আমাদের দেশে অতীত অভিজ্ঞতা মিশ্র হওয়ার কারণে রমজান মাসে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ভোক্তারা সর্বদা উদ্বেগে থাকেন। এই মাসে কিছু ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা উঁকি দেয়। তবে এবারের রমজানে এমনটা ঘটেনি। রমজানের শেষ দিকে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্তুষ্ট। (এবার রোজায় দ্রব্যমূল্যে সন্তুষ্ট ৯৫ শতাংশ মানুষ, কালবেলা, ২৯ মার্চ ২০২৫)

২.

রমজান মাসের স্পর্শকাতর পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খেজুর, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি, তাজা ফল, চাল, সবজি, পেঁয়াজ, ডিম, মাছ ও মাংস। মোটাদাগে, দু–একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া রমজান মাসজুড়ে এসব পণ্যের সার্বিক সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে পূরণ করেছে।

এই পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এই বছরের রমজানে নিত্যপণ্যের দাম পূর্ববর্তী রমজানের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। যেমন এ বছর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম দামে মানুষ খেজুর কিনতে পেরেছেন। ইরাক থেকে আমদানি করা সাধারণ মানের জাহিদি খেজুর (যা মোট খেজুর আমদানির প্রায় অর্ধেক) প্রতি কেজি ১৬৫ টাকার স্থলে ১১৫ টাকায় এবং কার্টনে ২৬০ টাকার স্থলে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ডিমের দাম প্রতি ডজন ১২০ টাকায় নেমেছে (প্রতি পিস ১০ টাকা), যা একসময় ১৯০ টাকায় উঠেছিল; ছোলা ও ডাল ৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। চিনি গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকা, যা এবার হয়েছে ১২০ টাকা; কেজিতে কমেছে প্রায় ২৫ টাকা। গত বছর আলু ও টমেটো ছিল ৩৫ ও ৬০ টাকা, যা এবার হয়েছে যথাক্রমে ২২ ও ২০ টাকা। সবজির দামও ছিল নিম্নমুখী। রমজানকেন্দ্রিক অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের ওপর সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপের তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়নি।  

৩.

রমজানে ভোজ্যতেলের বাজার প্রথম দিকে কিছুটা অস্বাভাবিক থাকলেও পরে তা ঠিক হয়ে যায়। এই ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম) প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দামের উর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক শুল্কছাড় এবং স্থানীয় বাজারে মূল্য সমন্বয়ের কারণে স্থানীয় বাজার স্থিতিশীলই থাকার ছিল। তবে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ আমদানি বেশি হলেও সয়াবিনের উৎস দেশ ব্রাজিল থেকে অনেকটা প্রাকৃতিক কারণে বিলম্বে জাহাজীকরণ হয়েছিল। এর ফলে তা দেশে পৌঁছাতে সময় লেগেছে।

এই বিলম্বজনিত কারণে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অসাধুতার আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারের নিবিড় তদারকিতে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। ১০ রমজানের পর থেকে ক্রেতাদের নির্ধারিত মূল্যে তেল কিনতে আর অসুবিধা হয়নি।

আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম গত কয়েক মাসে ‘অস্বাভাববিক’ ছিল। তা সত্ত্বেও ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে সরকার স্থানীয় বাজারে এর দাম বাড়তে দেয়নি। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর ক্রুড সয়াবিনের মূল্য ছিল ৯৮০ ডলার। আর ক্রুড পাম অয়েলের মূল্য ছিল ১ হাজার ৫০ ডলার। ওই বছরের ১ ডিসেম্বরে মূল্য দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৭০ ডলার ও ১ হাজার ২৩০ ডলার। পরবর্তী সময়ে সয়াবিন ১ হাজার ১৪০ ও পামের দাম উঠেছিল ১ হাজার ২৫২ ডলার। ভোজ্যতেলের এই ঊর্ধ্বগতির উত্তাপ যাতে স্থানীয় বাজারে না আসে, সে জন্য সরকার তিন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রথমত, আমদানিস্থলে শুল্ক–কর ১৫ শতাংশ থেকে প্রথমে ১০ শতাংশ এবং পরে তা ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৫ শতাংশ নামিয়ে আনা হয়। এরপর যথাযথ মূল্য সমন্বয়ের স্বার্থে স্থানীয় বাজারে প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা থেকে ১৭৫ (এক কেজি বোতল) আর খোলা তেল ১৪৭ থেকে ১৫৫ টাকায় উন্নীত করার অনুমোদন দেওয়া হয়।

