প্রতিশ্রুতিগুলো প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ দিতে চায় বিডা
Published: 11th, April 2025 GMT
চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলন গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এ সম্মেলনে প্রায় সাড়ে চার শ জন বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। তাঁরা দেশের তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেন। বিনিয়োগ পরিবেশেরও খোঁজ নেন। সম্মেলনে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে সমঝোতা চুক্তি করেছে চীনা একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই সম্মেলনেই স্টার্টআপ কোম্পানি শপআপের ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সম্মেলনের আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, এখন তারা এসব বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি নিয়মিতভাবে ‘ট্র্যাকিং’ করবে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে সংস্থাটি। যাতে প্রতিশ্রুতিগুলো প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ নেয়। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গতকাল বিনিয়োগ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। সম্মেলন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিডার কর্মকর্তারা এ পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা, জুলাই বিপ্লবের পর সংঘটিত অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরির লক্ষ্যে এই বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিনিয়োগকারী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী ও নীতিনির্ধারকেরা অংশ নেন। চার দিনের এ আয়োজনে বুধবার ও বৃহস্পতিবার ছিল মূল আনুষ্ঠানিকতা। তার আগে দুদিন সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেইপিজেড, মিরসরাইয়ের জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখানো হয়। গত বুধবার সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এদিন সম্মেলনস্থলে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা পরীক্ষামূলকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন
বিডার কর্মকর্তারা জানান, সম্মেলনে আগত বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, এ দেশে বিনিয়োগের বড় বাধা নীতি ধারাবাহিকতার অভাব। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ক-কর, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যাও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা সরকারের অবস্থান জানতে চান।
এ প্রসঙ্গে বুধবার সম্মেলনের এক অধিবেশনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, বিনিয়োগের বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
পাইপলাইন তৈরি করা হবে
সম্মেলনের শেষ দিনের সংবাদ সম্মেলনে বিডা জানায়, ‘বাংলাদেশে আমরা কোন ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছি এবং সে জন্য কী পদক্ষেপ নিচ্ছি, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।’ সংবাদ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী সদস্য শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ‘সম্মেলনে কত বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি, সেটি মুখ্য না। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের একটি পাইপলাইন তৈরি করা, যাতে তাদের ট্র্যাক করে পরবর্তীতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়। আগের বিনিয়োগ সম্মেলনেও আমরা অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি ট্র্যাক না করায় সেগুলো প্রতিশ্রুতিই থেকে গেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান নাহিয়ান রহমান বলেন, ‘সাধারণত একটি বিনিয়োগ আলোর মুখ দেখতে ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। এই সময়ের আলোকে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিয়ে আমরা একটি সুস্পষ্ট পথনকশা তৈরি করব। যেসব বিদেশির কাছ থেকে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, নির্দিষ্ট সময় পরপর আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা প্রতিশ্রুতিগুলোকে প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ দিতে চাই।’
আয়োজকেরা জানান, গত চার দিনের সম্মেলনে তিনটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানো ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারা কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে, সে রকম কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে এ দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্পেনের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স, সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম ও চীনের তৈরি পোশাক কোম্পানি হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে সমঝোতা চুক্তি করেছে। এর বাইরে বিডার নির্বাহী পরিচালক আশিক চৌধুরী গত বুধবার স্টার্টআপ কোম্পানি শপআপের ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
এদিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে আগামী মাসে ২০০ বিনিয়োগকারীসহ চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে জানিয়েছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে সম্মেলন আয়োজকেরা জানান।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে প্রথমবারের মতো একটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। নাসার আর্টেমিস কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৫২টি দেশের সঙ্গে মিলে মহাকাশ অনুসন্ধানে অংশ নিতে পারবেন বাংলাদেশি তরুণেরা। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে বিডা।
সমাপনী দিনে সম্মেলনস্থলে একাধিক বিষয়ভিত্তিক কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তৈরি পোশাক, ডিজিটাল অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, সেমিকন্ডাক্টর এবং কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে এসব অধিবেশনে আলোচনা হয়। সম্মেলনে দেশীয় উদ্যোক্তারা অংশ নেন। তার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন আয়োজকেরা।
অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্য বিভিন্ন শ্রেণিতে দেশের চারটি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান চারটি হলো বিকাশ, ফেব্রিক লাগবে, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। গত বুধবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা।
একই অনুষ্ঠানে এ দেশে কোরিয়ার বিনিয়োগকারী ও ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের শিল্প খাতের বিকাশ, বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক আয়ে অবদানের জন্য তাঁকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। আশির দশকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী। আয়োজকেরা বলছেন, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সম্মানিত করার মাধ্যমে অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতেই এই সম্মাননা দেওয়া হয়।
সম্মেলনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামী—এই তিন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মিথস্ক্রিয়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। এতে করে বিনিয়োগকারীরা এসব সংস্থা ও দলের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের অবস্থান জানার সুযোগ পান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত গ পর ব শ উপদ ষ ট ন র জন র জন য সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল
তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।
যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।
ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।
এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।
বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।
টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।
একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুরাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
এত মৃত্যুর কারণ কীএই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।
যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।
গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।
গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।
মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।
শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:
এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।
দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)
তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।
চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।
পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।
এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।
পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
লেখক গবেষক: [email protected]