মিয়ানমারে গত মাসের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মধ্যে একটি মান্দালয়। ২ এপ্রিল মান্দালয় অভিমুখে যাওয়া চীনের রেডক্রসের ত্রাণবোঝাই গাড়িবহরে গুলি চালায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) দাবি করে, গাড়িবহরটিতে ভারী মেশিনগান দিয়ে গুলি করা হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী দাবি করেছে, রেডক্রসের গাড়িবহর যে যাবে, সেটা আগে থেকে তাদের জানানো হয়নি আর সংকেত দেওয়ার পরও সেগুলো থামেনি।

যদিও কিছু সূত্র জানিয়েছে, এটা অনিচ্ছাকৃত ঘটনা, কিন্তু প্রকৃত কারণ এখনো পরিষ্কার নয়। যে বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না, সেটা হলো মিয়ানমারে চীনা স্বার্থগুলো অব্যাহতভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। মিয়ানমারের গৃহবিবাদে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে চীন। সামরিক জান্তা ও প্রতিরোধী গোষ্ঠী—দুইয়ের সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে চীন, যেটা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গত ২১ মার্চ উত্তর শান রাজ্যের রাজধানী লাশিওতে চীনের বিরুদ্ধে মৌন প্রতিবাদ হয়েছে। সামরিক জান্তা ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) মধ্যকার সংঘাতে বাস্তুচ্যুতরা দুই পক্ষের শান্তি আলোচনায় চীনের মধ্যস্থতার বিরোধিতা করেছেন। প্রতিবাদকারীরা চীনকে মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দাবি জানান। জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের দাবি জানান তাঁরা।

জনগণের হতাশা

মিয়ানমারে চীনবিরোধী মনোভাব যে বাড়ছে, এই প্রতিবাদ সে প্রবণতারই অংশ। সামরিক জান্তার প্রতি সমর্থন, বিতর্কিত প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো—এই তিন কারণে গত কয়েক বছরে মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে চীনের প্রতি হতাশা বেড়েছে।

২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর মান্দালয়ে চীনের দূতাবাসে বোমা হামলা হয়। চীনের পররাস্ট্র মন্ত্রণালয় এ হামলার তিন দিন পর বিবৃতিতে ‘গভীর শোক’ প্রকাশ করে এবং জোরালো নিন্দা জানায়।

চীন মিয়ানমারের সেনা সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তা সত্ত্বেও চীন দেশটির জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এ বাস্তবতা অঞ্চলটিতে জটিল এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

আরও পড়ুনমিয়ানমারের ভূমিকম্প কি সেনাশাসকের পতন ঘটাবে০৬ এপ্রিল ২০২৫

স্বাধীন বিশ্লেষক ডেভিড স্কট ম্যাথিউসন মনে করেন, ‘দূতাবাসে বোমা হামলার পেছনে যারাই থাকুক না কেন, এ ঘটনা এই বার্তা দেয় যে চীনবিরোধী ক্ষোভের কয়েকটি ধারা আছে। সামরিক জান্তা সরকারের প্রতি চীনের সমর্থনের বিরুদ্ধে এবং চীনের সমর্থনে কোয়াং আর্মির লাশিও দখলে নেওয়ার বিরুদ্ধে রয়েছেন অনেকে। ভয়েস অব আমেরিকাকে ম্যাথিউসন বলেন, ‘মিয়ানমারের জনগণের এই ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে চীনকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এই ক্ষোভ শহরাঞ্চলে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে এবং চীনা নাগরিক, চীনা সম্পদ এবং এমনকি মিয়ানমারের চীনা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে পারে।’

এর আগে ২০২৩ সালের মে মাসে সাগায়িং অঞ্চলে চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা চীনের পতাকা ও চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ছবি পুড়িয়েছিলেন। একই ধরনের বিক্ষোভ ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ অন্যত্র হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা মিয়ানমারের জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রতি চীন যেন শ্রদ্ধা দেখায়, সে দাবি জানিয়েছিলেন।

চীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জনগণের অভিযোগ যে গভীর, সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো তারই প্রতিফলন। তারা মনে করে, স্থানীয় জনগণের কল্যাণের চেয়ে চীন তার কৌশলগত স্বার্থকেই গুরুত্ব দেয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা-বক্তব্য

চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তিতিয়াওয়ের গবেষণা সেল এবং ইনসিকিউরিটি ইনসাইট যৌথভাবে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীন ও চীনের লোকদের লক্ষ্য করে ঘৃণা-বক্তব্য নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে।

এই সমীক্ষায় গভীর চীনবিরোধী মনোভাব বেরিয়ে এসেছে। অমানবিক ভাষার ব্যবহার, বলির পাঁঠা বানানো থেকে শুরু করে মিয়ানমারের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ডাক পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।

