আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তৈলের মূল্য নিম্নমুখী হইলেও দেশীয় বাজারে উহার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলমান বলিয়া জানাইয়াছে শুক্রবারের সমকাল। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তৈলের গড় মূল্য ছিল ১ সহস্র ৬৬৭ ডলার। গত জানুয়ারি হইতে মার্চ পর্যন্ত যাহা ছিল ১ সহস্র ৪০ ডলার। এপ্রিল মাসে উহা আরও নিম্নগামী। অথচ দেশের বাজারে এই তৈল বিক্রয় হইতেছে অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার লিটারে ১৪ টাকা বৃদ্ধি করিয়া বোতলজাত সয়াবিন তৈলের মূল্য নির্ধারণ করিয়াছে ১৮৯ টাকা। খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের নূতন মূল্য নির্ধারণ করা হইয়াছে প্রতি লিটার ১৬৯ টাকা, যাহা এতদিন ছিল ১৫৭ টাকা। সহজলভ্য ছিল বলিয়া বিশেষত ১৯৮০-এর দশক হইতে দেশে সয়াবিন তৈলের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়াছে। অভ্যস্ত হইয়া পড়ায় মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মানুষ রন্ধনকর্মে সয়াবিন তৈলই ব্যবহার করে। ভোক্তাদের একটা অংশ মূল্য কম বলিয়া সয়াবিনের বিকল্পরূপে পাম অয়েলও ব্যবহার করিয়া থাকে, যদিও পাম অয়েল কতটা স্বাস্থ্যহিতকর, ইহা লইয়া বিতর্ক কম নাই। এমনকি সয়াবিন তৈল যেই প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করা হয়, উহার ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি লইয়াও উদ্বেগ বিস্তর। তথাপি এই দুই প্রকারের তৈলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের অধিকাংশ মানুষের, বিশেষত সীমিত ও নিম্ন আয়ভুক্তদের জন্য বড় কষ্টের কারণ। এই মূল্যবৃদ্ধি এমন সময়ে ঘটিল যখন তিন বৎসর পূর্বে সৃষ্ট সকল নিত্যপণ্যের মূল্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখনও বিরাজমান। বিশেষত বিগত সরকারের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য কয়েক দফা বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাইয়াছে। সামগ্রিকভাবে গতিহীন হইয়া পড়া জাতীয় অর্থনীতির কারণেও অধিকাংশ মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাস পাইয়াছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা দাবি করিয়াছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং যথাসময়ে ব্যাংকের সহায়তা না পাইবার কারণে বিশ্ববাজারে মূল্যহ্রাসের সুফল পাইতেছেন না দেশের ভোক্তারা। ভোজ্যতৈলে এখনও নাকি তাহারা লোকসান গুনিতেছেন। কিন্তু যখন কর-শুল্ক প্রত্যাহার ও হ্রাস করা হইয়াছিল, তখনও তো উহার সুবিধা ভোক্তাদের পকেটে যায় নাই। আমরা মনে করি, ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন ক্যাবের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন যে বলিয়াছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতৈলের মূল্য বৃদ্ধি পাইলে ব্যবসায়ীরা বাতাসের আগে তাহা দেশে কার্যকর করেন, কিন্তু মূল্য কম থাকিলে অজুহাত দেন ডলারের, ব্যাংকের, কাস্টমসের– উহা অমূলক নহে। শুধু উহাই নহে, ভোজ্যতৈল আমদানিকারকরা সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির পূর্বেও বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন বলিয়া অভিযোগ উঠিয়াছে, যাহা অতীতেও বহুবার পরিলক্ষিত। ভোক্তাদের জিম্মি করিয়া পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এহেন অপচেষ্টা প্রচলিত আইনে এক প্রকার অপরাধ। রহস্যজনক হইল,
ইহা জানিবার পরও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ বাজার হইতে তৈল গায়েব করিবার সহিত যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। ইহাতে প্রমাণিত, পূর্বসূরিদের ন্যায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষার পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই কার্যত রক্ষা করিতেছেন।
প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হইয়াছে, ভোজ্যতৈল আমদানির ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী পাঁচ-ছয়টি কোম্পানি। অর্থাৎ অন্য অনেক খাতের ন্যায় এই খাতেও সিন্ডিকেশনের সুযোগ বিদ্যমান। দেশে ভোগ্যপণ্যের সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও বলিয়াছেন, মূলত বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাসের পর আমদানিকারকরা এসও (সরবরাহ আদেশ) বিক্রয় হ্রাস করিয়া দেন। তদুপরি, এসও অনুসারে পণ্য সরবরাহও হয় নাই। পরিণামে বাজারে সৃষ্ট তৈলের ঘাটতির সুবাদে বেশ কয়েক মাস বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় হইয়াছে ভোজ্যতৈল। এমনকি সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির পরও খাতুনগঞ্জে চাহিদানুসারে ভোজ্যতৈল ছিল না বলিয়া জানা যায়। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার এহেন পরিস্থিতি অনুধাবন করিয়া ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ জ যত ল ব যবস য় সরক র হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’