দারিদ্র্যের ঝড়ে ঝরছে শিক্ষার স্বপ্ন
Published: 21st, April 2025 GMT
রংপুর নগরীর বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় আশপাশের সাতটি বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় এই কেন্দ্র থেকে অংশ নিচ্ছে নিয়মিত ৩৭৭ জন শিক্ষার্থী। এর বাইরে গত বছরের গণিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ৩৫ জনের কেন্দ্রও এটি। গতকাল সোমবার গণিত পরীক্ষার দিনে নিয়মিত চারজন ও অনিয়মিত একজন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। সব মিলিয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে রংপুর বিভাগের আট জেলায় এদিন পরীক্ষা দিতে আসেনি ২০৪ জন।
বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এবার কোনো পরীক্ষাই দিতে আসেনি তালুক হাবু উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল মিয়া। তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কমলা কান্ত রায়ের ভাষ্য, রুবেল পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছিল, কিন্তু পরীক্ষা দিচ্ছে না সে। পরীক্ষা শুরুর আগে যোগাযোগ করে বাড়িতেও তাকে পাওয়া যায়নি। গতকাল সোমবার রুবেলের খোঁজে এই প্রতিবেদক যান তার বাড়ি গঙ্গাচড়া উপজেলা সদরের বালারঘাটে। সেখানে কথা হয় তার বাবা কৃষিশ্রমিক একরামুল হকের সঙ্গে। সংসারের দারিদ্র্যের কথা জানিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি। একরামুলের ভাষায়, ‘অভাবের সংসারোত আর কুলান যাওচে না, পড়াশনা করাইম কী দিয়া! বেটায় (ছেলে) কামাই কইরবার ঢাকাত গেইচে।’
রংপুর অঞ্চলের বহু শিক্ষার্থীর জীবনের গল্পই রুবেলের সঙ্গে মিলে যায়। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার নিবন্ধন, ফরম পূরণ করলেও শেষটা সাফল্যে রঙিন হচ্ছে না তাদের। এই অঞ্চলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার বেড়েই চলছে আশঙ্কাজনকভাবে। এর মধ্যে শহরের তুলনায় গ্রামে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য, দরিদ্র ঘরের সন্তানদের অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন বেশিদূর এগোয় না। অসচেতন অভিভাবকরা সাধ্যের মধ্যে পাত্র পেলেই বিয়ের পিঁড়িতে তুলে দেন কিশোরীদের। ফলে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে তারা। অনেকে আবার সংসারের চাপ সামলে পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে না। তারা জীবনের পরীক্ষার জন্য বিরতি নেয় খাতা-কলমের পরীক্ষা থেকে। এই বিরতি ভেঙে পড়াশোনায় ফিরতে পারে খুব কমই।
১০ এপ্রিল বাংলা প্রথম পত্র দিয়ে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে এদিন অনুপস্থিত ছিল ১ হাজার ৩৪১ জন। গত বছরের প্রথম পরীক্ষায় এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩ জন। এবার পরের পরীক্ষাগুলোতে অনুপস্থিতির সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। প্রথম পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫ এপ্রিলের ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ২৬ জন। ১৭ এপ্রিলের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার কেন্দ্রে আসেনি আরও ১৩৬ জন। সোমবারের (২১ এপ্রিল) গণিত পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ২০৪ জন। এ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া চার বিষয়ের পরীক্ষায় এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭০৭-তে।
বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এবার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল গুলালবুদাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী সীমা আক্তারের। তার বাড়ি সদরের বকসা গ্রামে। সোমবার সীমার বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, এই কিশোরী এখন শ্বশুরবাড়িতে। পরীক্ষা শুরুর ১৫ দিন আগেই বিয়ে হয়েছে তার। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা দুলাল মিয়ার সাধ্য নেই তাঁর ছোট মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার। দুলাল আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘পরীক্ষা দিয়া কী হইবে! হঠাৎ (পাত্র) জুটি গেইল, ছাওয়াক বিয়াও দিছি। আইজ হোক, কাইল হোক বিয়াও তো দেওয়ায় নাগবে।’
একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল আয়নাল হকের। তার বাড়ি গঙ্গাচড়া উপজেলার বজঘণ্টা ইউনিয়নের রুপাই গ্রামে। বাড়িতে গিয়ে আয়নালের দেখা মেলেনি। কৃষিশ্রমিক বাবা আব্দুল ওহাব জানান, তাঁর ছেলে কাজের খোঁজে এখন ঢাকায়।
গুলালবুদাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ছেলেটি ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে বলে শুনেছি। পরীক্ষা শুরুর আগে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। আর সীমা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। এর পরও পরীক্ষা দিতে বলা হয়েছিল, দেয়নি।’
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, এসএসসি পরীক্ষায় রংপুর বিভাগের আট জেলায় এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৮২ হাজার ৪১০। এখন পর্যন্ত টিকে আছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৭০৩ জন। বিভাগে মোট ২৮০টি কেন্দ্রে হচ্ছে পরীক্ষা। এসব কেন্দ্রে প্রথম দিনে অনুপস্থিতি ছিল শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ। দ্বিতীয় দিনে তা বেড়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশে। তৃতীয় দিনে শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ ও সোমবারের চতুর্থ দিনের পরীক্ষায় তা বেড়ে ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত রংপুরে ২৯৭, গাইবান্ধায় ১৯৩, নীলফামারীতে ১৮৬, কুড়িগ্রামে ১৮৩, লালমনিরহাটে ১৮০, দিনাজপুরে ৩৫৯, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯২ ও পঞ্চগড়ে ১১৭ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
একই সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের এ বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৪৪৪ জন। এর মধ্যে অংশ নেয়নি ২ হাজার ২৬০ জন।
২০২৩ সালে ২ লাখ ২ হাজার ৪৬২ জনের মধ্যে ২ হাজার ৯৭১ জন; ২০২২ সালে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮৪৬ জনের মধ্যে ২ হাজার ২৬৯ জন পরীক্ষা দেয়নি।
তারাগঞ্জ উপজেলায় এবার এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল (কারিগরি) মিলিয়ে ১ হাজার ৭৫৭ জন পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছিল। অংশ নিয়েছে ১ হাজার ৭৩৯ জন। প্রথম দিনই অনুপস্থিত ছিল ১৮ জন, যাদের ১০ জন ছাত্রী। তারাগঞ্জ ও/এ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনুপস্থিত সাতজনের পাঁচজনই কিশোরী। তাদের চারজন ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ত। বিষয়টি নিশ্চিত করে ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জলিলুর রহমান বলেন, চার ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে বলে শুনেছি, তাই তারা পরীক্ষা দিচ্ছে না। এদের মধ্যে কুর্শা এলাকার সনাতন রায়ের মেয়ে সোনালী রানী ও সয়ার এলাকার ফরহাদ হোসেনের মেয়ে ফাহিমা বেগমের বিয়ের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। এই শিক্ষকের ভাষ্য, দারিদ্র্যের কারণে অনেকে গোপনে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড.
