শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন দিনমজুর বিল্লাল হোসেন (৫৫)। শরীরে রক্তস্বল্পতার কারণে চিকিৎসক তাঁকে পরামর্শ দেন বাড়তি রক্ত দেওয়ার জন্য। সে অনুযায়ী হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে আনা হয় ভুল গ্রুপের রক্ত। সেই রক্তই শরীরে সঞ্চালন করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্স। কিছুক্ষণের মধ্যে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় তাঁর। বিষয়টি বুঝতে পেরে নার্সরা তড়িঘড়ি করে রক্তের ব্যাগ ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন। কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান বিল্লাল।
শুক্রবার রাত ১০টার দিকে মৃত্যু হয় বিল্লালের। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার খাগড়াকুড়ি গ্রামে। পেশায় মাটিকাটার এই শ্রমিক মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বুধবার। স্বজন জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকেলে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে বিল্লালের জন্য রক্ত সরবরাহ করা হয়। বিকেল ৪টার দিকে চিকিৎসকের পরামর্শে নার্সরা সেই রক্ত সঞ্চালন করেন। বিল্লাল হোসেনের রক্ত ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের হলেও তাঁর শরীরে পুশ করা হয় ‘বি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত। কিছু রক্ত শরীরে যাওয়ার পর রোগীর অবস্থার অবনতি হয়।
মেয়ে সেলিনা আক্তারের অভিযোগ, তাঁর বাবার শরীরে ভুল গ্রুপের রক্ত দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারার পরপরই চিকিৎসক-নার্সদের ডাকাডাকি করেন। কিন্তু তারা কেউই এগিয়ে আসেননি। উল্টো নার্সেরা তড়িঘড়ি করে রক্তের ব্যাগ ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন। রাত ৮টার দিকে অন্য এক চিকিৎসক এসে রোগীর অবস্থা দেখে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। রাত ১০টার দিকে মানিকগঞ্জ মেডিকেলেই তাঁর বাবা মারা যান।
এ ঘটনায় বিল্লালের ক্ষুব্ধ স্বজন কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে হাসপাতালের একটি কক্ষে প্রায় ৪০ মিনিট অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে অন্য চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এদিন রাত ৮টার দিকে দায়িত্ব শুরু হয়েছিল চিকিৎসক ইশতিয়াক আহমেদের। তাঁর ভাষ্য, বিকেল ৪টার দিকে রক্ত পুশ করার সময় দায়িত্বে ছিলেন মেডিকেল অফিসার নূর জাহান ও ইন্টার্ন চিকিৎসক ঐশী। তিনি দায়িত্ব শুরুর পর সাধ্যমতো রোগীকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর পরও বাঁচানো যায়নি।
বিল্লালের স্বজনের ভাষ্য, তাঁর শরীরে এক চতুর্থাংশ রক্ত যাওয়ার পর ব্যাগ খুলে ফেলা হয়েছিল। একই রকম মন্তব্য করেন চিকিৎসক ইশতিয়াক। তিনি দাবি করেন, রোগীর শরীরে খুব বেশি রক্ত যায়নি। তবে কাগজপত্র না দেখে এভাবে রক্ত দেওয়া ঠিক হয়নি। এটি মারাত্মক ভুল।
এদিকে বিল্লালের মৃত্যুসনদে কী উল্লেখ করা হয়েছে জানতে চাইলে ডা.
