কেউ মাসের সব দিনই অনুপস্থিত। কেউ মাসে দু-চার দিন অফিসে পা রাখলেও আসছেন দেরিতে। রাজনৈতিক পালাবদলের পর এই ধারা চললেও মাস ফুরালে সময়মতো পাচ্ছেন বেতন। তারা সবাই ঢাকা ওয়াসার বিএনপিপন্থি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা।

যেটুকু সময় ওয়াসার কার্যালয়ে তাদের দেখা যায়, সে সময়টা দলীয় কার্যক্রম বা বদলি-নিয়োগ তদবিরেই ব্যস্ত থাকেন। তাদের দাপট এতটাই বেশি, কেউ কিছু বলার সাহস দেখান না। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বদলে উল্টো তাদের বাড়তি আবদার মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অফিস ফাঁকি ঠেকাতে ২০১৮ সালে ওয়াসার সে সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান প্রধান কার্যালয়সহ প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু করেন। তখন থেকেই কর্মকর্তা­-কর্মচারীরা বায়োমেট্রিক যন্ত্রে হাতের আঙুল চেপে বা মুখ দেখিয়ে কার্যালয়ে উপস্থিতি জানান দিতেন। আগের ওয়াসা প্রশাসনও হাজিরার ব্যাপারে বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। তখন ওয়াসায় সিবিএ (কালেক্টিভ বার্গেনিং অথরিটি) নেতাদের দৌরাত্ম্য বাড়তে দেননি তাকসিম। গেল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপিপন্থি সিবিএ নেতারা রাতারাতি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দাপট দেখিয়ে ওয়াসা ভবনের চারতলায় দুই হাজার বর্গফুটের একটি কার্যালয়ও বরাদ্দ নেন তারা। এতে সিবিএ নেতাদের প্রভাব আরও বেড়ে যায়।

সিবিএর শীর্ষ তিন নেতার হাজিরার তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, কর্মস্থলে সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত থাকছেন সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন পাটোয়ারী। তিনি গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত আট মাসে মাত্র চার দিন কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ওই চার দিনও তিনি নির্ধারিত সময়ের পর কর্মস্থলে হাজির হন। হাজিরা তথ্য বিবরণীতে ওই চার দিন সম্পর্কে লেখা ‘লেট ডে’। মনির পাম্প অপারেটর হিসেবে কর্মরত। তাঁর কর্মস্থল মডস জোন-৬ (শাহবাগ-মতিঝিল-খিলগাঁও এলাকা)।  

মনিরের হাজিরা বিবরণীতে দেখা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে তাঁর কর্মদিবস ছিল ২১ দিন। আট দিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি, আরেক দিন ছিল ঈদে মিলাদুন্নবীর সরকারি ছুটি। ওই মাসের প্রতিদিনই তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। একইভাবে গত অক্টোবরের ২১ কর্মদিবসের প্রতিদিনই তিনি অনুপস্থিত থেকেছেন। দু’দিন দুর্গাপূজা আর আট দিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। একইভাবে নভেম্বরের ২০ কর্মদিবসের ২০ দিন ও ডিসেম্বরের ২১ কর্মদিবসের মধ্যে ২১ দিন, জানুয়ারির ২২ দিন, ফেব্রুয়ারির ২০ কর্মদিবসই ছিলেন অনুপস্থিত। আর গত মার্চের ১৯ কর্মদিবসের মধ্যে ১৫ দিন ছিলেন অনুপস্থিত। ওই মাসে মাত্র চার দিন তিনি অফিসে গেছেন, তাও দেরিতে। 

একইভাবে সিবিএর সভাপতি আজিজুল আলম খান গত আট মাসে অফিস করেছেন মাত্র ১১ দিন। গত সেপ্টেম্বরে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে ১৪ দিনই অফিসে ছিলেন অনুপস্থিত। বাকি সাত দিন অফিসে যান দেরিতে। অক্টোবরে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে ১৭ দিন ছিলেন অনুপস্থিত। বাকি চার দিন অফিসে গেছেন দেরিতে। আবার নভেম্বরে ২০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিদিনই ছিলেন অনুপস্থিত। একইভাবে ডিসেম্বরের ২১ কর্মদিবসের মধ্যে ২১ দিন, জানুয়ারির ২২ কর্মদিবসের মধ্যে ২২ দিন, ফেব্রুয়ারির ২০ কর্মদিবসের মধ্যে ২০ দিন এবং মার্চের ১৯ কর্মদিবসের মধ্যে ১৯ দিনই ছিলেন অনুপস্থিত। তিনি ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক। 

