বিপাকে পড়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ। আরও বড় বিপাকে পড়েছেন তাঁর ছেলে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। তাঁদের বিপাকে ফেলেছেন ভারতের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ও ‘র’-এর সাবেক শীর্ষ কর্তা অমরজিৎ সিং দুলাত।

অমরজিৎ তাঁর লেখা বই ‘দ্য চিফ মিনিস্টার অ্যান্ড দ্য স্পাই’-এ লিখেছেন, ফারুক সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পক্ষে ছিলেন। তাঁর কাছে আক্ষেপ করে ফারুক বলেছিলেন, দিল্লি এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি বিধানসভায় অনুচ্ছেদটি বাতিলের ব্যবস্থা করতে পারতেন।

অমরজিতের এই মন্তব্য ‘কল্পনার রূপকথা’ বলে জানিয়েছে ফারুকের দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)। সাবেক মুখ্যমন্ত্রীও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বই বিক্রির জন্য অমরজিৎ সস্তা স্টান্টবাজি করছেন। বইটা আগাগোড়া ভুলে ভরা। দুঃখের বিষয় এই যে আমাকে বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েও অমরজিৎ এত ভুলভাল লেখা লিখলেন।’

জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা রদ করা হয় ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য ভেঙে করা হয় দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। একটি জম্মু-কাশ্মীর, অন্যটি লাদাখ। কেন্দ্রীয় সরকার বড়সড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আঁচ করে এক দিন আগেই দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেছিলেন ফারুক ও তাঁর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ। তার পরেই তাঁদের বন্দী করা হয়।

বইয়ে অমরজিৎ লিখেছেন, ৩৭০ খারিজের পর বন্দী ফারুক ও ওমরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন দিল্লির দূতেরা। তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন, ফারুক যেন ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করেন। বিরোধিতা করলে পাকিস্তান সারা বিশ্বে তা প্রচার করে বেড়াবে।

অমরজিতের দাবি, সেই সময় ফারুক তাঁর কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, চাপে পড়ে কেন্দ্র তাঁর সাহায্য নিতে চেয়েছিল। অথচ আগে থেকে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা হলে তিনি নিজেই রাজ্যের বিধানসভায় ওই–সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে পারতেন।
এই দাবি সরাসরি নাকচ করে ফারুক বলেছেন, ‘অমরজিতের দাবি তথ্যনির্ভর নয়। সম্পূর্ণ ভুল। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সময় আমরা বন্দী। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে বলেছিলেন আমরা মুক্ত। তার পরেই আমি গণমাধ্যমে মুখ খুলি। সেই রাতেই আমাদের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইন (পিএসএ) প্রয়োগ করা হয়।’

ফারুক আবদুল্লাহ আরও  বলেন, ‘ওই দাবি সত্যই যদি হবে, তা হলে ৩৭০ বহাল রাখা নিয়ে ১৯৯৬ সালে আমি কেন প্রস্তাব পাস করাব?’

অমরজিতের দাবি ও আবদুল্লাহ পরিবারের অস্বীকার জম্মু-কাশ্মীরের রাজনীতিকে চনমনে করে তুলেছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই শাসক ন্যাশনাল কনফারেন্সের স্পিকার বিধানসভায় ওয়াক্ফ আইন নিয়ে বিরোধীদের আলোচনার দাবি নাকচ করে দিয়েছিলেন।

সরকারের যুক্তি ছিল, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। তাই আলোচনা নয়। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল পিডিপিসহ অন্যরা। বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপির সঙ্গে তলেতলে আঁতাত করে চলছে ন্যাশনাল কনফারেন্স।
এই পরিস্থিতিতে অমরজিতের নতুন বইয়ের চাঞ্চল্যকর দাবি আবদুল্লাহ পরিবারসহ শাসক দলকে বিপাকে ফেলেছে। পিপলস কনফারেন্স দলের নেতা সাজ্জাদ লোন বলেছেন, অমরজিতের এই দাবি বিশ্বাসযোগ্য মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মোটেই বিস্মিত নই। কারণ, ঠিক একদিন আগে ৪ আগস্ট পিতা-পুত্র দুজনেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কেন সেই সাক্ষাৎ তা আজও রহস্যাবৃত।’

পিডিপি নেতা ওয়াহিদুর রহমান বলেছেন, দেশের সাবেক গোয়েন্দা ন্যাশনাল কনফারেন্সের মুখোশ টান মেরে খুলে দিয়েছেন। পিডিপি নেত্রী ইলতিজা মুফতি ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘ফারুক কেমন দিল্লির বেআইনি কাজের দোসর ছিলেন, অমরজিৎ তা জানিয়ে দিয়েছেন।’

অমরজিতের বই বিজেপির হাতেও তুলে দিয়েছে এক মোক্ষম অস্ত্র। জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপির মুখপাত্র আলতাফ ঠাকুরের মন্তব্য, অমরজিতের মতো মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেন না। ৩৭০ অনুচ্ছেদ যে বাতিল হতে চলেছে, ন্যাশনাল কনফারেন্স তা জানত। তারা ওই সিদ্ধান্ত অনুমোদনও করেছিল।

অমরজিৎ সিং দুলাত তাঁর এই বইয়ে ফারুক আবদুল্লাহর নামে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ফারুককে ‘ব্রিলিয়ান্ট’, ‘গ্রেট’ বলে বারবার অভিহিত করেছেন। বলেছেন, তিনি ‘দেশপ্রেমিক’ও ‘জাতীয়তাবাদী’।

অমরজিৎ লিখেছেন, রাজনীতির খেলায় ফারুক দিল্লির চেয়ে সব সময় দুই কদম এগিয়ে থাকতেন। মুক্তির আগে বন্দী ফারুকের কাছে দিল্লি যখন তাঁকে পাঠিয়েছিল, চুপ থাকার প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন রাজি হয়ে ফারুক তাঁকে বলেছিলেন, মিডিয়ার কাছে তিনি মুখ খুলবেন না। পাকিস্তান নিয়েও কিছু বলবেন না। যা বলার সংসদে বলবেন। তিনি বলেছিলেন, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের ওপর তাঁর আস্থা আছে।

আরেক জায়গায় লিখেছেন, ফারুক তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার বাবার (শেখ আবদুল্লাহ) মতো নই। ১২ বছর জেলে কাটাতে হবে বলে আমি রাজনীতিতে আসিনি। দিল্লিতে যারা ক্ষমতায় থাকবে, আমি সব সময় তাদের সঙ্গে থাকব।’

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে অমরজিৎ বলেছেন, সংবাদপত্রের সমালোচনায় কান না দিয়ে ফারুক বরং বইটি আদ্যোপান্ত মন দিয়ে পড়ুন। বইয়ে তাঁর প্রশংসাই করা হয়েছে। সমালোচনা নয়।

‘র’-এর সাবেক প্রধান বলেন, ‘ডক্টর সাব সব সময় আমার বন্ধুই থাকবেন। আমি জানি দিল্লি এলে তিনি আমার বোনকে ঠিক দেখতে আসবেন, যিনি তিন সপ্তাহ ধরে শয্যাশায়ী।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ র ক আবদ ল ল হ ম খ যমন ত র কর ছ ল ন বল ছ ল ন বল ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য

কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।

মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।

দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।

লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।

দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।

জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।

রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।

দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