২৪ ঘণ্টা পরও মেলেনি লাশ
বিল্লাল হোসেনের নাতনি জামাই সিজান মিয়ার ভাষ্য, তাঁর নানাশ্বশুর মারা গেছেন শুক্রবার রাত ১০টার দিকে। শনিবার সারাদিন তারা লাশকাটা ঘরের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন। কখন ময়নাতদন্ত হবে, বারবার জানতে চাইলেও কেউ কিছু বলেনি। সন্ধ্যার পর পুলিশ জানায়, রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দেওয়া হবে। কিন্তু রাত সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ জানায়, রাতে ময়নাতদন্ত হবে না। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও লাশ না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
বহুদিন আগে বিল্লালের একমাত্র ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর পর থেকে তাঁর দেখাশোনা করেন চার মেয়ে। বিল্লালের জামাতা হাসানের ভাষ্য, জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে তারা লাশ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিকেল পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া যায়নি। অন্য গ্রুপের রক্ত দেওয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ জন্য তারা মানিকগঞ্জ সদর থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।
মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি এস এম আমান উল্লাহ বলেন, এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। শুক্রবার রাত ১২টার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে দেওয়া হয়। সারাদিনেও ময়নাতদন্ত হয়নি। শনিবার রাত ৯টা পর্যন্ত পুলিশ সেখানে অপেক্ষা করে চলে এসেছে।
পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি
এদিকে এসব অভিযোগ জানতে চিকিৎসক নূর জাহার ও ইন্টার্ন চিকিৎসক ঐশীকে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় শনিবার দুপুরে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ (চলতি দায়িত্ব) ডাক্তার আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, ওই ব্যক্তির স্বজনরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে যেতে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু শনিবার বিকেল পর্যন্ত তা মঞ্জুর হয়নি। সন্ধ্যার পর লাশের ময়নাতদন্ত করার জন্য চিকিৎসক ছিলেন না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ন কগঞ জ ম ড ক ল র ন চ ক ৎসক ময়ন তদন ত শ ক রব র র জন য হয় ছ ল ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
তাণ্ডব হচ্ছে ডায়মন্ড নেকলেসের সবুজ লকেট
তান্ডব সিনেমা কি সত্যিই তান্ডব বইছে নাকি অশ্বডিম্ব ছাড়া কিছুই না? সবই মিডিয়ার হাইপ? মোটাদাগে তান্ডবের প্রধান দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায়। সিনেমার গল্পে দেখা যায়, প্রতিশোধ নিতে একদল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের জিম্মি করে স্বাধীনে টিম (শাকিব)। জিম্মিদের সাথে আলোচনা হবে টিভি লাইভে, যেনো দেশবাসী সরাসরি জানতে পারে। কেনো জিম্মি করলো, শুরু হয় শাকিবের গ্রামের গল্প। প্রেম ভালোবাসা, পাওয়া না পাওয়া, আশা-নিরাশা- হতাশার গল্প পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। এর মাঝে উঠে আসে, বেকারত্ব, মামা-চাচার জোর না থাকলে চাকরি না পাওয়ার চিত্র। এই সমস্যার মূলে রয়েছে রাজনীতিবীদ, প্রশাসন, টিভি চ্যানেল ও বড় ব্যবসায়ীরা। এই সুবিধাবাদিশ্রেনি সিন্ডিকেট করে সব কিছু নিজেদের দখলে রাখে, বঞ্চিত হয় দেশের সাধারণ মানুষ। এই হল তাণ্ডবের গল্প। তবে গল্প এখানেই শেষ নয়, এখান থেকে শুরু মাত্র।
সিনেমার শেষের দিকে একবার মনে হতে পারে গল্প শেষ, কিন্তু নিশোর আগমন বাড়তি টুইস্ট যোগ করে। তান্ডবের সিক্যুয়ালে শাকিব, নিশোর লড়াই বেশ জমজমাট হবে, এমন ইংগিত দেওয়া হয়েছে এতে। গল্পে সাবিলা নূরের ট্রাজেডি খুব একটা যুক্ত সঙ্গত ছিল না। পরিণতি ভিন্ন হতে পারতো। গল্পে ইমপেক্ট পড়ে নাই সিয়ামের ক্যামিও চরিত্র। তবে সিনেমা তার চরিত্রে সিয়াম অসাধারণ অভিনয় করেছে। অনেক তারকার ভীড়ে তান্ডবের সব আলো কেড়ে নিয়ে একাই জ্বলজ্বল করছেন শাকিব খান।
