গ্রামবাংলার চিরচেনা রূপ ফুটে উঠেছে বাংলার প্রাচীন রাজধানী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে। পক্ষকালব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলছে এ মেলা। এবারের বৈশাখী মেলায় লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে মেলা প্রাঙ্গণ পর্যন্ত রং-বেরঙের বাতি ও বিভিন্ন প্রাচীন মোটিফ দিয়ে সাজানো হয়েছে ফাউন্ডেশন চত্বর।
২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এ মেলা। প্রতিদিন মেলার লোকজ মঞ্চে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই চলছে বাউল গান ও লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুতুল নাচ, হালখাতা, বায়োস্কোপ, সাপ ও বানর খেলা, নাগরদোলাসহ গ্রামীণ বিনোদনের নানা আয়োজন। হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ খেলা তিন গুটি, সাত গুটি, বাঘবন্দি, কানামাছি, গোল্লাছুট, বউচি ও কপাল টোক্কা প্রদর্শন। রসনা তৃপ্তির জন্য থাকছে মুখরোচক সব বাঙালি খাবার।
ফাউন্ডেশনের বৈশাখী মেলা চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, বৈশাখী মেলা ও জাদুঘরের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের বৈচিত্র্যময় কারুপণ্যের সমাহার রাখা হয়েছে। লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কারুশিল্পীদের কেউ নিপুণ হাতের তৈরি কারুপণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। দেখা গেছে, এ মেলায় এবার শুধু কারুপণ্যের শিল্পীরা স্থান পেয়েছেন। তারা তাদের বরাদ্দকৃত স্টলগুলোয় সাজিয়েছেন উৎপাদিত কারুপণ্য দিয়ে। সব স্টল সাজানো হয়েছে অতীতের শণ দিয়ে তৈরি ঘরে। সেখানে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে খুঁজে পাওয়া যায়। এ মেলা আমাদের নিয়ে যায় নিজেদের শিকড়ের কাছে। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করে দিচ্ছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির সঙ্গে। মেলায় কোনো ধরনের প্লাস্টিক পণ্য দেখা যায়নি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জামদানি, শতরঞ্জি, নকশিকাঁথা, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, পাঁটজাতশিল্প, নকশি হাতপাখা, কাঠখোদাইশিল্প, পটচিত্রশিল্প, ঝিনুকশিল্প, লোক বাদ্যযন্ত্রশিল্প, মণিপুরি তাঁতশিল্প, শোলাশিল্প, বাঁশ-বেতশিল্প এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারুশিল্পীদের সৃষ্টিশীল কর্মের উপস্থাপন এবং বিপণন করছেন। 
শিল্পীরা এক স্টলে বসে তাদের কারুপণ্য তৈরি করছেন। একই নামে অপর স্টলে কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিপণন করছেন। রাজশাহীর শখের হাঁড়িশিল্পী সুশান্ত  কুমার পাল ও সঞ্জয় কুমার পাল, কুমিল্লার রিকশা পেইন্টিং শিল্পী মো.

