হাতিরঝিলে নানা আয়োজনে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা
Published: 13th, April 2025 GMT
হাতিরঝিল এম্ফিথিয়েটার এবং এর সংলগ্ন এলাকায় আগামীকাল অনুষ্ঠিতব্য বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পরিদর্শন করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম।
রোববার সন্ধ্যায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে ২ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য বৈশাখী মেলার সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন তিনি।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনকে সাদরে বরণ করে নেওয়ার জন্য ও বাঙালি জাতির প্রাণের এই উৎসবকে রাজধানীবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এ বছর নানাবিধ আয়োজন করেছে রাজউক। পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে এবং নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ব্রেইন থিওরি নামক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় রাজউক এর তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয়েছে ২ দিন ব্যাপী এই চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ উৎসব। রাজউক চেয়ারম্যান জনাব রিয়াজুল ইসলাম আজ সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণ পরিদর্শন করেন এবং এই আয়োজনকে উৎসব মুখর করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
বর্ষবরণের এই উৎসব আয়োজনে হাতিরঝিল এম্ফিথিয়েটার এলাকায় থাকছে ঐতিহ্যবাহী খাবার ও নানাবিধ জিনিসের বিভিন্ন স্টল, শিশু-কিশোরদের চিত্তবিনোদনের জন্য কিডস জোনসহ বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক রাইড যার মধ্যে রয়েছে নাগরদোলা, মেরি গো রাউন্ড, লম্ফ জম্ফ ইত্যাদি। এছাড়াও থাকছে শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সকলের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মেলা পরিদর্শনকালে রাজউক চেয়ারম্যান প্রতিটি স্টল ঘুরে দেখেন এবং রাইডসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিশেষ গুরত্বারোপ করেন। মেলায় আগতদের সাথে রাজউক চেয়ারম্যান কথা বলেন। হাতিরঝিল এলাকায় এ ধরনের আয়োজনে দর্শনার্থীরা তাদের আনন্দের কথা এবং মেলা ভ্রমণকালে তাদের সুবিধা অসুবিধাসমূহ তাকে অবহিত করেন।
এসময় মেলা প্রাঙ্গণে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাবারের প্যাকেট ও অন্যান্য আবর্জনা নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আয়োজক প্রতিষ্ঠানকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণের জন্য কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন।
এছাড়াও মেলার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে তিনি দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানোর পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন।
প্রকৌশলী মো.
এসময় তিনি রাজধানীসহ সমগ্র দেশবাসীর প্রতি নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন এবং সকলে সপরিবারে এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিবেন এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। রাজউক চেয়ারম্যান আগামীকাল বিকেল ৪:০০ ঘটিকায় বৈশাখী মেলায় উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণকারীদের সাথে বৈশাখের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিবেন এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করবেন।
মেলা পরিদর্শনকালে মেলা প্রাঙ্গণে আরও উপস্থিত ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম, মেলা আয়োজক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ফরিদ আহমেদসহ মেলার আয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল ইসল ম র জন য ন কর ন অন ষ ঠ আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বকর্মা পূজা: গাঙ্গেয় শিল্পের উৎসব