সিবিএর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গত আট মাসে কর্মস্থলে উপস্থিত হয়েছেন মাত্র পাঁচ দিন। তিনিও প্রতিদিন কর্মস্থলে যান দেরিতে। তাঁর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ওভারটাইমও আছে। এই ওভারটাইমের টাকাও তিনি পেয়েছেন। তিনি সেপ্টেম্বরের ২১ কর্মদিবসের মধ্যে ১৬ দিন ছিলেন অনুপস্থিত। ৫ দিন দেরিতে অফিসে গেছেন। ৩ ঘণ্টা ২৮ মিনিট ওভারটাইম করেছেন। ওই মাসে তাঁর মোট কর্মঘণ্টা ছিল ৯ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট। আর গত মার্চে তিনি ১৯ কর্মদিবসের সব দিনই ছিলেন অনুপস্থিত। তাঁর পদবি অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি। তাঁর কর্মস্থল মডস জোন-২ (পুরান ঢাকা)। প্রায় একই রকম হাজিরার  হাল জোন-২-এর রাজস্ব পরিদর্শক বজলুল করিম, উচ্চমান সহকারী মাহবুবুর রহমান ও মো.

সেলিমের ক্ষেত্রেও। 

এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার সিবিএর সভাপতি আজিজুল আলম খান সমকালকে বলেন, ‘কিছু বায়োমেট্রিক মেশিন বিকল। অনেকের হাজিরা বায়োমেট্রিক মেশিন নেয় না। তারা হাজিরা খাতায় সই করেন। আমি নিজেও হাজিরা খাতায় সই করি। হয়তো অসুস্থতাজনিত করণে দু-একদিন অফিসে যেতে একটু দেরি হতে পারে।’

ঢাকা ওয়াসার এমডি ফজলুর রহমান বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখব, এ রকম ঘটনা ঘটছে কিনা। কেউ এ রকম করে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স প ট ম বর দ ন অফ স একইভ ব স ব এর ম বর র

এছাড়াও পড়ুন:

খুলনায় এক মাসে ১৩ লাশ উদ্ধার, বাড়ছে উদ্বেগ

বাড়িতে ঝগড়া চলছিল বড় ভাই ও ভাবির। ছোট ভাই এসে ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথায় শাবল দিয়ে আঘাত করেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ধারালো বঁটি দিয়ে ছোট ভাইকে হত্যা করেন। পরে বড় ভাই শহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩০ মে, খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামে।

এর আগে ২৭ মে কয়রার ইসলামপুর গ্রামের কয়রা নদীর চর থেকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় আবদুল মজিদ (৬২) নামের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ছাড়া ৮ জুন কয়রার কাছারিবাড়ি বাজার-সংলগ্ন পুকুর থেকে নমিতা (৪০) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

১০ জুন কয়রা সদরের গোবরা সড়কে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে এক মোটরসাইকেলচালকের কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন অন্তত ১৫ জন। ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া কথা-কাটাকাটির জেরে কয়রার পল্লীমঙ্গল গ্রামে গত তিন দিনে কয়েক দফা মারামারি, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

অসন্তোষ-দ্বন্দ্বের জেরে কয়রা উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা–সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ১০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত এক মাসে খুলনার ১০টি থানা এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ ১৩টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান কমে যাওয়ায় মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মূল্যবোধ ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ও ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। এতে খুনখারাবি বাড়ছে। একসময় সমাজের একজনের ভালোতে সবাই আনন্দ পেতেন। নেতিবাচক দিকগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতেন। এখন সেই ব্যবস্থা উঠেই গেছে বলা যায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে প্রভাববলয় সৃষ্টি করতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।

৩ জুন খুলনা শহরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে সবুজ হাওলাদার (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৪ জুন খুলনা সদর থানার মতিয়াখালী খালের মধ্যে আটকে ছিল এক নারীর মরদেহ। পরে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। ওই নারীর পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুলে দাফন করা হয়। গত ৯ জুন বিকেলে রূপসা উপজেলার আঠারোবেকী নদীতে পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ। মরদেহের শ্বাসনালিতে গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। রূপসা নৌ পুলিশের ওসি আবুল খায়ের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।

এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রহস্য উদ্‌ঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই অপরাধ বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি তরিকুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে দোষীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধ বেড়ে চলেছে।

কয়রা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে প্রতিটি ঘটনায় পুলিশও তাৎক্ষণিকভাবে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে বিষয়গুলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায়, সেখানে খুনাখুনি, অস্থিরতা, মামলা-হামলার মধ্য দিয়ে একধরনের বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে; যা সবার জন্যই অকল্যাণকর ও ভয়ানক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