আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতা প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর ইউনিয়নে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। ইউনিয়নের অন্তত ২১টি গ্রামে এই বিরোধ চলছে ৪০ বছর ধরে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, সামান্য ঘটনায়ও পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ককটেল বিস্ফোরণ। গত ৪০ বছরে এই ধরনের সংঘর্ষে ককটেলের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭ জন, আহত হয়েছেন কয়েকশ মানুষ। সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুই শতাধিক হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সহিংসতার ক্ষেত্রে বর্তমানে দুই পক্ষে রয়েছেন বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান কুদ্দুস বেপারি ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জলিল মাদবর। এই দু’জনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য, মারামারি, বাড়িঘর লুটপাট ও হত্যা মামলাসহ প্রায় ৪০টি করে মামলা রয়েছে। নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে উভয়পক্ষের সমর্থকরা নিজেরাই এলাকায় ককটেল তৈরি করে। এসব বোমা তৈরির সরঞ্জাম নদীপথে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে শরীয়তপুরের বিলাশপুরে আসে।
রাজনৈতিক প্রভাবে দীর্ঘদিনের বিরোধ
পদ্মা নদীঘেঁষা ইউনিয়ন বিলাশপুর। এ অঞ্চলের নদীভাঙনপ্রবণ জমি দখল, নৌপথ নিয়ন্ত্রণ, বালু উত্তোলন, মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণসহ ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারের কারণে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।
১৯৮৪ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে বিলাশপুরে দু’পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। সে সময় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ (মেছের মাস্টার) এবং সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের মধ্যে বিরোধ ঘনীভূত হয়। ফলে সংঘর্ষ, হামলা-পাল্টা হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০০৯ সালে আনোয়ারের মৃত্যু ও মেছের মাস্টারের সাজা হওয়ার পর কুদ্দুস বেপারি এবং জলিল মাদবরের নেতৃত্বে নতুনরূপে সংঘর্ষ শুরু হয়।
কুদ্দুস সাবেক এমপি ইকবাল হোসেন অপু ও জলিল সাবেক এমপি বি এম মোজাম্মেল হকের সমর্থক হওয়ায় স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে এ দু’জনের মধ্যে আগেও বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে।
নদীপথে আসে বোমার সরঞ্জাম
এই দুই পক্ষ বিভিন্ন এলাকা থেকে সরঞ্জাম এনে এলাকায় ককটেল তৈরি শুরু করে। জানা গেছে, নদীপথে পুলিশের তৎপরতা কম থাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ থেকে নদীপথে এসব সরঞ্জাম বিলাশপুরে যায়। পরে দুই পক্ষের সমর্থকরা এসব সরঞ্জাম দিয়ে ককটেল বানায়। সংঘর্ষের সময় এসব ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও প্রাণহানি
গত বছরের ২৭ মার্চ দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হলে ককটেল বিস্ফোরণে নিহত হন জলিল মাদবরের সমর্থক সজীব মুন্সি। এর এক মাস পর ২৪ এপ্রিল আবার সংঘর্ষ হয়। এতে ককটেল বিস্ফোরণে কুদ্দুস বেপারির সমর্থক মুলাই ব্যাপারীকান্দি এলাকার সৈকত সরদার নিহত হন। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজনের অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে।
বোমার আঘাতে নিহত সজীব মুন্সির মা নুরুন্নাহার বেগম বলেন, কুদ্দুস বেপারি তাঁর ভাইদের দিয়ে ককটেল তৈরি করেন। তাদের (সজীব) মতো নিরীহ মানুষের বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তাঁর ছেলের মৃত্যু হয় সেই ককটেলের আঘাতে। ঢাকার একটি হাসপাতালে তাঁর ছেলে আইসিইউতে ৮ দিন ভর্তি ছিল। ছেলের চিকিৎসার পেছনে ৫-৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবু বাঁচাতে পারেননি।
নুরুন্নাহার বলেন, তাঁর তিন বছর বয়সী একটি নাতি আছে, তাকে দেখার কেউ নেই। তাঁর ছেলের স্ত্রীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার, অল্প বয়সে বিধবা হলো। এখন তারা অসহায়ের মতো জীবন কাটাচ্ছে।
বোমার আঘাতে নিহত, মুলাই ব্যাপারীকান্দির সৈকত সরদারের মা শাহানাজ আক্তার বলেন, তাঁর ছেলে সৈকত মারামারি দেখতে গিয়েছিল, মারামারির ভিডিও করছিল। হঠাৎ একটি ককটেল এসে তাঁর গায়ে বিস্ফোরিত হয়। তাকে ঢাকায় এনেও বাঁচাতে পারেননি। তিনি চান আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। ককটেলবাজি যেন বন্ধ হয়।
বিলাশপুর বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুই পক্ষেরই ককটেল তৈরির দক্ষ কারিগর রয়েছে। যে কোনো বিরোধে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে এ অঞ্চলের মানুষ দিনের আলোতেও নিরাপদ বোধ করেন না।
মামলা ও আসামি আটক
চলতি মাসের ৫ তারিখে বিলাশপুরের মুলাই ব্যাপারীকান্দি ও দুর্বাডাঙ্গা এলাকায় কুদ্দুস বেপারি ও জলিল মাদবর পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে দুই শতাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এদিন রাতে দু’পক্ষের সাতজনকে আটক করে পুলিশ। পরদিন রোববার তাদের জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
জলিল মাদবর একটি হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন। তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। ৫ এপ্রিল কুদ্দুস বেপারিকে ঢাকার মমিনবাগ থেকে আটক করে র্যাব্য। তাঁর মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি দাবি করেন, তাঁর ও জলিলের সমর্থকরা এবারের সংঘর্ষে জড়িত নয়। বিলাশপুরে কোনো ঘটনা ঘটলে তাদের নামে অভিযোগ করা হয়।
জাজিরা থানার ওসি মোহাম্মদ দুলাল আকন্দ বলেন, জলিল ও কুদ্দুসের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য, মারামারি, লুটপাট ও হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। ককটেলের সরঞ্জামের উৎস অনুসন্ধানে পুলিশ ও গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে। ককটেল তৈরির স্থান শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ককট ল ককট ল ত র র স ঘর ষ সরঞ জ ম ককট ল র র সমর
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস
স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’
সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অনাহারে মৃত্যু ১৫৪গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।
গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।
বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।
গাজায় স্টিভ উইটকফশুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।