১৭ মার্চ সকাল সাড়ে ৭টায় নামলাম মালদ্বীপ ভেলেনা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। সাগরের কোলঘেঁষা এ বিমানবন্দর থেকে চোখে পড়ল সারি সারি সি প্লেন, ইয়ট, স্পিডবোট আর বিলাসবহুল জলযান। ফেরিতে চড়ে চার কিলোমিটার দূরে মালে শহরে প্রবেশ করলাম। এরপর শহরের আর্কিড মাগু এলাকায় হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। চলে গেলাম সমুদ্রতীরে। রোজার দিন থাকায় খুব ভোরে শহরে কোনো লোকের আনাগোনা তেমন চোখে পড়ল না।
পরদিন ভোরে বেরিয়ে উপভোগ করলাম সমুদ্রের ঘননীল জলের সৌন্দর্য। শুনলাম সমুদ্রের গর্জন। তবে মালে শহরে রাস্তায় মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা, যানজট চোখে পড়ল না। সহকর্মী জাহাঙ্গীর খান বাবুকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটলাম সমুদ্রের তীর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে কখনও নারকেল বাগান, কখনও ঝাউবনের ছায়াপথ পেরুলাম। টানা তিন দিন ঘুরে বেড়ালাম পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দেশ মালদ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মালে শহরের নানা প্রান্তে। ভারত মহাসাগরবেষ্টিত ছোট-বড় প্রায় ১ হাজার ২০০ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত মালদ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দেশ। বারবার মনে হচ্ছিল, সৌন্দর্যমণ্ডিত এ দেশটি না দেখলে হয়তো জীবনের ভ্রমণের একটি অংশ অপূর্ণই থেকে যেত।
শ্রীলঙ্কান প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীর দ্বীপ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মালাদ্বীপ থেকে, যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। সংস্কৃত শব্দ ‘দ্বীপমালা’ শব্দ থেকে মালদ্বীপ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, দ্বাদশ শতক থেকে মালদ্বীপে মুসলিম শাসন বিদ্যমান। ইবনে বতুতা মালদ্বীপ গিয়েছিলেন ১৩৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। ১১৫৩ থেকে ১৯৫৩– এই ৮০০ বছর ৯২ জন সুলতান নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসন করেছেন দ্বীপটি। ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে মালদ্বীপ।
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শান্ত-মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। এখানে পানির রং নীল আর বালুর রং সাদা। সমুদ্রের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা মালদ্বীপের সব দ্বীপের চারদিকে ঘিরে রয়েছে সাগরের অফুরন্ত জলরাশি; যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বিধাতা যেন দুই হাত ভরে প্রকৃতির মায়াবী রূপে সাজিয়েছেন দেশটিকে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, স্বর্গের দ্বীপ, প্রকৃতির কন্যা এ দ্বীপরাষ্ট্র। দেখে মনে হলো, ছোট ছোট দ্বীপ যেন নানা রঙে সেজে হাতছানি দিয়ে ডাকছে পর্যটকদের। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য দেশটি খুবই পছন্দের। এখানকার সৈকতগুলোর সৌন্দর্য অতুলনীয়।
আধুনিক শহর হুলহুমালে রয়েছে বিচ, সেন্ট্রাল পার্ক, সমুদ্র পার্ক, এইচডিসি বিল্ডিং এবং হুকুরু মিসকি মসজিদ। এ ছাড়া শহরের দক্ষিণে মাফুসি দ্বীপে রয়েছে বিলাসবহুল রিসোর্ট। পাশাপাশি বিমানবন্দর, বিলিংগিলি, ধোনিদোসহ রয়েছে বড় বড় অবকাশ যাপন কেন্দ্র (রিসোর্ট)। এখানকার ভিলিগিন দ্বীপ ভ্রমণে মজাই আলাদা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মালদ্বীপের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন। এক ঋতুর দেশ মালদ্বীপের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম মিলে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। এর মধ্যে ফুলহাদু আইল্যান্ড, ভাদু আইল্যান্ড, ইথা আন্ডারসি রেস্টুরেন্ট, ব্যানানা রিফ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ভিলিমালে দ্বীপ, টিলাভুসি দ্বীপ, ধর্মবান্ধা পার্কও বেশ জনপ্রিয়। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দিনে দিনে পর্যটকরা অনায়াসে ছুটে বেড়াতে পারেন এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে। তবে রিসোর্টগুলো ব্যয়বহুল ও খাবারের খরচ আকাশছোঁয়া। দেশটিতে ঐতিহ্যবাহী জাতীয় জাদুঘরের পাশাপাশি রয়েছে নানা দর্শনীয় স্থান। বিভিন্ন শহরের রাস্তার দু’ধারে বসে রঙিন বাজার।
পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র মালদ্বীপে বিশালকায় হোয়েল সাবমেরিনে করে সমুদ্রের তলদেশে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ করা যায়। পর্যটকদের ১২০ ফুট গভীর সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত নিয়ে যায় এ যান। সেখানে বিশাল বিশাল রঙিন মাছ, হলুদ বক্স ফিশ, নীল স্ন্যাপার, লায়ন ফিশ, নানা ধরনের গাছ, ভয়ংকর জলজ প্রাণী, কচ্ছপ, হাঙর ও পাহাড় দেখে মুগ্ধ হন পর্যটকরা। সাগরবেষ্টিত মালদ্বীপে পাওয়া যায় ঐতিহ্যবাহী গারদিয়া খাবার সামুদ্রিক মাছ। রয়েছে সুস্বাদু খাবার টুনা মাছ ও স্যুপ। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কবুতর পার্কের পশ্চিমে অলিভ গার্ডেনে বসে কফির আড্ডা।
মালে শহর ঘুরে উপভোগ করার মতো অনেক আকর্ষণীয় জিনিস চোখে পড়বে। শহরের প্রধান ইজাজউদ্দিন জেটির পাশে অবস্থিত কবুতর পার্ক, বিশ্বের অন্যতম গ্রান্ড ফ্রাইডে মসজিদ। এ ছাড়া জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে দেশটির সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কেও ধারণা পেতে পারেন। পরিকল্পিত বাসস্থান, নাগরিক সুবিধাসহ দোকানপাট, সুন্দর ও বিলাসবহুল দোতলা নগর বাস, ট্যাক্সি, মোটরসাইকেল, স্কুটি সবই আছে মালদ্বীপের বিভিন্ন শহরে। এখানকার মানুষগুলো পর্যটকবান্ধব আর অসম্ভব ভালো মনের। নেই চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই। রাস্তায় নেই কোনো পুলিশ। চোখে পড়েনি রিকশা, ভ্যান, বেবিট্যাক্সি। নেই হর্ন, গাড়ির আওয়াজ, এমন কি সড়ক দুর্ঘটনা। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ মালদ্বীপের সামাজিক কাঠামোকে বদলে দিয়েছে।
দেশটির বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেল, ৫ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লক্ষাধিক বাংলাদেশি মালদ্বীপে বসবাস করছেন। পাশাপাশি প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসছেন মালদ্বীপের সৌন্দর্য দর্শনে। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার শ্রীমন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা মালদ্বীপপ্রবাসী ব্যবসায়ী মো.
অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিলাসিতার দেশ মালদ্বীপ। সময়, সুযোগ মিললে আবারও হয়তো ঘুরে আসব সাগরবেষ্টিত সুন্দর এ দেশটিতে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কাপ্তাই হ্রদে পানি বেড়ে ডুবে গেছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই হ্রদে পানি বেড়ে যাওয়ায় ডুবে গেছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু। দুর্ঘটনা এড়াতে পর্যটকদের সেতুটিতে উঠতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাঙামাটি পর্যটক কমপ্লেক্স।
পর্যটক কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে গত সোমবার সেতুর কিছু অংশে পাটাতনের ওপর পানি ওঠে। তবে আজ বুধবার সকাল ছয়টার দিকে পানি বেড়ে সেতুটি তলিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে সকাল ১০টার দিকে সেতুতে উঠতে পর্যটকদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেতুর পাটাতনের ওপর এখন চার ইঞ্চির মতো পানি রয়েছে। পর্যটকদের জন্য সেতুতে উঠতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও নিকটবর্তী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা সেতু দিয়ে পারাপার করতে পারবেন।’