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মীর সাজ্জাদ আলীর ভাষ্য, এসএসসি পাসের পর সব শিক্ষার্থীই এই বোর্ডের আওতায় ভর্তি হয় না। তা ছাড়া অনেকে নানা কারণে কর্মজীবনে প্রবেশ করে। আগের চেয়ে ঝরে পড়ার হার কমে এসেছে। এর পরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ক ষ য় অ শ ন র পর ক ষ য় র এসএসস ন পর ক ষ পর ক ষ র ব র পর স মব র প রথম বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রাম, জেএসসি ছাড়াও ভর্তি
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন স্কুল পরিচালিত এসএসসি প্রোগ্রামের মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান শাখায় ২০২৬-২০২৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভর্তির যোগ্যতা জেএসসি পাস হতে হবে। জেএসসি ছাড়াদের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
ভর্তির দরকারি তারিখ—১. অনলাইনে ভর্তি এবং আবেদনের তারিখ শেষ তারিখ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৬।
২. অষ্টম শ্রেণি বা সমমানের সনদবিহীন ভর্তি-ইচ্ছুকদের ভর্তি পরীক্ষা : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৬।
৩. ওরিয়েন্টেশন ও টিউটোরিয়াল ক্লাস শুরু : ১৫ মে ২০২৬।
ভর্তির যোগ্যতা—১. জেএসসি বা জেডিসি বা অষ্টম শ্রেণি বা সরকার স্বীকৃত সমমানের পরীক্ষায় পাস বা উত্তীর্ণ হতে হবে। (ভর্তির তারিখ ০২/১১/২০২৫ থেকে ৩১/০১/২০২৬)।
২. সরাসরি অনলাইন ভর্তির জন্য: osapsnew.bou.ac.bd
ভর্তির যোগ্যতা(জেএসসি ছাড়া) —১. যেসব শিক্ষার্থীর জেএসসি বা জেডিসি বা অষ্টম শ্রেণি বা সরকার স্বীকৃত সমমানের সনদপত্র নেই তারাও ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৪ বছর (৩১/১২/২০২৫ তারিখে)।
২. এসব আবেদনকারীকে যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য বাউবি কর্তৃক নির্ধারিত ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
৩. এ জন্য ভর্তির প্রাথমিক আবেদন ফরম ফি বাবদ ৩০০ টাকা দিতে হবে।
৪. ভর্তি পরীক্ষার বিষয়, মানবণ্টন, তারিখ ও পরীক্ষা কেন্দ্র এবং প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য বাউবি’র ওয়েবসাইট, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং স্টাডি সেন্টার থেকে পাওয়া যাবে। (অনলাইনে আবেদনের তারিখ ০২/১১/২০২৫ থেকে ৩১/০১/২০২৬)।
প্রয়োজনীয় কাগজ যা লাগবে—১. দুই কপি ছবি।
২. জেএসসি বা জেডিসি বা অষ্টম শ্রেণি বা সরকার স্বীকৃত সমমানের পরীক্ষায় পাস বা উত্তীর্ণের সনদ।
৩. জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি।
ভর্তি ও অন্যান্য ফি—অনলাইন আবেদন ফি: ১০০ টাকা,
রেজিস্ট্রেশন ফি : ১০০ টাকা,
কোর্স ফি (প্রতি কোর্স ৫২৫ টাকা): ৩৬৭৫ টাকা,
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আবশ্যিক) ব্যবহারিক ফি: ১০০ টাকা,
একাডেমিক ক্যালেন্ডার ফি:৫ টাকা,
ডিজিটাল আইডি কার্ড ফি: ২০০ টাকা,
পরীক্ষা ফি (প্রতি কোর্স ৫০ টাকা) : ৩৫০ টাকা,
প্রথম বর্ষ নম্বরপত্র ফি : ৭০ টাকা,
মোট আবেদন ফি: ৪৬৯৬ টাকা।
বিজ্ঞান শাখার জন্য দুটি ব্যবহারিক কোর্সের জন্য অতিরিক্ত ২০০ টাকা জমা দিতে হবে।
দরকারি তথ্য—১. অষ্টম শ্রেণি বা সমমান পাসের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নাম, পিতা ও মাতার নাম এবং জন্ম তারিখ ইত্যাদি প্রদত্ত সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী একই রকম হতে হবে।
২. জেএসসি বা জেডিসি পাসের ক্ষেত্রে জেএসসি বা জেডিসি সনদ অনুযায়ী হতে হবে। ২০২০ সাল কিংবা তার পরবর্তীতে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অষ্টম শ্রেণি পাশ সনদে বা প্রমাণকে বোর্ড কর্তৃক ইস্যুকৃত রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ থাকতে হবে। সনদবিহীনদের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী হতে হবে।
৩. তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরা কোর্স ফির শতকরা ৬০ ভাগ ছাড় পাবেন।
# বিস্তারিত তথ্যের জন্য ওয়েবসাইট