ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করতে সারাদেশের মতো গাইবান্ধা সদরসহ সাত উপজেলায় পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয় ছয় বছর আগে। এর অংশ হিসেবে কাউকে দেওয়া হয় টাকা, কাউকে দোকান তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, কেউ পেয়েছেন রিকশা বা সেলাই মেশিন। এত কিছুর পরও ভাগ্য ফেরেনি অনেকেরই। কারণ হিসেবে বিতরণে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বলছেন প্রকল্পের সুফলভোগী পরিবারের সদস্যরা।
পুনর্বাসনের পর সুফলভোগীরা কেমন আছেন– জানতে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে সমকাল। দেখা গেছে, প্রকল্পের বরাদ্দ সঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। পুনর্বাসন-পরবর্তী করণীয় বিষয়েও উদাসীন ছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি। তাদের মধ্যে ছিল সমন্বয়ের অভাব। এরকম নানা কারণে প্রকল্প সফলতার মুখ দেখেনি। তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা থাকলেও অনেকের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামের আয়নাল হক দেড় বছর আগে মারা গেছেন। বেঁচে থাকতে সমাজসেবা অফিস থেকে তাঁকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার মালপত্র দেওয়া হয়। যার মধ্যে ছিল চকলেট, তেল, লবণ, সাবান, চিপস ইত্যাদি। মালপত্র দেওয়ার পর সরকারি অফিসের কেউ আর যোগাযোগ করেনি।
আয়নাল হকের স্ত্রী ফুলমতি বেগম বলেন, ‘শুনেছি আমার স্বামীর জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার টাকা। আমরা পেয়েছি তার অর্ধেকেরও কম। তা দিয়ে দোকান চালানো মুশকিল ছিল।’
প্রকল্পের আরেক সুফলভোগী সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের প্রধানের বাজারের সিরাজুল ইসলাম। তাঁর ছেলে আনিছুর রহমান বলেন, ‘সমাজসেবা অফিস থেকে বাবাকে ২০ হাজার টাকার মালপত্র দেওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মালপত্র দেওয়া হয়েছে। দোকান কীভাবে চলবে তার খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি কেউ।’
একই অভিযোগ দাড়িয়াপুর এলাকার ভিক্ষুক আহম্মেদ আলীর স্ত্রী হালিমা বেগমের। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘স্বামী মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। পাবনা থেকে চিকিৎসা করিয়ে এনেছি। থাকার জায়গা নেই। তিন মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে অন্যের জায়গায় ঘর করে বসবাস করছি। সমাজসেবা অফিস দোকানঘর ও সামান্য কিছু মালপত্র কিনে দিয়েছিল। সে দোকানে বসতে দিচ্ছে না স্থানীয় কিছু লোক। এক বছর ধরে ফোনের ওপর ফোন করছি, অফিসের কেউ এসে দোকান চালানোর ব্যবস্থা করেনি।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভিক্ষুকদের কোনো তালিকা দেখাতে পারেননি। মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, জেলায় প্রায় তিন হাজার ভিক্ষুক আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তাদের পুনর্বাসনে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। চলতি বছর পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৭৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ টাকার পুরোটা এখনও ব্যয় হয়নি। এ পর্যন্ত জেলার সাত উপজেলায় ১২১ জন ভিক্ষুককে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই টাকায় শহরের পাঁচ ওয়ার্ডে পাঁচটি অটোরিকশা ও তৃতীয় লিঙ্গের দু’জনকে দুটি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একরামুল ও রাখু মিয়াকে দুটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দেওয়া হয়েছে। ওই মহল্লায় একরামুল ও রাখু নামের কোনো ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি। গত বছর একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দেওয়া হয় শহরের পুরোনো ব্রিজের নিচে বসবাসকারী বৃদ্ধ নারী রমিছা বেগমকে। রিকশার পেছনে লেখা রয়েছে এটি ক্রয়, বিক্রয় বা হস্তান্তরযোগ্য নয়। সেই রিকশাটি চালাচ্ছেন অন্য এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, কয়েক হাত বদলের পর তিনি রিকশাটি চালাচ্ছেন। রমিছা বেগম নামের কাউকে চেনেন না।
রমিছা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমজাদ ডিসি অফিসত নিয়্যে যায়া একটা রিকশা নিয়্যে দেয়। কিছুদিন পর তার শালা হাই মিয়া ১৮ হাজার ট্যাকাত সেই রিকশা বিক্রি করি দিচে। মোক এক ট্যাকাও দেয় নাই।’
সদর উপজেলা কমিটির সদস্য সচিব ও সদর সমাজসেবা কর্মকর্তা নাসিরুদ্দিন শাহ বলেন, ‘আমার এলাকায় ৭ জনকে প্রকল্পের সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন সঠিকভাবে হয়েছে।’ মালপত্র কম দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পটিতে কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে।
প্রকল্পের সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ আল হাসান বলেন, ভুক্তভোগীদের কেউ এখন পর্যন্ত অভিযোগ বা যোগাযোগ করেনি। আপনারাই বললেন। এখন খোঁজ নিয়ে অনিয়মের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেব।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফজলুল হক বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কমিটিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানরাও থাকেন। তারাই তালিকা করেন। মালপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসংগতি থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রকল্পের জেলা সভাপতি ও জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহম্মদ বলেন, অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পেলে ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সদর উপজ ল প রকল প র বর দ দ