নেটিজেনরা অর্থনৈতিক ব্যাপার নিয়ে চীনের প্রতি উদ্বিগ্ন। চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা এবং অবকাঠামো খাতে আধিপত্য নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন।

আরও পড়ুনচীন মিয়ানমারে কী করছে১১ অক্টোবর ২০২৪

২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে দ্য ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি মিয়ানমারের (আইএসপি-মিয়ানমার) একটি সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে, প্রধান অংশীজনদের মধ্যে ৫৪ শতাংশই প্রতিবেশী হিসেবে চীনের অবস্থানের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছেন। সিভিল সোসাইটি সংস্থাগুলোর মধ্যে এই মনোভাব আরও জোরালো। এখানে ৭২ শতাংশই মনে করছে, চীন ‘আদৌ ভালো নয়’ অথবা ‘ভালো প্রতিবেশী নয়’। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সশস্ত্র সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের মধ্যে ৫৪ শতাংশ চীনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছে।

চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীন ও চীনের লোকদের লক্ষ্য করে ঘৃণা-বক্তব্য মিয়ানমারে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা যে বাড়ছে, তারই প্রতিফলন।

এই বৈরী পরিবেশ মিয়ানমারে চীনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দাতা সংস্থা ও কূটনৈতিক মিশনগুলোর ওপর ঝুঁকি বাড়ছে। সেগুলো জনক্রোধের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে।

বৈশালী বসু শর্মা কৌশলগত ও অর্থনৈতিক বিষয়ক বিশ্লেষক

দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সশস ত র মন ভ ব

এছাড়াও পড়ুন:

উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে: মির্জা ফখরুল

উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

বৃহস্পতিবার ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিট উচ্চ আদালতে খারিজ করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। 

থাইল্যান্ডের ব্যাংককে চিকিৎসাধীন বিএনপি মহাসচিব ভার্চ্যুয়ালি বলেন, বিচার বিভাগের উচ্চ আদালত আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যেটা হওয়া উচিত সেই ধরনের রায় দিয়েছেন। এই রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে। এটাতে নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের আরেকটা বিজয় হয়েছে।

নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব  বলেন, যেহেতু আদালতে এ বিষয়ে রায় হয়েছে, জনগণের বিজয় হয়েছে সেহেতু সড়ক অবরোধ না রেখে সরে যাবেন। আশা করছি, সরকারের সুমতি হবে, তারা ইশরাককে শপথ দেওয়ার ব্যবস্থা নেবেন।

ইশরাক হোসেনের শপথ নেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান রেখে
তিনি বলেন, আশা করব, মন্ত্রণালয় আর কোনো সমস্যা তৈরি না করে দ্রুত ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা এবং পরিস্থিতিকে সহজ করে তোলবার চেষ্টা করবে।

রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট, এই সংকট দূর করার একটি মাত্র পথ হচ্ছে, অতি দ্রুত নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এখানে অন্য কথা বলে লাভ নেই। কারণ সংস্কারের যে বিষয়টা আছে সেটা চলমান প্রক্রিয়া। 

তিনি আরও বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অতি দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলো যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো তারা ঘোষণা করবেন। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য করে সনদ তৈরি করবেন। সুতরাং এটা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করা কিংবা এটা নিয়ে টানাহেঁচড়া করা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে। সেই কারণে জনগণের প্রত্যাশা, অতি দ্রুত একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং চলমান যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করবেন। আর যেসব সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না সেগুলো সনদের ভেতরে নিয়ে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে রাখবেন।

গত ১৪ মে চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য বিএনপি মহাসচিব ব্যাংকক যান। পরদিন ব্যাংকক রুটনিন আই হসপিটালে তার বাম চোখে সফল অস্ত্রোপচার হয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে থেকে নির্বাচনে জিতলে তাকে মেনে নেব: গয়েশ্ব
  • উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে: মির্জা ফখরুল
  • বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে সরে যেতে অনুরোধ ফখরুলের
  • অষ্টম সংশোধনী রায় কি হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের বাধা
  • পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষায় গণশুনানির সিদ্ধান্ত
  • ইসি আর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নেই, বিএনপির দলীয় কার্যালয় হয়েছে: নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী
  • গাইবান্ধায় ১ টন চালসহ ডিলার আটক
  • ইসরায়েলকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের
  • অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পুঁজিবাজার গুরুত্বপূর্ণ: ডিএসই পরিচালক
  • জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান সারজিস, বর্ণনা করলেন ‘উপকারিতা’