চেনা চেনা লাগে: ক্রাইম থ্রিলার জনরার সিনেমা তাণ্ডব। গল্পে থ্রিল আছে তবে ইউনিক না। থ্রিলগুলো খানিকটা ধার করা বলা যায়। কারো কারো মনে হতে পারে, বহু সিনেমার বহু দৃশ্যের সুষম মিশ্রণ। দৃশ্যটি দেখলে, চরিত্রের ডিটেইলটা চেনা চেনা লাগতে পারে। বিশেষ করে গল্পের শুরুতে সবাই মুখোশ পড়ে আসে। এটি বহুল প্রচারিত দৃশ্য কিন্তু ভালো লাগবে। গল্পে শাকিব খান মুখোশ পড়ে যে ভাবে হাত দিয়ে উড়ার মতো করে আসে, এই দৃশ্যও দর্শকদের আনন্দিত করেছে, সিনেমা হলে উল্লাস করেছে। তবে গল্পাংশ, চরিত্রায়ণ যেখান থেকেই মিল থাকুক না কেনো, সব মিলিয়ে সিনেমাটি দেখতে দারুণ লাগবে।
গান: তিনটি গানের মধ্যে “লিচুর বাগান” গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই গানের বিশেষ দিক হলো, বাংলা লোকগানের আধুনিক মিউজিক আয়োজন। এটা দারুণ ব্যাপার। তবে এই ধরণের গান কোক স্টুডিও বাংলায় বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। গল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না এই গান। যদিও গানটি মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট খুব ভালো ছিল। একটি টাইটেল ট্রাক ছিল, সেই গানের শব্দগুলো বুঝতে সমস্যা হয়েছে। রোমান্টিক গানটা শ্রুতিমধুর ছিল।
অভিনয় ও চরিত্রায়ণ: শাকিব খান দারুণ অভিনয় করেছেন। একটা গ্রামের ছেলে আরেকটা গ্যাংস্টার। দুইটা কন্ঠ দুই রকম ছিল। বডি ল্যাগুয়েজ, হাঁটা চলা, কথা বলার ধরণে ভিন্নতা ছিল। গ্যাংস্টারে খষখষে কন্ঠ হওয়াতে চরিত্রের মধ্যে ডায়মেনশন এসেছে। শাকিব দিন দিন অভিনয়ে গড হয়ে উঠছে যেনো। সাবিলা নূর এই চরিত্রের জন্য খুবই মানানসই। এক ঝাঁক তারকা অভিনয় করেছে সিনেমাটিতে। সবাই চরিত্র অনুযায়ী ভালো অভিনয় করেছেন। তবে আলাদা করে বলতে হয় জয়া আহসানের কথা। জয়া ঠিকই নিজের চরিত্রে সেরাটা দিয়েছে, এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে কল্পনা করার সুযোগ ছিল না। আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, নাঈম, সালাউদ্দীন লাভলু, ফজলুর রহমান বাবু, সাইফুল জার্নাল, রোজী সিদ্দিকী নিজ নিজ চরিত্রে দারুণ। যদিও কারো কারো চরিত্র প্রস্ফুটিত হয়নি ঠিক মতো।
সেট, লাইট, কস্টিউম: তান্ডবের সেট লাইট দারুণ। দৃশ্যে আয়োজন, আলোর ব্যবহার খুবই মানানসই। টিভি চ্যানেলের সেট বিশ্বাসযোগ্য ছিল। চরিত্রানুযায়ী পোশাক ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে শাকিব, জয়া, সাবিলার পোশাক সুন্দর লেগেছে। অন্যান্য চরিত্রের পোশাকও ছিল দারুণ।
আবহ সঙ্গীত, সংলাপ: সংলাপ দারুণ। কিছু কিছু গালি দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে। গল্পের সাথে গালিগুলো যথাযথ ভাবেই মানিয়ে গেছে, তাই অশ্লীল লাগে নাই। আবহ সঙ্গীত মনে দাগ না কাটলেও খারাপ লাগে নাই। গল্পের মুড বুঝেই আবহ সঙ্গীত এগিয়ে গেছে। সংলাপে যখন দেশের কথা বলে, তখন বুকিশ লাগে নাই, শুনতে ভালো লেগেছে।
নির্মাণ: আধুনিক নির্মাণের সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। শট ডিজাইন, ট্যাকিং, ক্লোজ আপের ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে পরিচালক। মুভমেন্ট শটগুলো গল্পকে গতিশীল করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। জনবহুল বড় বড় দৃশ্যগুলো ঠিকঠাক তুলে আনা গেছে।
সবশেষে: তাণ্ডব একটি গ্যাংস্টার মুভি। কতগুলো অসৎ লোকের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এই ধরণের মুভি গরম গরম দেখতে ভালো লাগে, বিনোদন পাওয়া যায়, সমাজ বাস্তবতার সাথে মিল পাওয়া যায় কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কোন ইমপেক্ট পড়ে না। শেষ কথা হলো, কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলা সিনেমা সোনালী অতীত পেরিয়ে এখন ডায়মন্ড যুগে প্রবেশ করেছে। তাণ্ডব হলো সেই ডায়মন্ড নেকলেসের সবুজ লকেট।
লেখক: লেখক ও নাট্যকার