‘ সেরা নির্বাচন’ নিয়ে অঙ্গীকার এবং বাস্তবতা
Published: 26th, April 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আবারও জানিয়েছেন, তারা দেশের ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ আয়োজন করবেন। ১৯ এপ্রিল এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের (এএনএফআরইএল) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা এবং দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক মাইলফলক।’ এর আগেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। সরকারপ্রধানের আসন থেকে আসা এ বক্তব্যকে সরকারের অঙ্গীকার হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত হবে। পরপর তিনটি একতরফা ও কলঙ্কিত নির্বাচনের পর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দল নয়, দেশবাসীর কাছে বহুল প্রত্যাশিত। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির মাঠের বাস্তবতা কী এ অঙ্গীকার পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরে?
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকে শুরু থেকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থা, লুটপাট ও চৌর্যতন্ত্রের ফলে ধ্বংস হওয়া অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয়করণের জের এখনও বহন করতে হচ্ছে। সরকার আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ড, ‘মব’ সহিংসতা, চাঁদাবাজি, দখল, নারীকে হেনস্তা অব্যাহত আছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনী রোডম্যাপ, সংস্কার, গণহত্যার বিচার ইত্যাদি ইস্যুতে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। বিএনপি ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছে। বিএনপি শুরু থেকে বলে আসছে, নির্বাচনের জন্য যতখানি সংস্কার দরকার ততখানি সংস্কার করে ডিসেম্বরেই নির্বাচন করা সম্ভব। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত সরকার ও সংসদ সংস্কার কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদে সব দলই অঙ্গীকার করবে। যে-ই ক্ষমতায় যাক, ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে।’
অন্যদিকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান স্পষ্ট নয়। শুরুতে জামায়াতের বক্তব্য ছিল, সংস্কার বাস্তবায়ন ছাড়া যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন কোনো ফল বয়ে আনবে না। জামায়াত গণহত্যার বিচারের দাবিও সামনে নিয়ে আসে। সম্প্রতি দলটির আমির ডা.
রাজনীতির মাঠের আরেক শক্তি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন সংস্কার বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। গত ২০ এপ্রিল সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের দাবি জানান। এনসিপি সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের আগে নির্বাচনী রোডম্যাপের বিরোধিতা করে চলেছে। ইসির তৎপরতা নিয়েও এনসিপি ‘সন্দেহ’ পোষণ করছে। এনসিপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এর আগে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ তুলেছেন, ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষে, তাদের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গত ১৬ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে অনেক জায়গায়।’ মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও আভাস দিয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে আসা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক রমজান মাসের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে চলছে। কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত, আংশিক একমত, ভিন্নমতের পাশাপাশি বিভিন্ন দলের নতুন সুপারিশ নিয়ে এ বৈঠক চলছে। সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন কাজ করছে। তবে সংস্কারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক মতভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে সংবিধান এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার সুপারিশের ক্ষেত্রে বিএনপি এবং এনসিপির অবস্থান একেবারেই বিপরীতমুখী। যেমন বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর বিপক্ষে। অন্যদিকে এনসিপি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করেছে। প্রধানমন্ত্রী শাসিত নয়, এনসিপি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের কথা বলেছে।
প্রফেসর ইউনূসের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়েও প্রফেসর ইউনূসকে চাপের মধ্যে থাকতে হবে। শুধু বিএনপি নয়, সিপিবি, বাসদসহ অনেক দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জারি রেখেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর নিয়োগকর্তা ছাত্রদের দল এনসিপিকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কালক্ষেপণ করছেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অন্যতম দাবি এনসিপির। প্রধান উপদেষ্টা এর আগে ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই’– এমন বক্তব্য দেওয়ার পর এনসিপি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যে দূরত্ব বিরাজ করছে, তা দূর করা অথবা কমিয়ে আনা সহজ নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এবং পরে বিভিন্ন বক্তৃতায় ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাওয়ার এক অনুষ্ঠানে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে কিংবা ‘ক্লোজ টু দ্যাট টাইমে’র মধ্যে ফ্রি, ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা একমত হয়েছেন।” তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালন শেষে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়।’
প্রফেসর ইউনূস দেশের ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ আয়োজনের কথা বলেছেন। ‘সেরা নির্বাচন’ হবে কিনা, তা এখনই বলা যাবে না। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন যে দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন হবে, একথা বলা যায়।
খায়রুল আনোয়ার: সাংবাদিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণহত য র ব চ র ড স ম বর এনস প র অবস থ ন ঐকমত য র বল ন মন ত র র জন য ইউন স ব এনপ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
খসড়া নিয়ে ৩ দলের আপত্তি
জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে—সনদের এ বিষয়টি নিয়েই মূলত আপত্তি। দলগুলো বলছে, জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তা বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হলে পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। তবে এ খসড়ার সঙ্গে মোটামুটি একমত বিএনপি।
গতকাল মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ফাঁকে সাংবাদিকদের কাছে সনদের খসড়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় কয়েকটি দল। আজ বুধবার দুপুরের মধ্যে দলগুলোকে এ খসড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত জানাতে বলেছে ঐকমত্য কমিশন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষ করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, সংসদে নারী আসন, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে এসব বিষয়ে গতকালও ঐকমত্য হয়নি। দ্বিতীয় পর্বের আলোচ্য সূচিতে থাকা ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে এখনো ৮টি প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়নি।