এছাড়াও পড়ুন:
মাদ্রাসা ছাত্র হত্যার ঘটনায় দুই থানায় পৃথক মামলা, বাদী চিনেনা আসামিদের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জে মাদরাসা ছাত্র মো. ইব্রাহিম (১৩) হত্যার ঘটনায় দুই থানায় পৃথক পৃথক মামলা হয়েছে। নিহতের বাবা-মাকে মৃত দেখিয়ে কথিত মামা বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এর কিছুদিন পর একই ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী মো. হানিফ বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় মামলা দায়ের করেন। এ নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে নিহত ইব্রাহিমের বাবা হানিফ মিয়া ও মা সখিনা বিবি কে মৃত দেখিয়ে তার মামা পরিচয়ে মো. সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি গত ২২ আগস্ট ফতুল্লা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, মানবজমিন পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ও বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির জেলা প্রতিনিধি বিল্লাল হোসেন রবিন, আইনজীবী কামাল হোসেন সহ ৬১ জন নামীয় আসামি করা হয়। এছাড়া আরও অজ্ঞাত ১৫০-১৬০ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকাল আনুমানিক ৩ টার দিকে কোটা বিরোধী দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডের পাসপোর্ট অফিসের বিপরীত পাশে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে সমবেত হলে আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র সহ বিভিন্ন দেশিয় অস্ত্র নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথারি গুলি করে ও ককটেল বিস্ফোরণ করে।
এ সময় আমি ও আমার ভাগিনা মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৩) ভয়ে একটি দোকানের আড়ালে আশ্রয় নেই। হঠাৎ আমার ভাগিনা ইব্রাহিমের মাতায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরের দিন ২০ জুলাই মাগরিবের নামাজের পূর্বে মাতুআইল কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী ও নিহত ইব্রাহিমের কথিত মামা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নিহত ইব্রাহিম আমার বাড়ির পাশে কাজ করতো ও মাদ্রসায় পড়াশোনা করতো। তার বাবা-মায়ের সাথে তার সম্পর্ক নেই। আমি একটি সাইডের কন্ট্রাকটারি করি।
সম্প্রতি সে আমার সাথেও ওস্তাকারের সহকারী হিসেবে কাজ করেছে। সেই কাজের সুবাদে সে আমাকে মামা বলে ডাকতো। সে আমার আপন ভাগিনা না। তার হত্যার ঘটনার পর রাজনীতিক মামলা হয়েছে। যারা আন্দোলন করেছে তারা মামলার সবকিছু করেছে, আমি শুধু স্বাক্ষর দিয়েছি। আসামিদের কাউকে আমি চিনি না।
মামলার এজাহারে ইব্রাহিমের বাবা-মাকে মৃত উল্লেখ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইব্রাহিমের বাবা-মায়ের সংসার অনেক আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মামলায় কেন মৃত লেখেছে তা জানা নেই। তাছাড়া এই মামলায় স্বাক্ষর করা ছাড়া আমি আর কিছু জানিনা। মামলার কাগজে কি লিখছে তা আমি জানিনা।
এই ঘটনার নিহত ইব্রাহিমের বাবা সোনারগাঁ থানায় আরেকটি মামলা করেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা কী আমারটা আগে হয়েছে নাকি পরে হয়েছে। আপনে ফোন রাখেন ভাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফতুল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় সোনারগাঁ থানায়ও মামলা হয়েছে। এক ঘটনায় দুই থানায় মামলা হতে পারেনা। এ কারণে উর্ধ্বতনদের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে একই ঘটনায় নিহত মো. ইব্রাহিম (১৩) এর বাবা মো. হানিফ (৬৫) বাদী হয়ে গত ২৪ আগস্ট সোনারগাঁ থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ইব্রাহিমের নিহত হওয়ার স্থান ভিন্ন দেখানো হয়েছে।
এই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে পন্ড করার জন্য সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর ব্রীজের পূর্ব ঢাল হতে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে অস্ত্র নিয়ে হামলা করে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী হামলা চালিয়ে এলোপাথারি গুলি ছুড়ে ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়।
বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৩ টার দিকে ইব্রাহিমের বাম চোখের ভেতরে দিয়ে মাথায় পেছনের অংশ দিয়ে গুলি বের হয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়।
মামলার আসামি করা হয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ সহ ২৩৫ জন নামীয় আসামি এবং অজ্ঞাত আরও ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে সোনারগাঁ থানার মামলার বাদী ও নিহত ইব্রাহিমের বাবা মো. হানিফ কে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মফিজুর রহমান বলেন, এই মামলা আমাদের এখানে ফাইনাল হবে। এই ঘটনার প্রকৃত ঘটনাস্থল যেখানে সেই থানায় মামলা হবে।