পলাশীর যুদ্ধের আড়ালে ব্রিটিশরা ভারতের বুকে, বিশেষ করে গঙ্গা অববাহিকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে নোঙর ফেলে। এর পরপরই গ্রেট ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে যায়। তার প্রভাব ঔপনিবেশিক সক্রিয়তায় সুদূর গাঙ্গেয় অববাহিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
গঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোট থেকে মাঝারি নানা শিল্পের কারবার। ধীরে ধীরে ভারী শিল্পের কারখানাও তৈরি হয় এখানে। শস্য-শ্যামল কৃষিকেন্দ্রিক বঙ্গভূমিতে এরপর শিল্পের জোয়ার আসে। সভ্যতার বুকে যখনই এমন বিকাশ ঘটেছে, মানুষের মধ্যেও নতুন নতুন পূজা–পার্বণ উপাচারের প্রবৃত্তি জন্মাতে দেখা গেছে।
গাঙ্গেয় অববাহিকায় তাই শিল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেকালে ঠিক এমন একটি পূজার চল শুরু হতে দেখা যায়। এ পূজার চল বাংলার বাইরে প্রায় চলেই না। বিশ্বকর্মাপূজা হলো এমন একটি হিন্দু উৎসব।
তবে মহাভারতে উল্লেখ আছে, বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা। হাজার রকমের কারুকার্যের সৃষ্টিকর্তা। দেবতাদের ছুতার মিস্ত্রি, দক্ষ কারিগর ও সব অলংকারের রূপকার।আধুনিককালে এর আগে বিশ্বকর্মাপূজার উৎসের কথা প্রমাণসহ জানা যায়নি। ভারতের উৎসব নিয়ে ব্রিটিশ গবেষক এম এম ডানহিল জানিয়েছেন, বিশ্বকর্মাকে একটি ঘটরূপে পূজা করা হয় এবং ঘটের সামনে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখা হতো।
তবে মহাভারতে উল্লেখ আছে, বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা। হাজার রকমের কারুকার্যের সৃষ্টিকর্তা। দেবতাদের ছুতার মিস্ত্রি, দক্ষ কারিগর ও সব অলংকারের রূপকার।
এ কারণে বঙ্গভূমির ছুতার, কামার, স্বর্ণকার, ধাতুশিল্পের কারিগর ও রাজমিস্ত্রি—এই পাঁচ পেশার শ্রমজীবীরাই প্রধানত বিশ্বকর্মাপূজার প্রচলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিকরাও বিশ্বকর্মাপূজায় নিজেদের নৈবেদ্য নিবেদন করতে থাকেন।
আরও পড়ুনজন্মাষ্টমী: মানবমুক্তির এক ঐশ্বরিক আবির্ভাব১৬ আগস্ট ২০২৫পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বিশ্বকর্মা হলেন স্বয়ম্ভু এবং বিশ্বের স্রষ্টা। তিনিই বিভিন্ন হিন্দু স্থাপত্য গড়ে তুলেছিলেন বলে মনে করা হয়। কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা তাঁর হাতেই গড়া। এ ছাড়া রামায়ণের লঙ্কা নগরী, ব্রহ্মার পুষ্পক রথ, দেবতাদের স্বর্গপুরী, তাঁদের হাতের বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, যেমন বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, ইন্দ্রের বজ্রসহ মহাভারতে পাণ্ডবদের মায়া সভা, হস্তিনাপুর ও ইন্দ্রপ্রস্থ তাঁরই পরিকল্পনায় তৈরি।
এ ছাড়া মৎস্যপুরাণের মতে, কূপ ও জলাশয় খনন, প্রতিমা নির্মাণ, বাড়ি ও বাগানের পরিকল্পনা—এসবও বিশ্বকর্মার মাধ্যমে নির্মিত বলে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন। কিংবদন্তি আছে, পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথদেবের তিন ভাই–বোনের মূর্তিও তিনিই নির্মাণ করেছিলেন।
বিশ্বকর্মাপূজা বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো প্রতিবছর গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের ১৭ সেপ্টেম্বরই (প্রায় প্রতিবছরেই) পালিত হয়ে থাকে এই পূজা। হিন্দুদের অন্যান্য পূজার সময় চাঁদের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ধারিত হলেও বিশ্বকর্মার পূজার সময় সূর্যের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়।
এ নিয়ম অনুসারে সূর্য যখন সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে, তখন উত্তরায়ণের শুরু। এ সময়ে দেবতারা স্বর্গে নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং বিশ্বকর্মার পূজার আয়োজন শুরু করে দেন।
