন্ত বেশি।’
এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্টদেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে ভারত কিছু পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করেছে।
ওটিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পণ্যবাণিজ্যে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের ঘাটতি দেখেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। তুলনামূলকভাবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন (২৯ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের বাণিজ্যঘাটতিতে ছিল।
আরও পড়ুনভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা, ইরানের পণ্যের বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ ৩১ জুলাই ২০২৫ট্রাম্প আরও ক্ষুব্ধ যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।
‘এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা’, বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ট্রাম্প।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত সরকার ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে তুলনামূলকভাবে মৃদু, তবে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
ভারতের ওপর ধার্য করা শুল্কহার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম।বুধবার দেওয়া এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিকভাবে লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’
আগস্টের শেষ দিকে দুই দেশের মধ্যে আরেক দফা বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুনভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আলাদা ‘দণ্ড’৩০ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্কে ভারতের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কী বলছেন অর্থনীতিবিদেরা১৪ ঘণ্টা আগে