নুহু খন্দকার, রাজশাহীর মৃৎশিল্প টেপা পুতুল শিল্পী সুবোধ কুমার পাল, কিশোরগঞ্জের মৃৎশিল্প টেপা পুতুল শিল্পী সুনীল চন্দ্র পাল, নীলফামারীর পাঁটজাত কারুশিল্পী একাব্বর হোসেন, সোনারগাঁয়ের নকশি হাতপাখা শিল্পী বাসন্তী রানী সূত্রধর, কুমিল্লার রীতা রানী সূত্রধর, সোনারগাঁয়ের কাঠখোদাই শিল্পী আউয়াল মোল্লা ও রফিকুল ইসলাম, কাঠের চিত্রিত কারুশিল্পী বীরেন্দ্র চন্দ্র সূত্রধর ও আশুতোষ সূত্রধর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশিকাঁথা শিল্পী পারভীন আক্তার, রাঙামাটির আদিবাসী তাঁতশিল্পী মাচাচিং মারমা ও সীমা চাকমা, শতরঞ্জি শিল্পী আনোয়ার হোসেনসহ প্রথিতযশা কারুশিল্পীরা।
মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার পাল জানান, তাদের স্টলে মেলায় আসা দর্শনার্থী ভিড় করছেন। তাদের হাতের তৈরি শখের হাঁড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। বেচাবিক্রি ভালো হচ্ছে। এবারের মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শুধু কারুশিল্পীরাই স্টল পেয়েছেন। স্টল পেয়েছেন দুটি করে। একটি স্টলে কারুপণ্য তৈরি করছেন আর অন্য স্টলে প্রদর্শন ও বিপণন হচ্ছে। 
নকশিকাঁথা শিল্পী হোসনে আরা জানান, তাদের মতো শিল্পীদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রি, বিপণন ও জাতীয় পর্যায়ে সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য লোককারুশিল্প ফাউন্ডেশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে আমি এ মেলায় পণ্য নিয়ে আসি। তবে অন্যবারের চেয়ে এবার আয়োজন ছিল ভিন্ন। ক্রেতাও এসেছে অনেক। এখানে আমাদের তৈরি নকশিকাঁথা পেয়ে অনেকেই খুশি হয়েছেন।
রাঙামাটির আদিবাসী তাঁতশিল্পী মাচাচিং মারমা ও সীমা চাকমা বলেন, ‘ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ আমাদের হাতের তৈরি পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আরও বেশি শুধু কারুপণ্যের মেলার আয়োজন করলে এসব পণ্যের প্রতি লোকজন আকৃষ্ট হবেন।’ 
মেলায় কুমিল্লা থেকে এসেছেন আতাউর রহমান রাজু ও তাঁর স্ত্রী। আতাউর রহমান জানান, মেলায় এসে নতুন বউয়ের জন্য সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি কিনেছেন। আরও কিনেছেন হাতের তৈরি কাঠ ও তাঁতের বিভিন্ন কারুপণ্য। নারায়ণগঞ্জ শহরের উকিলপাড়া থেকে বৈশাখী মেলায় আসা নাজমা আক্তার নামে এক তরুণী বলেন, ‘বছর ঘুরে আমরা আবারও বৈশাখী মেলায় ঘুরতে সুযোগ পেয়েছি। এখানে ঐতিহাসিক বিভিন্ন পণ্যের স্টল বসানো হয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখছি। সব কয়টি পণ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।’
শরীফুল ইসলাম নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমার কাছে বৈশাখী মেলা মানে হরেকরকম সুস্বাদু খাবারের সমাহার, যেসব খাবারের স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তাই নিজে খাওয়ার পাশাপাশি মেলা থেকে বাসার জন্যও মুখরোচক কিছু খাবার কিনেছি।’
মেলায় শিশুকিশোরের সংখ্যা ছিল বেশি। বেড়ানোর পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নাগরদোলা-চরকিতে চড়ে তারা উচ্ছ্বসিত। 
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন; যা সোনারগাঁ জাদুঘর নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমাদের দেশজ যে লোক ও কারুপণ্য, এগুলোর বাজারজাতকরণের একটা বড় জায়গা এ ধরনের মেলা। আমরা এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে দেশজ পণ্যের প্রচার-প্রসারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছি এ মেলায়। এবারের আয়োজনটি একটু ভিন্ন। আমাদের এ ফাউন্ডেশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের পাশাপাশি পক্ষকালব্যাপী ভিন্ন আঙ্গিকে এবার বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই এবার একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন করা হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে থাকা লোকজ ও কারুশিল্পের শিল্পীদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী উৎপাদন, বিপণনসহ সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য এ বৈশাখী মেলার মূল উদ্দেশ্য। এ মেলার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশজ পণ্যের যে একটি বাজার গড়ে ওঠে, সেটি দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখে।’ v

