‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সব সুপারিশে একমত নয় ইসি
Published: 1st, May 2025 GMT
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং ফেরারি আসামিদের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করার সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ বলে মনে করছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক এই সংস্থা মনে করে, নতুন করে নির্বাচনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে এ সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য হবে। তারা বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে বলে ইসি সূত্র থেকে জানা গেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ৯টি প্রস্তাবের বেশ কিছু সুপারিশ আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১৯ মার্চ ইসিকে পাঠিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এগুলো বাস্তবায়নে কত সময় প্রয়োজন এবং এতে আর্থিক সংশ্লেষ আছে কি না, তা ইসিকে জানাতে বলা হয়েছিল। গতকাল বুধবার সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে মতামত পাঠিয়েছে ইসি। তাতে ১০-১২টি সুপারিশের ক্ষেত্রে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে একমত হয়েছে।
সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করার সুপারিশ আছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে যেসব সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলা হয়েছে, তার সব কটি আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করছে না ইসি। যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যয় এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয় আছে বলে ইসি মনে করে, সেগুলোকে এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে না তারা। আর যেসব সুপারিশে আইনে কিছুটা সংশোধন আনা হলে বাস্তবায়ন সম্ভব এবং রাজনৈতিক বিতর্ক নেই, আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই, সেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য মনে করে ইসি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে যে ৯টি প্রস্তাবকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলা হয়েছে, তার একটি হলো জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন’। এই আইনের ৪০টি ধারায় অনেকগুলো সংশোধন/সংযোজনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করার সুপারিশ আছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।এর আগে গত ১৮ মার্চ সংস্কার কমিশনের অন্তত ২৮টি সুপারিশের বিষয়ে ইসি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ভিন্নমত জানিয়েছিল। সেখানেও ‘আদালত কর্তৃক ফেরারি আসামি হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার’ সুপারিশের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছিল ইসি। তারা বলেছিল, এই বিধান করা হলে তা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরপিওতে সংশোধনী এনে ব্যালট পেপারে জলছাপ রাখার কথা বলা হয়েছিল। ইসি মনে করছে, এটি বাস্তবায়নের সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে। আবার কিসের জলছাপ থাকবে, তা নিয়েও আলোচনার বিষয় আছে। এই সুপারিশকেও ইসি আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করছে না।
অন্যদিকে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের সঙ্গে ইসি একমত। এটি বাস্তবায়িত হলে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। এখন ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’–এর আওতায় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। এর মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এই ১৬৬টি সুপারিশের বাইরে বেশ কিছু সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বাছাই করা আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ১৯ মার্চ পাঁচটি কমিশনের (সংবিধান সংস্কার কমিশন বাদে) এ ধরনের অন্তত ১২১টি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট ১৪টি মন্ত্রণালয়/বিভাগে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এগুলো বাস্তবায়নে কত সময় প্রয়োজন এবং এসব বাস্তবায়নে টাকা খরচ হবে কি না, হলে তা কত, সেই তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরগুলোকে জানাতে বলা হয়েছিল।
সুপারিশগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখেছি। যেগুলোতে রাজনৈতিক বিতর্ক নেই, সেগুলো আমরা দিয়ে দিয়েছিআবুল ফজল মো.সানাউল্লাহ, নির্বাচন কমিশনার
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে আইন-বিধিসংশ্লিষ্ট ৯টি প্রস্তাব। অবশ্য একটি প্রস্তাবে একাধিক সুপারিশ আছে। এগুলো মূলত আইন-বিধি ও প্রশাসনিক সংস্কার-সংক্রান্ত। সেগুলো হলো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন সংশোধন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধন, হলফনামার খসড়া, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ, পোস্টাল ব্যালটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করা।
আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর বিষয়ে মতামত জানাতে নির্বাচন কমিশন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় নিয়েছিল। গতকাল সে সময় শেষ হয়।
ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ইসির মতামত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটাদাগে আর্থিক সংশ্লেষ নেই এবং আইনে সামান্য সংশোধন করে বাস্তবায়ন সম্ভব—এমন ১০-১২টি সুপারিশের বিষয়ে ইসি একমত। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করা, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা–সংক্রান্ত সুপারিশ আছে। এ ছাড়া বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। আর কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এগুলো এখন যেভাবে আছে, সেভাবে থাকলেই চলে, পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।
এর আগে গতকাল দুপুরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সুপারিশগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখা হয়েছে। সুপারিশে তিনটি ক্যাটাগরি আছে, যেটা আশু বাস্তবায়নযোগ্য কিন্তু রাজনৈতিক কোনো বিতর্ক নেই, সেগুলো ইসি দিয়ে দিয়েছে। যেগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয় আছে, সেগুলো নিয়ে ইসি কোনো মন্তব্য করেনি। কিছু আছে বিধিসংশ্লিষ্ট, সেগুলো ইসি নিজে করতে পারবে।
ইসি সূত্র জানায়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধনের সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এ দুটি আইনের ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে ইসির মতামতও সংযুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন সংশোধনের সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ নেই। তবে তারা এ ক্ষেত্রেও সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে নিজেদের লিখিত মতামত তুলে ধরেছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালার বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ নেই। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধন এবং হলফনামার খসড়ার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এগুলো সংশোধনের জন্য পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। দেশের অভ্যন্তরে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। প্রবাসী ভোটারদের হালনাগাদের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পোস্টাল ব্যালট পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান। নির্বাচনী আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গেও আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান।
এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ইসি। ১৮ মার্চ ১০টি ক্ষেত্রে অন্তত ২৮টি সুপারিশের বিষয়ে নিজেদের ভিন্নমত লিখিতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরে ইসি। তাতে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সাংবিধানিক এই সংস্থার স্বাধীনতা খর্ব হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর র স প র শ সব স প র শ চ হ ন ত কর কর মকর ত প রস ত ব ব যবস থ গতক ল মত মত
এছাড়াও পড়ুন:
অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই: বিএনপি
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের দিকে সরকার অগ্রসর হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেটহীন একটি অনির্বাচিত সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে সেটি বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। তাই এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক মতৈক্যে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।
গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এমন আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এদিকে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়নি বলে দাবি করছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসকে মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তিনি।
এর আগে গত রোববার বিকেলে মানবিক করিডোর নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো, তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, এ বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে সম্মত। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, মানবিক করিডোরের ব্যাপারে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, সরকার এককভাবে স্পর্শকাতর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এই ইস্যুতে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। একই সঙ্গে রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি এবং এটা নিয়ে সরকার কী করছে, সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। এর পর সংবাদ সম্মেলন করে এর যৌক্তিকতা জাতির সামনে তুলে ধরবে।
বৈঠকে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, যেখানে মিয়ানমারে একটি যুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছে; দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে; আরাকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে জান্তা সরকার সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে– এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানবিক করিডোর দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
নেতারা আরও বলেন, শেখ হাসিনার আমলে রাখাইন রাজ্য থেকে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তারা বাংলাদেশের জন্য বিরাট বোঝা। এ অবস্থায় জাতিসংঘ রাখাইনে যে মানবিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষের কথা বলছে, সেটি নিয়ে বিএনপিও উদ্বিগ্ন। করিডোর দেওয়ার আগে রাখাইন রাজ্য নিয়ে প্রতিবেশী দুটি দেশ চীন ও ভারতের অবস্থান কী, সেটা নিয়েও আমাদের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়া এটা করলে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বিপদ হতে পারে। তাই এমন স্পর্শকাতর একটি ইস্যুতে সরকারের রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা এখনও বিষয়টি (রাখাইনে মানবিক করিডোর) পুরোপুরি জানি না। পত্রপত্রিকায় দেখেছি, সরকার একতরফাভাবে দেশের জনগণ তথা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা শুনেছি, মানবিক কারণে তারা এই করিডোর দেবে। কিন্তু সেটা কীভাবে দেবে, তা জানি না। এটাও শুনেছি– কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলো কী, জানি না। সরকারের উচিত বিষয়গুলো জাতিকে সুস্পষ্টভাবে জানানো। আমরাও এ বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জানার চেষ্টা করছি। এর পর আমরা দলের তরফ থেকে এ বিষয়ে অবস্থান জানাব।
গত সোমবার ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল। তারা (সরকার) একক সিদ্ধান্তে মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ করে দিচ্ছে। মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে আমাদের আপত্তি নেই। জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এটা হতে হবে সব মানুষের সমর্থনে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত, এটাই বাংলাদেশের অবস্থান: প্রেস সচিব
প্রেস সচিব শফিকুল আলম দাবি করেন, জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত– এটাই বাংলাদেশের অবস্থান। তিনি বলেন, সংকটকালে অন্য দেশকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বরাবরই ভূমিকা রয়েছে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মিয়ানমারে ভূমিকম্পের পর আমাদের সহায়তা। আমাদের আশঙ্কা, রাখাইন থেকে আরও মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, যা আমারা সামাল দিতে পারব না। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সহায়তা রাখাইনকে স্থিতিশীল রাখতে এবং শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ হয়ে ত্রাণ পাঠানোর বিষয়ে লজিস্টিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মতি সরকার। যদিও রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। যথাসময়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে।
হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদ
করিডোর দেওয়ার খবরে প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন সংগঠনটির নেতারা। গতকাল রাজধানীর খিলগাঁওয়ে জামিয়া ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলনে এ অবস্থান জানিয়েছেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। মামুনুল হক বলেন, বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে– দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই এটি সমর্থন করে না।
জাতীয় ঐকমত্য তৈরির পরামর্শ চরমোনাইয়ের
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম কুমিল্লা মহানগরের শূরা সম্মেলনে বলেছেন, বিস্তর বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সংকটে ফেলবে: সিপিবি
মানবিক করিডোরের খবরে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানিয়েছে সিপিবি। সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। সরকার দেশের বিদ্যমান সংবিধান লঙ্ঘন করে এই ভয়ংকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সংকটে ফেলবে।
এটি জাতিকে নিয়ে পাশা খেলার শামিল: বাসদ
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বিবৃতিতে বলেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফাভাবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আলোচনা ও সম্মতি ছাড়া অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া জাতিকে নিয়ে পাশা খেলার শামিল।
জাতীয় ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি: গণসংহতি আন্দোলন
মানবিক করিডোর বিষয়ে অবিলম্বে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গণসংহতি আন্দোলন। দলটি বলেছে, আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেলের বরাত দিয়ে দলটি বিবৃতিতে জানায়, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ বিষয়ে বিশদ আলাপ আলোচনা ও ঐকমত্য প্রয়োজন।