বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ
Published: 1st, May 2025 GMT
রপ্তানি খাতকে আরও প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে আইএমএফের পরামর্শ মেনে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। ‘বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রবণতা ও সংস্কার; বাংলাদেশের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক এক সংলাপে এমন মত এসেছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) এর আয়োজন করে।
আইসিসি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন আইসিসি বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ.
জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা রিজার্ভ বাড়ছে। বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা রয়েছে। আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত শুল্কনীতি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য সংকট দেখা দেবে। খেলাপি ঋণ অনেক বাড়বে। এ কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বাইরের ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নিতে হবে।
ফ্লোরিয়ান উইট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে একটি পরিবর্তন আসবে। কোনো কারণে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচি আটকে গেলে বাংলাদেশের ঋণমান কমে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রসঙ্গত, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করতে চাওয়ায় বাংলাদেশের ঋণের কিস্তি ঝুলিয়ে রেখেছে আইএমএফ।
এ. কে. আজাদ বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে শিল্প ও সেবা খাত। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি এককভাবে আসছে তৈরি পোশাক থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কে উৎপাদন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উৎপাদন খাত ক্ষতির মুখে পড়লে স্বাভাবিকভাবে সেবা খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বীমা থাকার পরও তারা দাবি পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের তুলনায় অনেক দেশ এখন প্রতিযোগী সক্ষমতায় এগিয়ে আছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারতসহ অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সুদহার বেশি। এখনই নীতি সহায়তার মাধ্যমে উৎপাদন খাতের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রপ্তানিকারকদের সহায়তা করতে চাইলে আইএমএফের পরামর্শ মেনে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। ডলারের দরে কোনোভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার কারণে আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিআইবিএমের অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, রপ্তানি খাতকে সুবিধা দিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি প্রথা যুগোপযোগী করা দরকার। ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়ে আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব উর রহমান বলেন, রপ্তানি খাত এগিয়ে নিতে বাজারের পাশাপাশি নতুন ক্রেতা খুঁজে বের করতে হবে।
সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেন এডিবির বাংলাদেশ অফিসের প্রাইভেট সেক্টর অপারেশন্স বিভাগের লিড ইনভেস্টমেন্ট অফিসার বিদ্যুৎ কুমার সাহা এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের করপোরেট, বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিংয়ের এমডি এনামুল হক।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।