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ত রধর আম দ র র জন য স ন রগ উৎপ দ করছ ন নকশ ক ব পণন

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম আইনের সংশোধন কবে হবে, তা বলছে না শ্রম মন্ত্রণালয়

শ্রম আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ কবে হবে, সে বিষয়ে আর সময়সীমার কথা বলছে না শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গত নভেম্বর মাসে এই মন্ত্রণালয় বলেছিল, ২০২৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এ অধ্যাদেশ হবে। মার্চ শেষে এপ্রিলও শেষ হচ্ছে আজ বুধবার।

সচিবালয়ে আজ ‘মহান মে দিবস এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস ২০২৫’ উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইন সংশোধনীর ক্ষেত্রে সময়সীমা থাকার পক্ষে নন তিনি। শ্রমিক–মালিকদের স্বার্থ রক্ষাসহ শিগগিরই তা করা হবে। বিষয়টি এখন কোন প্রক্রিয়ায় আছে, তা বলতে রাজি হননি শ্রম উপদেষ্টা।

শ্রম উপদেষ্টা বলেন, এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। তিনি আরও বলেন, ‘একসময় স্লোগান ছিল দুনিয়ার মজদুর, এক হও।’ এখন তা বদলে গেছে। এখন হবে ‘দুনিয়ার মালিক-শ্রমিক, এক হও’। এখন ভালো মালিকেরা শ্রমিকদের সন্তানের মতো মনে করেন।

প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে ১০১টি ধারা ও উপধারা সংশোধন হবে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ১০ থেকে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডির বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

আইএলওর বৈঠকে যোগ দিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে যে দলটি জেনেভা সফর করে, সেখানে শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হুমায়ুন কবীর, যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন সরকার ও শ্রম উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. জাহিদুল ইসলাম ছিলেন।

এর আগে গত বছরের ১০ নভেম্বর তৎকালীন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান আইএলওর গভর্নিং বডির বৈঠক থেকে দেশে ফিরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মার্চের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধন হবে। উপদেষ্টা তখন এ–ও বলেছিলেন, আগের সরকারের আইনমন্ত্রীর (আনিসুল হক) নেতৃত্বাধীন দলকে আইএলও পর্ষদে অপদস্থ করা হয়েছিল। অথচ এবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো নিয়ে বরং প্রশংসা করা হয়েছে। কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো তুলে নেওয়ার কথাও বলেছিল।

জানা গেছে, শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে ঘাটতির অভিযোগ এনে জাপানসহ ছয়টি দেশের পক্ষ থেকে আইএলওতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। মামলাগুলো চলমান।

আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে দেশে ৭ কোটি ৬৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এদিকে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদকে (টিসিসি) শ্রমিকপক্ষ জানিয়েছে, আইন সংশোধনের সময় সব শ্রমিকের কথা মাথায় না রেখে প্রধানত পোশাক খাতের শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মে দিবস আর জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস উপলক্ষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীতে শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ–স্কুল পর্যায়ে রচনা ও প্রবন্ধ লেখার ওপরে বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হবে।

এ ছাড়া শ্রম অধিকার বিষয়ে প্রকাশিত বা প্রচারিত মানসম্মত সংবাদ বা স্থিরচিত্র যাচাই করে সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহকদের দেওয়া হবে পুরস্কার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কর্মক্ষেত্রে অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত গৌরবময় দিন
  • শ্রম আইনের সংশোধন কবে হবে, তা বলছে না শ্রম মন্ত্রণালয়
  • শিগগিরই শ্রম আইন সংশোধন করা হবে: শ্রম উপদেষ্টা 
  • আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে শিল্পকলা একাডেমির  দুই দিনের আয়োজন
  • মেরাদিয়ায় পশুর হাট বসানো যাবে না, নির্দেশ হাইকোর্টের
  • আইনগত সহায়তা দিবসে আলোচনা সভা-শোভাযাত্রা
  • আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন