কক্সবাজার সাগর উপকূলে মা কাছিমের মৃত্যু থামছে না। মাছ ধরার নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়া অনেক কাছিম পিটিয়ে মারার পর সাগরে ফেলে দেন জেলেরা। জোয়ারের পানিতে এসব মৃত কাছিম ভেসে আসছে সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে।

গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে সমুদ্রসৈকতের তিনটি পয়েন্টে চারটি মৃত মা কাছিম ভেসে এসেছে। আগের দিন সোমবার ভেসে আসে আরও তিনটি। গত সাত দিনে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে মহেশখালী সোনাদিয়া পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার সৈকতের ৯টি পয়েন্টে অন্তত ৩৪টি মৃত কাছিম ভেসে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

ভেসে আসা কাছিমের অধিকাংশের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানান পরিবেশবিষয়ক সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, মা কাছিমের মৃত্যুর অন্যতম কারণ শত কিলোমিটার সমুদ্র উপকূলজুড়ে অন্তত ২০ হাজারের বেশি নিষিদ্ধ জাল (বেহুন্দি, ফাঁস ও কারেন্ট জাল) পুঁতে রাখা হয়েছে। এসব জালে কাছিম আটকা পড়ে। মাঝেমধ্যে কোস্টগার্ড ও মৎস্য বিভাগ অভিযান চালিয়ে কিছু জাল জব্দ করলেও বেশির ভাগই অভিযানের আওতার বাইরে থাকা যায়।

বেসরকারি একটি সংগঠনের তথ্যমতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে কক্সবাজার সৈকতের ৫০টির বেশি পয়েন্টে ভেসে আসে ২৪০টি মৃত মা কাছিম। সব কটি অলিভ রিডলে প্রজাতির। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ডিম ছিল।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক সৈকতে ভেসে আসে দুটি অলিভ রিডলে প্রজাতির মৃত কাছিম। কয়েকটি কুকুর কাছিম নিয়ে টানাটানি শুরু করছিল। কাছিমের কিছুটা দূরে বালুচরে জাল সংস্কার করছিলেন কয়েকজন জেলে। মৃত কাছিমের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় জেলেরা কাছিম দুটি বালুতে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলেন।

স্থানীয় জেলে ছৈয়দ কামাল (৪৫) বলেন, প্রায় প্রতিদিন এই সৈকতে একাধিক মৃত কাছিম ভেসে আসে। সব কটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ডিম থাকে। বেওয়ারিশ কুকুর এসব ডিম খেতে মরিয়া হয়ে ছুটে। তিনি আরও বলেন, জালে আটকা পড়লে ট্রলারের জেলেরা কাছিমকে বরফ ভাঙার লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। তারপর মৃত কাছিম সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। জেলেদের মধ্যে কুসংস্কার রয়েছে, জালে কাছিম আটকা পড়লে নাকি সেই জালে আর মাছ ধরা পড়ে না। এই কারণে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়।

শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা জসিম মাহমুদ জানান, গত সোমবার শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় তিনটি মৃত কাছিম ভেসে আসে। এর একটি জেটিঘাট এলাকায় এবং অপর দুটি গোলারচর সৈকতে ভেসে এসেছে। কাছিমগুলোর ওজন ২০-৩০ কেজি। কোনোটির পা নেই, কোনোটির শরীরের ওপরের অংশে (পিঠে) রক্তাক্ত জখমও দেখা গেছে।

মৃত কাছিমগুলো অলিভ রিডলে প্রজাতির জানিয়ে বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে মৃত কাছিমগুলো বালুচরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সমুদ্রের ময়লা-আবর্জনা ও আগাছা পরিষ্কার এবং মাছের পোনা খাদক জেলিফিশ খেয়ে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখতে অনন্য ভূমিকা রাখে কাছিম। গভীর সমুদ্রের হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মা কাছিম ডিম পাড়তে ছুটে আসে কক্সবাজার উপকূলে। এ সময় সাগরে পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে শত শত মা কাছিম মারা যাচ্ছে।

সম্প্রতি নেকমের একটি জরিপে দেখা গেছে, এখন মা কাছিম সৈকতের ৩৪টি পয়েন্টে ডিম পাড়ার সুযোগ পাছে। এক দশক আগে ৫২টি পয়েন্টে ডিম পাড়ত। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, ১ ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ২৪০টির বেশি মৃত কাছিম ভেসে এসেছে। কাছিমগুলোর মৃত্যু না হলে অন্তত ৩০ হাজার ডিম পাওয়া যেত।

সাগরে ছাড়া হলো পাঁচ হাজার কাছিম ছানা

নেকমের দেওয়া তথ্যমতে, গত তিন মাসে সৈকতের ১২টি পয়েন্ট থেকে ২৬ হাজার ৯০০টি ডিম সংগ্রহ করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরপর ডিমগুলো নেকমের সাতটি হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়। এ পর্যন্ত ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৫ হাজার ৯৮টি। সব কটি ধাপে ধাপে সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে। অবশিষ্ট ডিমগুলো থেকেও কয়েক দিনের মধ্যে বাচ্চা ফুটবে।

৫ এপ্রিল বিকেলে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সৈকতে অবমুক্ত করা হয় ৫৫০টি কাছিম ছানা। নেকমের স্বেচ্ছাসেবক আলী জোহার বলেন, অবমুক্ত করা এসব কাছিম ছানার বয়স মাত্র দুদিন। ৯টি অলিভ রিডলে কাছিমের পাড়া ডিম থেকে এসব ছানা ফুটেছে।

কয়েক দফায় সেন্ট মার্টিন সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে ১৮৩টি কাছিম ছানা। বেসরকারি সামাজিক সংগঠন আমার সেন্ট মার্টিনের সমন্বয়ক আলী হায়দার বলেন, তিন বছর আগেও দ্বীপের সৈকতে শত শত কাছিম ডিম পাড়তে আসত। এখন কমে গেছে পরিবেশ না থাকার কারণে। কাছিমের ডিম বেওয়ারিশ কুকুর খেয়ে ফেলে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ হপর র দ ব প র স কত স কত র পর ব শ ন কম র উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ

সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়। 

গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’ 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।

টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন। 

এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’ 

সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।

সম্পর্কিত নিবন্ধ