তারা যেন পৃথিবীর নাড়ি-ছেঁড়া ধন। না ফেরার দেশে যতই ছুটে চলেছে, পৃথিবী উপলব্ধি করছে নাড়ির টান। কষ্টসাধ্য হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। এসবের মধ্যেই তাদের নিরন্তর পথচলা অব্যাহত। ক্রমেই তারা সৌরজগৎ ছেড়ে অনন্ত-অসীমে হারিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বার্তা, যদি কোনো দূর-গ্রহের কারও সাক্ষাৎ মেলে! তবে একটি প্রশ্ন এখন জোরালোভাবে সামনে আসছে, এভাবে আর কতকাল তারা পথ চলতে পারবে?
কথা হচ্ছিল দুই ‘ভয়েজার বোন’কে নিয়ে। এখন তারা পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে যাওয়া মনুষ্যসৃষ্ট বস্তু। প্লুটোনিয়াম পুড়িয়ে উৎপন্ন হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ, যা তাদের চালিকাশক্তি। অসীমের যাত্রাপথে প্রতিবছর তারা প্রত্যেকে চার ওয়াট শক্তি হারায়। বিজ্ঞানীরা চান তাদের যাত্রা যেন না থামে। এ জন্য জ্বালানি যাতে দ্রুত ফুরিয়ে না যায়, পৃথিবী থেকে নাসার বিজ্ঞানীরা সে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে তারা এরই মধ্যে যান দুটির বিভিন্ন অংশের কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছেন।
১৯৭৭ সালে ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ আকাশে ওড়ানো হয়। প্রাথমিকভাবে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের তথ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু একসময় তারা সৌরজগতের সীমা পেরিয়ে ছুটতে শুরু করে অনন্ত মহাশূন্যের পানে। বর্তমানে ভয়েজার-১ পৃথিবী থেকে আড়াই হাজার কোটি কিলোমিটার দূরে রয়েছে; আর ভয়েজার-২ আছে ২ হাজার ১০০ কোটি কিলোমিটার দূরে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। ভয়েজার-১ এর কাছে একটি সংকেত পাঠাতে সময় লাগে ২৩ ঘণ্টার বেশি। আর ভয়েজার-২ সংকেত পায় ১৯ ঘণ্টায়।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণাগার থেকে নাসার বিজ্ঞানীরা ভয়েজার-১ এর একটি যন্ত্রাংশ বন্ধ করে দেন। ২৪ মার্চ ভয়েজার-২ এরও একাংশ বন্ধ করার কথা । ভয়েজাররা যখন যাত্রা শুরু করে, তখন সৌরজগতের শনি, বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুন নিয়ে গবেষণা চালানোর জন্য প্রতিটিতে ১০টি যন্ত্র সংযুক্ত করা হয়। এগুলোর প্রতিটির কাজ পৃথক।
২০১২ সালে ভয়েজার-১ ইন্টারস্টেলার বা সৌরজগতের বহির্মণ্ডল অতিক্রম করে। এর মধ্য দিয়ে মানব ইতিহাসে প্রথম কোনো মহাকাশযান অনন্ত মহাবিশ্বের পথে রওনা হয়; ছুটতে থাকে অজানা গন্তব্যে। ২০১৮ সালে ভয়েজার-২ একইভাবে, তবে ভিন্ন দিকে রওনা করে। এ দুটিই নিয়ে যাচ্ছে কিছু রেকর্ড– পাখির কূজন, শিশুর কান্না, সংগীতসহ জাগতিক নানা শব্দ। এগুলো কি আদৌ ‘কারও’ কাছে পৌঁছাবে? সেই ‘কারও’র কি আসলে অস্তিত্ব আছে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভয়েজার-১ এর মেগনেটোমিটার ও প্লাজমা ওয়েব সাবসিস্টেম চলতি বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। পরে এটি বন্ধ হয়ে যাবে। অপরদিকে ভয়েজার-২ তার মেগনেটোমিটার ও প্লাজমা ওয়েব সাবসিস্টেম আগামী বছর পর্যন্ত চালু রাখবে। এসব যন্ত্র একে একে বন্ধ হওয়ায় ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে ‘ভয়েজার বোনেরা’। তবে আরও কয়েক বছর হয়তো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে।
ভয়েজার প্রকল্পের বিজ্ঞানী লিন্ডা স্পিলকার বলেন, ‘প্রতিদিন প্রতি মিনিটে ভয়েজাররা মহাশূন্যের নতুন এলাকায় প্রবেশ করছে, যেখানে অতীতে কোনো মহাকাশযান যায়নি।’ এ দুই ভয়েজার আর কতদূর যাবে, তাও সুনির্দিষ্ট নয়। সূত্র: নাসা, সায়েন্স অ্যালার্ট।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স রজগত র ভয় জ র ১ ভয় জ র ২ অনন ত
এছাড়াও পড়ুন:
মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষিশ্রমিক
‘১৫-২০ বছর ধইরা (ধরে), ই-খলায় (ধান মাড়াই ও শুকানোর স্থান) কাজ করি আমরা। আমরারে ৫০০ টেকা (টাকা) রোজ দেইন (দেন), আর বেটাইনতে (পুরুষরা) পাইন ৭০০ থেকে ৮০০ টেকা, দুপুরে আমরারে চিড়া-গুড় দেওয়া অয় (হয়) হেরার (পুরুষদের) লাগি ভাতের ব্যবস্থা করা অয়।’
কথাগুলো বলছিলেন তাহিরপুরের শনির হাওরপারের কালীবাড়ির সামনে একটি খলায় ধান শুকানো, ঝাড়াই ও বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকা দুই নারীশ্রমিক গীতা বর্মণ ও লক্ষ্মী রানী বর্মণ।
কেবল তাহিরপুরের ধানের খলায় নয়। হাওর এলাকাজুড়েই ধানের খলায় কাজ করা নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিতে বৈষম্য রয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদরের নতুনপাড়ার বারীক মিয়ার খলায় কাজ করছিলেন, পাশের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মধ্যবয়সী নারীশ্রমিক প্রেমলতা বিশ্বাস। কখন কাজে এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, সকাল ৮টায়। কয়টায় ছাড়বেন কাজ, বললেন বিকাল ৫টায়। মজুরি কত জানতে চাইলে বললেন, দিনে ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকরা কত পায় প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ৭০০ টাকা। আপনাকে কম দেওয়া হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেমলতা বলেন, ‘ই-দেশও নিয়মওই এইটা, বেটাইনতে (পুরুষরা) বেশি পায়।’
মধ্যনগরের বংশিকুন্ডা গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা বেগম জানান, ধান মাড়াই, শুকানো ও গোলায় তোলার কাজ করেন তিনি। প্রতিদিনই সকালে আগে কাজে লাগেন এবং কাজ শেষে সবার পরে ফেরেন তিনি। কিন্তু মজুরি দেবার সময় তাঁকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিককে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকাও দেওয়া হয়।
দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বড় গৃহস্থ সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছত্তার মিয়ার ভাষ্য, রাজাপুরে নারী কৃষিশ্রমিক কমে গেছে। পাশের ইসলামপুরে এখনও বেশির ভাগ কাজ করেন নারীরা। ওখানে নারী ও পুরুষ শ্রমিক অর্ধেক-অর্ধেক। এবার পুরুষ ও মহিলা শ্রমিককে কত টাকা চুক্তিতে গ্রামের বড় কৃষকরা কাজে লাগিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, পুরুষ ২০ দিনে ১৬ মণ ধান এবং নারী শ্রমিকদের ৮ মণে করানো হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কথাও তুলেছি, কিন্তু অন্যরা তাতে বিরক্ত হন, তারা বলেন, চেয়ারম্যান সাবে রেইট বাড়িয়ে সবাইকে বেকায়দায় ফেলতে চান।’
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের ফসল উৎপাদনে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় কৃষি শ্রমিকের চাইতে এক সময় বেশি ছিল নারী শ্রমিক। মজুরি বৈষম্যের কারণে এদের অনেকে এলাকার কাজ ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে চলে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরী ভট্টাচার্য্য বললেন, কৃষিতে মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে গ্রামীণ এলাকা ছেড়ে উপজেলা, জেলা ও রাজধানীর গার্মেন্টসমুখী হয়েছে হাজার হাজার নারীশ্রমিক। কৃষি ছাড়াও অন্যান্য পেশায়ও মজুরি বৈষম্য থাকায় নারীর উপস্থিতির সংখ্যা কমছে।
গৌরী ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের পেশা কৃষক লিখলেও নারীর ক্ষেত্রে হয় না। নারীর প্রতি এমন বৈষম্য বন্ধ করতে হবে।