অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আবারও জানিয়েছেন, তারা দেশের ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ আয়োজন করবেন। ১৯ এপ্রিল এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের (এএনএফআরইএল) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা এবং দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক মাইলফলক।’ এর আগেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। সরকারপ্রধানের আসন থেকে আসা এ বক্তব্যকে সরকারের অঙ্গীকার হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত হবে। পরপর তিনটি একতরফা ও কলঙ্কিত নির্বাচনের পর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দল নয়, দেশবাসীর কাছে বহুল প্রত্যাশিত। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির মাঠের বাস্তবতা কী এ অঙ্গীকার পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরে? 

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকে শুরু থেকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থা, লুটপাট ও চৌর্যতন্ত্রের ফলে ধ্বংস হওয়া অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয়করণের জের এখনও বহন করতে হচ্ছে। সরকার আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ড, ‘মব’ সহিংসতা, চাঁদাবাজি, দখল, নারীকে হেনস্তা অব্যাহত আছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনী রোডম্যাপ, সংস্কার, গণহত্যার বিচার ইত্যাদি ইস্যুতে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। বিএনপি ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছে। বিএনপি শুরু থেকে বলে আসছে, নির্বাচনের জন্য যতখানি সংস্কার দরকার ততখানি সংস্কার করে ডিসেম্বরেই নির্বাচন করা সম্ভব। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত সরকার ও সংসদ সংস্কার কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদে সব দলই অঙ্গীকার করবে। যে-ই ক্ষমতায় যাক, ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে।’
অন্যদিকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান স্পষ্ট নয়। শুরুতে জামায়াতের বক্তব্য ছিল, সংস্কার বাস্তবায়ন ছাড়া যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন কোনো ফল বয়ে আনবে না। জামায়াত গণহত্যার বিচারের দাবিও সামনে নিয়ে আসে। সম্প্রতি দলটির আমির ডা.

শফিকুর রহমান ঢাকা সফরকারী ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘জামায়াতের অবস্থান হলো, আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ঝড়-বর্ষা আসবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। তখন আবার নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। তাই রমজানের আগে নির্বাচন হয়ে যাওয়া ভালো।’ এক দিন পর ১৭ এপ্রিল তিনি নির্বাচনের জন্য জামায়াতের তিন শর্তের কথা জানান। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক সহাবস্থান– সংসদ নির্বাচনের আগে এই তিন শর্ত পূরণ করতে হবে।

রাজনীতির মাঠের আরেক শক্তি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন সংস্কার বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। গত ২০ এপ্রিল সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের দাবি জানান। এনসিপি সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের আগে নির্বাচনী রোডম্যাপের বিরোধিতা করে চলেছে। ইসির তৎপরতা নিয়েও এনসিপি ‘সন্দেহ’ পোষণ করছে। এনসিপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এর আগে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ তুলেছেন, ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষে, তাদের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গত ১৬ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে অনেক জায়গায়।’ মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও আভাস দিয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে আসা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক রমজান মাসের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে চলছে। কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত, আংশিক একমত, ভিন্নমতের পাশাপাশি বিভিন্ন দলের নতুন সুপারিশ নিয়ে এ বৈঠক চলছে। সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন কাজ করছে। তবে সংস্কারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক মতভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে সংবিধান এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার সুপারিশের ক্ষেত্রে বিএনপি এবং এনসিপির অবস্থান একেবারেই বিপরীতমুখী। যেমন বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর বিপক্ষে। অন্যদিকে এনসিপি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করেছে। প্রধানমন্ত্রী শাসিত নয়, এনসিপি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের কথা বলেছে।

প্রফেসর ইউনূসের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়েও প্রফেসর ইউনূসকে চাপের মধ্যে থাকতে হবে। শুধু বিএনপি নয়, সিপিবি, বাসদসহ অনেক দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জারি রেখেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর নিয়োগকর্তা ছাত্রদের দল এনসিপিকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কালক্ষেপণ করছেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অন্যতম দাবি এনসিপির। প্রধান উপদেষ্টা এর আগে ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই’– এমন বক্তব্য দেওয়ার পর এনসিপি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যে দূরত্ব বিরাজ করছে, তা দূর করা অথবা কমিয়ে আনা সহজ নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এবং পরে বিভিন্ন বক্তৃতায় ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাওয়ার এক অনুষ্ঠানে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে কিংবা ‘ক্লোজ টু দ্যাট টাইমে’র মধ্যে ফ্রি, ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা একমত হয়েছেন।” তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালন শেষে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়।’

প্রফেসর ইউনূস দেশের ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ আয়োজনের কথা বলেছেন। ‘সেরা নির্বাচন’ হবে কিনা, তা এখনই বলা যাবে না। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন যে দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন হবে, একথা বলা যায়।

খায়রুল আনোয়ার: সাংবাদিক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণহত য র ব চ র ড স ম বর এনস প র অবস থ ন ঐকমত য র বল ন মন ত র র জন য ইউন স ব এনপ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন

জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান–সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আগামীকাল বুধবার আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে এই আলোচনা শুরু হবে। আজ মঙ্গলবার কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এর আগে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিল কমিশন। মতৈক্য না হওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে ৩০টি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। গত রোববারও দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়। ওই দিনের আলোচনায় কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত ছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে মতৈক্য হয়নি।

এর আগে দুই পর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা হয়েছে। সেখানে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এই সনদের খসড়া ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করেছে কমিশন।

গত জুলাই মাসে এই সনদ সই করার লক্ষ্য ছিল। তবে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় সনদ আটকে আছে। অবশ্য বাস্তবায়নের পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না। এ বিষয়ে সরকারকে আলাদা সুপারিশ দেবে ঐকমত্য কমিশন।

বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামতও নেওয়া হয়েছে।

সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন চায়। এর বাইরে বেশ কিছু দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
  • গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের ‘কঠোরতম ভাষায়’ নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব
  • কমিটি গঠন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত 
  • বর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ
  • বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
  • যারা জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ চায়, তারা আদালতে অভিযোগ দিতে পারে: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন
  • হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
  • ‘গাজায় গণহত্যা চলছে, আমি সেই গণহত্যার নিন্দা করছি’