দ্বিতীয়ত, বাজারে ভোজ্যতেলে বৈচিত্র্য আনার জন্য ক্যানোলা ও সানফ্লাওয়ার তেল আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার (প্রায় ৫৮ শতাংশ) কমিয়ে সয়াবিন ও পাম তেলের মতো ৫ শতাংশে আনা হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী সয়াবিন ও পাম তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত রপ্তানিনির্ভর রাইস ব্র্যান তেলকে স্থানীয় বাজারে যুক্ত করা। এত দিন অধিকাংশ ক্রুড রাইস ব্র্যান পার্শ্ববর্তী দেশে রপ্তানি হয়ে যেত। ২০১৯ সালে রাইস ব্র্যানের রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে শুধু রাইস ব্র্যানের ওপর ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয়; কিন্তু অপরোশোধিত ও পরিশোধিত তেলে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই সুযোগে দেশে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অপরিশোধিত রাইস ব্র্যান তেল পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যেত।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাইস ব্র্যানের পাশাপাশি অরিশোধিত ও পরিশোধিত তেলের ওপর অনুরূপ ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয় এবং শর্তসাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্র্যান তেল (যা অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে বিবেচিত) স্থানীয় বাজারে নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এই দেশীয় পণ্যটি সরবরাহের ফলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে সয়াবিন ও পাম তেলের বিকল্প পণ্য হিসেবে সংযোজন হয়েছে। রমজানের বাজারে এই রাইস ব্র্যান তেলের সরবরাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশে আচমকা বন্যায় আমনের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় চালের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের আলোকে ঘাটতির বিপরীতে সরকার চাল আমদানি উৎসাহিত করার জন্য এর ওপর প্রযোজ্য ৬৩ শতাংশ শুল্ক–কর মাত্র ৩ শতাংশে (এআইটি) নামিয়ে আনা হয়।

এই ঘাটতি পূরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা হয়। এরই মধ্যে অধিকাংশ চাল দেশে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়তি হওয়ায় আমদানি করা এই চালের দাম দেশেও কিছুটা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানের চাল (স্বর্ণা) প্রতি কেজি ৫৫-৫৬ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, যা রমজানের আগে আরও বেশি ছিল। উন্নত মানের চালের (বালাম, পাইজাম, নাজিরশাইল ইত্যাদি) দামও কিছুটা বাড়তি ছিল। তবে সামনে বোরো ধান আসার সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত হবে, এমনটা আশা করা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকার কর্তৃক সময়োচিত উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। চালের পরিপূরক হিসেবে আটা ও ময়দার দাম গত রমজানের তুলনায় কম (কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা) ছিল। ফলে চালের বিকল্প হিসেবে আটা ও ময়দার দামে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট থেকেছে।

ট্যারিফ কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের জরিপে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়তি খরচের চাপও কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় তা পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।৪.

রমজানে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার পেছনে কয়েকটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, এবার রমজানের প্রায় ছয় মাস আগে থেকে প্রস্তুতি চলেছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনসহ বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় (এনবিআর) সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। এ জন্য সম্ভাব্য সব নীতিগত সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশন প্রতিটি পণ্য নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণ তৈরি করেছে। ডিম, পেঁয়াজ, আলু, চাল, তেল, চিনি, খেজুর, তাজা ফলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জোরালো সুপারিশ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সার্বিক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এবারের ভোক্তাদের আচরণেও ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ভোক্তা এবার ‘প্যানিক বায়িং’(প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা) থেকে বিরত থেকেছেন; যার যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই কিনেছেন। এতে সরবরাহের ওপর তেমন বাড়তি চাপ দেখা যায়নি। লেবুর কথা ধরা যাক; কোনো কোনো স্থানে লেবু প্রথম দিকে ১০০ টাকায় হালি বিক্রি হলেও সাধারণ ভোক্তারা তা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েননি। পরে এই লেবুর দাম ৩০-৪০ টাকায় নেমে আসে।

অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ভোক্তারা স্বাভাবিক আচরণ করেছেন। ভোজ্যতেলের কিছুটা সংকট থাকলেও অধিকাংশকে সংযত আচরণ করতে দেখা গেছে। বাজার তদারকির প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে আবার সেই সংকট কেটেও যায়। সরকারি এসব পদক্ষেপে জনমনে একধরনের আস্থাও দেখা গেছে।

আরও পড়ুনইন্টেরিমের রোজা-ঈদ এবং ‘মধু মধু মধু...’৩১ মার্চ ২০২৫

তৃতীয়ত, এবারের রমজানকেন্দ্রিক পণ্য সরবরাহে নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা যুক্ত হয়েছেন। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, আগের রমজানে নিত্যপণ্য আমদানিকারকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬৫; এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪৯৯। ফলে পণ্য আমদানির ওজনে বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, যার পরিমাণ ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার টন; মূল্যের হিসাবে ৫১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৯৬ কোটি ডলার।

নতুনদের সংযুক্ত হওয়া ও বিপুল আমদানির নেপথ্যের অন্যতম কারণ ছিল, সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি এবং এর অংশ হিসেবে অনেকগুলো নিত্যপণ্যের শুল্ক–কর ও শুল্কায়ন মূল্য যৌক্তিকীকরণ করা। রমজান শুরুর অনেক আগে এ কাজ করায় এসব ব্যবসায়ী উৎসাহী হন। এতে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহে পর্যাপ্ততা দেখা যায়।

চতুর্থত, বাজারে সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজির দীর্ঘদিনের যে অভিযোগ ছিল, তা এবারে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে ছিল। বলা যায়, সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের আগে এসবের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা অনেকটা আড়ালে ছিল। এর সঙ্গে অবৈধ মজুতদারি, ঘুষ ও দুর্নীতির মাত্রাও কমেছে।

ট্যারিফ কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের জরিপে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়তি খরচের চাপও কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় তা পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। সার্বিকভাবে, এ কাজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন নিবিড় তদারকি করেছে।

অন্যদিকে অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনও এবারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি মুনাফা হওয়ায় যেকোনো পরিস্থিতি বা সংকটকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ অস্বাভাবিক মুনাফার পথ খোঁজেন। তবে এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব হলো, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে ভোক্তাসাধারণ ন্যায্যমূল্যে পছন্দের পণ্যটি ক্রয় করতে পারেন। সরকারি সংস্থাগুলো এবারে এ কাজটি অনেকাংশে করতে পেরেছে। ট্যারিফ কমিশনসহ অন্য সংস্থাগুলো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে তাদের প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।

৫.

রমজানে জনমনের এই স্বস্তি পরবর্তী সময়ে ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব সংস্থার যে রকম সুষ্ঠু সমন্বয় ছিল, তেমনটা অব্যাহত রাখা দরকার; কোথাও ছন্দপতন ঘটলে সময়মতো ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে কোনটির মৌসুমি প্রভাব রয়েছে। এর জন্য পর্যাপ্ত মজুতখানাসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি ও উদ্যোগ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নে নীতিসহায়তা ও সমর্থন দিতে হবে।

বন্দরে পণ্য খালাসে বিলম্ব রোধ, শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালান প্রতিরোধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া, সময়ে সময়ে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ আমলে নিয়ে শুল্ক–কর ও শুল্কায়ন মূল্য যৌক্তিকীকরণ করা, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ট্যারিফ পলিসি ২০২৩ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা এবং নিবিড়ভাবে বাজার মনিটরিং করাসহ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এবার রমজানের অভিজ্ঞতায় জনমনে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যাশা পূরণ করা এখন সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সংগঠনগুলোর দায়িত্ব।

ড. মইনুল খান চেয়ারম্যান (সচিব), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ত যপণ য র ভ জ যত ল র সরবর হ র পর শ ধ ত পর স থ ত শ ল ক কর অন য ন য র রমজ ন পদক ষ প ব যবস য় রমজ ন র ব যবস থ র জন য আমদ ন র ওপর সরক র ধরন র সমন ব

এছাড়াও পড়ুন:

২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না

চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।

বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।

বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।

জ্বালানি তেল

বিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।

এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।

কৃষিপণ্য

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।

খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।

২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।

চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।

দেশে কেন দাম বেশি

বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।

আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।

দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
  • যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশে আতঙ্ক-উত্তেজনা, ট্রাম্প আসলে কী চান
  • ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিতে পেন্টাগনের সায়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প
  • সবজির দাম কমতির দিকে, আটার দাম কেজিতে বাড়ল ৫ টাকা
  • যবিপ্রবিতে বাতাস হলেই বিদ্যুৎ চলে যায়, অভিযোগ শিক্ষার্থীদের
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫ ঘণ্টা পর গ্যাস সরবরাহ শুরু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মহাসড়কে নির্মাণকাজের সময় গ্যাস লাইনে ছিদ্র, সরবরাহ বন্ধ হয়ে ভোগান্তিতে গ্রাহক
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত, গ্যাস সরবরাহ বন্ধ
  • ফার্নেস তেলের বাড়তি দামের চাপে পিডিবি