১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয়ে থাকে এই পূজা। হিন্দুদের অন্যান্য পূজার সময় চাঁদের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ধারিত হলেও বিশ্বকর্মার পূজার সময় সূর্যের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়।হিন্দু পঞ্জিকা বলে, বিশ্বকর্মাপূজার দিনটি ‘কন্যা সংক্রান্তি’তে পড়ে। দিনটি ভারতীয় সৌর বর্ষপঞ্জি এবং বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ সৌর ক্যালেন্ডারে ভারতীয় ভাদ্র মাসের শেষ দিন। হিন্দু পঞ্জিকার দুটি প্রধান শাখা—সূর্যসিদ্ধান্ত ও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত। উভয় পঞ্জিকার এই বিষয়ে মত অভিন্ন। সূর্য যেহেতু প্রতি রাশিতে মোটামুটি এক মাস করে অবস্থান করে, তাই বিভিন্ন রাশিতে সূর্যের গমনের দিন স্থির।
প্রায় প্রতিবছরই সূর্য ১৭ সেপ্টেম্বর কন্যা রাশিতে গমন করে আর সেদিনই পালিত হয় বিশ্বকর্মাপূজা। তবে এর পেছনে অন্য কোনো ঐতিহাসিক তথ্য বা কারণ আছে কি না, তা জানা যায় না। এটি এখন প্রথায় পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুনগণেশ চতুর্থী: মঙ্গলের দেবতার আরাধনা২৭ আগস্ট ২০২৫বিশ্বকর্মার জন্ম নিয়ে নানা পৌরাণিক কাহিনি আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে বিশ্বকর্মার জন্ম। আবার ভবিষ্যপুরাণ মতে, অষ্টবসুর অন্যতম প্রভাসের ঔরসে এবং বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনীর গর্ভে বিশ্বকর্মার জন্ম। আবার স্কন্দপুরাণ মতে, বিশ্বকর্মার ৫টি মুখ ও ১০টি হাত।
বিশ্বকর্মার মূর্তি নিয়েও জনমানসে মতভেদ আছে। কখনো তাঁকে দেখা গেছে ব্রহ্মার রূপে, মুখে সাদা দাড়ি। এমনটি ঋগ্বেদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। আবার তাঁকে কখনো তিনটি বা চারটি মাথাতেও দেখা যায়।
কারণ হিসেবে বলা হয়, চতুর্দিকের সব সৃষ্টিকে অনায়াসে দেখতে পাবেন বলেই এমনটা হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর হাতের সংখ্যা অধিকাংশ সময়েই চারটে কিংবা তার বেশি। বাহন হিসেবে দেখা যায় পাঁচটি সাদা হাতি।
পরবর্তী সময়ে একটিমাত্র কালো হাতিই থাকে বাহন হিসেবে। এখনকার বিশ্বকর্মার রূপে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যেমন এখন তাঁর বাহন হিসেবে হাতি থাকে, চারটি হাত আর একটি মাথা দেখা যায় প্রতিমায়। মুখমণ্ডল দাড়িবিহীন। তবে সরু করে ছাঁটা গোঁফের রেখা থাকে।
এই পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘুড়ি উত্সবও। এদিন বাড়ির ছাদে বা বড় খোলা মাঠের প্রাঙ্গণে আবালবৃদ্ধবণিতাকে রংবেরঙের নানা আকারের, নানা নামের ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়।বিশ্বকর্মা সম্পর্কে বেদে এমন বর্ণনা আছে, ‘তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের পিতা, যিনি সমস্ত স্থান ও প্রাণের তদারককর্তা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা।’
বিশ্বকর্মাপূজার চল সাধারণত বেশির ভাগ কলকারখানায় থাকলেও এই পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘুড়ি উত্সবও। এদিন বাড়ির ছাদে বা বড় খোলা মাঠের প্রাঙ্গণে আবালবৃদ্ধবণিতাকে রংবেরঙের নানা আকারের, নানা নামের ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়। এক পক্ষ অপর পক্ষের ঘুড়ি কেটে দিলে সেই পক্ষ ভোঁ-কাট্টা বলে দুয়ো দিতে থাকে। সে এক আনন্দমুখর খেলা বটে!
বিশ্বকর্মাপূজার দিন হিন্দু বাঙালি পরিবারে আবার রান্না পূজার চল আছে। রান্না পূজা আসলে একধরনের প্রাচীন শস্যোৎসব। একে অরন্ধন পূজাও বলা হয়ে থাকে। আগের দিনের রান্না করা খাবার খাওয়া হয় এই দিনে। নবান্নের মতোই বাংলার আরও একটি শস্য উৎসবের নাম রান্না পূজা।
বিশ্বকর্মাকে কিন্তু কৃষিরও দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। সূর্যের অবস্থানের সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে, যার সঙ্গে কৃষিকাজ জড়িত। আর সেই উপলক্ষেই শস্য উৎসব উদ্যাপিত হয় এই রান্না পূজার মধ্য দিয়েই।
দীপান্বিতা দে: শিশুতোষ গ্রন্থপ্রণেতা ও প্রাবন্ধিক
আরও পড়ুনরাখিবন্ধন: ভেদাভেদ ভুলে মানবতার উৎসব০৯ আগস্ট ২০২৫