প্রতিশ্রুতিগুলো প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ দিতে চায় বিডা
Published: 11th, April 2025 GMT
চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলন গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এ সম্মেলনে প্রায় সাড়ে চার শ জন বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। তাঁরা দেশের তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেন। বিনিয়োগ পরিবেশেরও খোঁজ নেন। সম্মেলনে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে সমঝোতা চুক্তি করেছে চীনা একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই সম্মেলনেই স্টার্টআপ কোম্পানি শপআপের ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সম্মেলনের আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, এখন তারা এসব বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি নিয়মিতভাবে ‘ট্র্যাকিং’ করবে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে সংস্থাটি। যাতে প্রতিশ্রুতিগুলো প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ নেয়। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গতকাল বিনিয়োগ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। সম্মেলন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিডার কর্মকর্তারা এ পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা, জুলাই বিপ্লবের পর সংঘটিত অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরির লক্ষ্যে এই বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিনিয়োগকারী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী ও নীতিনির্ধারকেরা অংশ নেন। চার দিনের এ আয়োজনে বুধবার ও বৃহস্পতিবার ছিল মূল আনুষ্ঠানিকতা। তার আগে দুদিন সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেইপিজেড, মিরসরাইয়ের জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখানো হয়। গত বুধবার সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এদিন সম্মেলনস্থলে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা পরীক্ষামূলকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন
বিডার কর্মকর্তারা জানান, সম্মেলনে আগত বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, এ দেশে বিনিয়োগের বড় বাধা নীতি ধারাবাহিকতার অভাব। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ক-কর, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যাও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা সরকারের অবস্থান জানতে চান।
এ প্রসঙ্গে বুধবার সম্মেলনের এক অধিবেশনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, বিনিয়োগের বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
পাইপলাইন তৈরি করা হবে
সম্মেলনের শেষ দিনের সংবাদ সম্মেলনে বিডা জানায়, ‘বাংলাদেশে আমরা কোন ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছি এবং সে জন্য কী পদক্ষেপ নিচ্ছি, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।’ সংবাদ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী সদস্য শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ‘সম্মেলনে কত বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি, সেটি মুখ্য না। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের একটি পাইপলাইন তৈরি করা, যাতে তাদের ট্র্যাক করে পরবর্তীতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়। আগের বিনিয়োগ সম্মেলনেও আমরা অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি ট্র্যাক না করায় সেগুলো প্রতিশ্রুতিই থেকে গেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান নাহিয়ান রহমান বলেন, ‘সাধারণত একটি বিনিয়োগ আলোর মুখ দেখতে ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। এই সময়ের আলোকে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিয়ে আমরা একটি সুস্পষ্ট পথনকশা তৈরি করব। যেসব বিদেশির কাছ থেকে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, নির্দিষ্ট সময় পরপর আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা প্রতিশ্রুতিগুলোকে প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ দিতে চাই।’
আয়োজকেরা জানান, গত চার দিনের সম্মেলনে তিনটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানো ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারা কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে, সে রকম কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে এ দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্পেনের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স, সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম ও চীনের তৈরি পোশাক কোম্পানি হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে সমঝোতা চুক্তি করেছে। এর বাইরে বিডার নির্বাহী পরিচালক আশিক চৌধুরী গত বুধবার স্টার্টআপ কোম্পানি শপআপের ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
এদিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে আগামী মাসে ২০০ বিনিয়োগকারীসহ চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে জানিয়েছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে সম্মেলন আয়োজকেরা জানান।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে প্রথমবারের মতো একটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। নাসার আর্টেমিস কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৫২টি দেশের সঙ্গে মিলে মহাকাশ অনুসন্ধানে অংশ নিতে পারবেন বাংলাদেশি তরুণেরা। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে বিডা।
সমাপনী দিনে সম্মেলনস্থলে একাধিক বিষয়ভিত্তিক কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তৈরি পোশাক, ডিজিটাল অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, সেমিকন্ডাক্টর এবং কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে এসব অধিবেশনে আলোচনা হয়। সম্মেলনে দেশীয় উদ্যোক্তারা অংশ নেন। তার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন আয়োজকেরা।
অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্য বিভিন্ন শ্রেণিতে দেশের চারটি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান চারটি হলো বিকাশ, ফেব্রিক লাগবে, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। গত বুধবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা।
একই অনুষ্ঠানে এ দেশে কোরিয়ার বিনিয়োগকারী ও ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের শিল্প খাতের বিকাশ, বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক আয়ে অবদানের জন্য তাঁকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। আশির দশকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী। আয়োজকেরা বলছেন, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সম্মানিত করার মাধ্যমে অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতেই এই সম্মাননা দেওয়া হয়।
সম্মেলনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামী—এই তিন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মিথস্ক্রিয়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। এতে করে বিনিয়োগকারীরা এসব সংস্থা ও দলের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের অবস্থান জানার সুযোগ পান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত গ পর ব শ উপদ ষ ট ন র জন র জন য সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা
হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।
চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।
শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।
আরো পড়ুন:
বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’
শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’
চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’
ঢাকা/রাজীব