ঢাকা উত্তরে মশকনিধন কর্মীদের হাজিরা ঠিকঠাক, পরে ফাঁকিবাজি
Published: 8th, April 2025 GMT
ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) মশকনিধন কর্মীদের হাজিরা দিতে হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে অ্যাপের মাধ্যমে। তাই কর্মীরা কাজে আসেন সময়মতো। হাজিরা দিয়ে মশকনিধনের ওষুধ ও ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র (স্প্রে/ফগার মেশিন) নিয়ে নির্ধারিত সময়ে কাজেও যান। এর পরেই শুরু হয় ফাঁকিবাজি। অনেকে নির্ধারিত এলাকায় গিয়ে আর ওষুধ ছিটান না। কেউ কেউ হাজিরা দিলেও পরে আর কাজেই যান না।
গত রোববার সকালে ও বিকেলে ঢাকা উত্তর সিটির দুটি ওয়ার্ডে গিয়ে মশকনিধনের কর্মীদের ফাঁকিবাজির এ চিত্র দেখা গেছে। সকালে ৩ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের সি ব্লকে ওষুধ ও যন্ত্র নিয়ে কর্মীরা গেলেও, ওই এলাকার ১৫টি সড়কে কাউকে ওষুধ দিতে দেখা যায়নি। বিকেলে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, হাজিরা দেওয়ার পরে তিনজন কর্মী আর কাজেই যাননি।
অনেকে নির্ধারিত এলাকায় গিয়ে আর ওষুধ ছিটান না। কেউ কেউ হাজিরা দিলেও পরে আর কাজেই যান না।মিরপুর ১১ নম্বরের প্যারিস রোডসংলগ্ন ৩৪ নম্বর সড়কে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কার্যালয়। একটু সামনেই সড়কের শেষ প্রান্তে একটি কক্ষে রাখা হয় মশকনিধনের ওষুধ ও যন্ত্র। সকাল আটটার কিছু আগে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন মশকনিধন কর্মী কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সকালে ওয়ার্ডের ১৭ জন কর্মী উপস্থিত ছিলেন। অনুপস্থিত ছিলেন দুজন।
মশকনিধনের কাজের দায়িত্ব ছয় মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে সেনাবাহিনীকে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, যাতে অন্তত তদারকিটা কঠোরভাবে হয়।মোহাম্মদ এজাজ, প্রশাসক, ঢাকা উত্তর সিটিসকাল ৮টা ১২ মিনিটের দিকে ওষুধ ও যন্ত্রপাতি নিয়ে কর্মীরা যে যার মতো নির্ধারিত এলাকায় রওনা হন। সুপারভাইজার উজ্জ্বল মিয়া প্রথম আলোকে জানান, মিরপুর ১০ নম্বরের সি ও ডি ব্লক এবং মিরপুর ১১ নম্বরের সি ব্লকে ওষুধ ছিটানো হবে।
সকাল সোয়া ৯টার কিছু পরে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সি ব্লক এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। প্রথমে সি ব্লকের ৫ নম্বর সড়কে গিয়ে ওষুধ ছিটাতে যাওয়া কর্মীদের খোঁজ করা হয়। পর্যায়ক্রমে হেঁটে সি ব্লকের ৩, ১৩, ১৭, ১১, ১৪, ১০, ১৮, ১৭, ১৯, ২০, ২১, ২২/৭, ১৬ ও ১৫ নম্বর সড়কে যান এই প্রতিবেদক। প্রায় এক ঘণ্টা (সকাল ১০টা পর্যন্ত) এসব সড়কে কোনো কর্মীকে মশকনিধনের ওষুধ ছিটানোর কাজ করতে দেখা যায়নি।
এ সময় এসব সড়কে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী, বাসিন্দা, চা-দোকানি, সবজি বিক্রেতা—এমন অন্তত সাতজনের কাছে মশকনিধনের কর্মীদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কেউই ওষুধ ছিটাতে দেখেননি বলে জানান। যেখানে ওষুধ–যন্ত্রপাতি রাখা হয়, সাড়ে ১০টার দিকে আবার সেখানে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে কাজ শেষ করে ফিরেছেন—এমন কোনো কর্মীকে পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি বিস্তারিত জানিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, রোববার সি ব্লকের ১৫, ১৬, ২০, ২১ ও ২২ নম্বর সড়কে ওষুধ ছিটানোর কাজ হয়েছে। মশকনিধন কর্মীরা কাজ করেছেন বলেও বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেন।
মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন জানিয়ে মিরপুর সি ব্লকের বাসিন্দা সাদমান হোসেন বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কর্মীদের হঠাৎ হঠাৎ কখনো দেখা যায়। কিন্তু ওষুধ ছিটানোর কাজ করে কি না, জানি না।’
সকাল সোয়া ৯টার কিছু পরে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সি ব্লক এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। প্রথমে সি ব্লকের ৫ নম্বর সড়কে গিয়ে ওষুধ ছিটাতে যাওয়া কর্মীদের খোঁজ করা হয়। পর্যায়ক্রমে হেঁটে সি ব্লকের ৩, ১৩, ১৭, ১১, ১৪, ১০, ১৮, ১৭, ১৯, ২০, ২১, ২২/৭, ১৬ ও ১৫ নম্বর সড়কে যান এই প্রতিবেদক। প্রায় এক ঘণ্টা (সকাল ১০টা পর্যন্ত) এসব সড়কে কোনো কর্মীকে মশকনিধনের ওষুধ ছিটানোর কাজ করতে দেখা যায়নি।বিকেলেও একই চিত্র
সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত মশার লার্ভা (শূককীট) নিধনের কাজ করার কথা কর্মীদের, যাকে বলা হয় লার্ভিসাইডিং। এরপর বিকেল পৌনে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত পরিপক্ব বা উড়ন্ত মশা মারতে ওষুধ ছিটাবেন, যাকে বলা হয় ফগিং।
ফগিং কার্যক্রম দেখতে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তেজগাঁওয়ে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কার্যালয়ে যান এই প্রতিবেদক। ততক্ষণে মশকনিধন কর্মীদের বেশির ভাগই নির্ধারিত এলাকায় ওষুধ ছিটানোর জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
ওয়ার্ড কার্যালয়ের সামনে কথা হয় দুজন কর্মীর সঙ্গে। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, মোট কতজন কর্মী মশকনিধনের কাজ করেন আর উপস্থিত আছেন কতজন। তাঁরা জানান, ২০ জনের সবাই উপস্থিত আছেন। কিন্তু কাজে গেছেন ১৭ জন। বাকি তিনজন কাজে যাননি। এ ছাড়া ওই ওয়ার্ডের মশকনিধন কার্যক্রমের সুপারভাইজার আবু হানিফও বিকেলে আর আসেননি বলে জানান তাঁরা।
সিটি করপোরেশনের কর্মীদের হঠাৎ হঠাৎ কখনো দেখা যায়। কিন্তু ওষুধ ছিটানোর কাজ করে কি না, জানি না।মিরপুর সি ব্লকের বাসিন্দা সাদমান হোসেনকাজে না যাওয়া তিনজনের মধ্যে একজন তাজুল ইসলাম। ওয়ার্ড কার্যালয়ে ছিলেন তিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন বলে কাজে যাননি তিনি। কাজে না যাওয়া অন্য দুই কর্মীর বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁরা হাজিরা দেওয়ার পর কোথায় চলে গেছেন তিনি জানেন না।
তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুজন কর্মী নিকেতন বাজার গেট এলাকায় ফগিং করতে গেছেন। তাঁরা নর্দান রাবার নামে একটি কারখানার ভেতরে বড় একটি পুকুরের আশপাশে ওষুধ ছিটাবেন। বিকেল পাঁচটার দিকে ওই কারখানায় গিয়ে জানতে চাইলে কারখানাটির প্রহরী আবুল মিয়া জানান, মশার ওষুধ দিতে কোনো কর্মী আসেননি।
মিনিট দশেক খোঁজাখুঁজির পর নর্দান রাবার কারখানা থেকে একটু ভেতরে নিকেতন আবাসিক এলাকায় এক জায়গায় ওই দুজন কর্মীকে দেখা যায়। রাস্তায় ফগার যন্ত্র রেখে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন তাঁরা। ছবি তুলতে দেখে দুজনই এগিয়ে আসেন। ওষুধ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, নামাজ হচ্ছে। শেষ হলেই তাঁরা ফগিং শুরু করবেন।
আমি আমার নিজের মতো করে ঘুরি। ঘুরে ঘুরে আমিও কিন্তু একই চিত্র পেয়েছি। আজকে (রোববার) মিটিংয়েও এটা উত্থাপন করেছি।ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসংস্থাপ্রধানেরও একই অভিজ্ঞতা
সকালে ও বিকেলে দুটি ওয়ার্ডে মশকনিধন কর্মীদের কাজের চিত্র তুলে ধরে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার নিজের মতো করে ঘুরি। ঘুরে ঘুরে আমিও কিন্তু একই চিত্র পেয়েছি। আজকে (রোববার) মিটিংয়েও এটা উত্থাপন করেছি।’
মশকনিধনের কাজটি সরাসরি সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে জানান উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর কারণ, সিটি করপোরেশনের লোকজনও অনিয়মে জড়িত। সেনাবাহিনীকে ছয় মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কাজ দেওয়া হবে। যাতে অন্তত তদারকিটা কঠোরভাবে হয়।’
ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়, বর্ষা মৌসুম, ডেঙ্গুর প্রকোপ—এসব বিষয় সামনে রেখে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আগামী তিন মাস, প্রতি মাসে ৮-১০ দিন করে তারা সময় দেবে। তাদের কাজ হবে বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে তারা মাঠে কাজ করবে। এ ছাড়া মশা প্রজননের এক হাজার ‘হট স্পট’ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব জায়গায় মশকনিধনের আধুনিক ফাঁদ স্থাপন করা হবে বলেও জানান তিনি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ধ র ত এল ক য় কর ম দ র হ র কর ম দ র কর ম ক কর ম র র সড়ক প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়