আলোচনা শেষ না হলেও গত সোমবার জাতীয় সনদের একটি খসড়া দলগুলোকে দেয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়ায় বলা হয়েছে, জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় নির্বাচনের
মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে অঙ্গীকার করবে রাজনৈতিক দলগুলো। সেখানে মোট সাতটি অঙ্গীকার করার কথা বলা আছে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে ছয় সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো নিয়ে তৈরি হবে জাতীয় সনদ। তবে কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, খসড়ায় তা উল্লেখ করা হয়নি। দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর বিষয়গুলো সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
খসড়া নিয়ে দলগুলোর বক্তব্যসনদের কিছু অংশ ‘বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই সনদকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার পক্ষে। এটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা না হলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিয়শ্চয়তার দিকে চলে যেতে পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। তাঁর মতে, সেটি দুইভাবে হতে পারে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত সংসদে তা অনুমোদন অথবা গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া। জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদের একটি খসড়া ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেবে বলেও জানান তিনি।
* তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। * আজ আবার আলোচনা। * খসড়া নিয়ে মতামত জানাতে হবে আজকের মধ্যেই।খসড়াটি দলীয়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে জানিয়ে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই খসড়ায় আমরা মৌলিক সংস্কারের প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত দেখতে চাই। যদি তা বাদ দেওয়া হয়, তাহলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সই করব কি না।’
আখতার বলেন, আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে তারা ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (আইনি আদেশ) করার প্রস্তাব দিয়েছেন। একই সঙ্গে যে সংস্কারগুলো রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে মেনে নিচ্ছে, তা যেন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা কোনো দল উপেক্ষা করতে না পারে, এ নিশ্চয়তাও চান তাঁরা।
শুরু থেকে সংবিধান পুনর্লিখনে গণপরিষদ গঠনের কথা বলে আসছে এনসিপি। এ বিষয়ে গতকাল আখতার হোসেন বলেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পুনর্লিখন করা গেলে সঠিকভাবে সব বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি বিকল্প পদ্ধতির কথা বলেছিল ঐকমত্য কমিশন। সেগুলো নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি। আলোচনার পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা হয়নি, অথচ তারা খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না।’
জুলাই সনদের খসড়াকে আইনি বাধ্যবাধকতাহীন একটি দুর্বল উপস্থাপনা বলে অভিহিত করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ গতকাল দলের নিয়মিত বৈঠকে এ প্রতিক্রিয়া জানান।
ইসলামী আন্দোলনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, খসড়ায় একবারের জন্যও পতিত ফ্যাসিবাদের মূল হোতা ও অশুভ চক্রের প্রধান শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করা হয়নি। জুলাই সনদের ক্ষেত্রে প্রধান চাওয়া ছিল, এর আইনি মর্যাদা ও বাধ্যবাধকতা। কিন্তু খসড়া সনদে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ফলে সনদের আদতে কোনো তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশনের খসড়ার সঙ্গে মোটামুটি একমত বিএনপি। গতকাল দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, খসড়ার সঙ্গে তাঁরা মোটামুটি একমত। অঙ্গীকারের বিষয়েও বিএনপি একমত। খসড়ায় শব্দ-বাক্য গঠন-সংক্রান্ত বিষয়ে বিএনপি তাদের পর্যবেক্ষণ আজ কমিশনকে জানাবে।
কাল সনদ চূড়ান্ত করার আশাগতকাল দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত দলগুলোর মন্তব্যের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করবেন। তিনি আশা করছেন, বিভিন্ন মন্তব্য সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করতে পারবেন। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেসব বিষয় ও মন্তব্যগুলো নিয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সনদের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
গতকাল সন্ধ্যায় আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, কেউ কেউ মৌখিকভাবে সনদের খসড়ায় কিছু কিছু সংশোধনীর কথা কমিশনকে বলেছেন। বড় ধরনের আপত্তির কথা কমিশন এখনো শুনতে পায়নি। কমিশন এখনো আশাবাদী, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দাঁড় করানো যাবে।
গতকালের আলোচনানির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও এ সরকারের রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। গতকালের আলোচনায় ঐকমত্য কমিশন রূপরেখা নিয়ে একটি সংশোধিত প্রস্তাব দেয়। তবে সেটি নিয়েও ঐকমত্য হয়নি। প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য কয়েকটি ধাপে বিকল্পের কথা আছে।
আলোচনার এক পর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রস্তাবের প্রথম কয়েকটি ধাপ নিয়ে ঐকমত্য আছে। এর পরের ধাপ কী হবে, সেটা ঠিক করার বিষয়টি আগামী সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কয়েকটি দল বিষয়টি পরবর্তী সংসদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পরে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে গেলে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। কমিশন এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানাবে।
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সরাসরি ভোটের বিধান করার প্রস্তাব দিয়েছিল সংস্কার কমিশন। কিন্তু তাতে ঐকমত্য না হওয়ায় কমিশন নতুন প্রস্তাব দেয়। তাতে বলা হয়, ৩০০ সাধারণ আসনের মধ্যে দলগুলো এক-চতুর্থাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। গতকালও এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি।
গতকাল এ বিষয়ের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সরাসরি নির্বাচনে নারী প্রার্থী দিতে জামায়াতের সমস্যা হবে না। জমিয়তে ওলামা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব দলের ক্ষেত্রে নারী প্রার্থী দিতে ‘টেকনিক্যাল’ সমস্যা হবে। ইসলামী আন্দোলন যে সংস্কৃতির দল, তাদের পক্ষে নারী প্রার্থী দেওয়া কঠিন। তাই নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করে বলা যায়, এ বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। যারা পারবে, নারী প্রার্থী দেবে।
গতকালের আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় বিভিন্ন রকম প্রস্তাব এসেছে। পর্যায়ক্রমে নারী প্রতিনিধিত্ব কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ঐকমত্যের কাছাকাছি আসা গেছে। বুধবার এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে একটি লিখিত ভাষ্য দেওয়া হবে। কমিশন আশা করছে, সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
আলোচনায় অন্যদের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।