নিখোঁজ অরিত্রের সন্ধানে সাগরপাড়ে অপেক্ষায় পরিবার
Published: 11th, July 2025 GMT
কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরিত্র হাসানের সন্ধান তিন দিনেও পাওয়া যায়নি। গত মঙ্গলবার সকাল ৭টায় অরিত্র হাসানসহ তার আরও দুই সহপাঠী সাগরে গোসল করতে নেমে ভেসে যান।
ঘটনার আড়াই ঘণ্টা পর কেএম সাদমান রহমান সাবাব (২১) নামে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ সৈকতে ভেসে আসে। পরদিন বুধবার সকাল ৯টার দিকে নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল সৈকতে আসিফ আহমেদ (২২) নামে আরও এক শিক্ষার্থীর মরদেহ পাওয়া যায়।
আসিফ আহমেদ বগুড়া সদরের নারুলি দক্ষিণের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি চবির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। সাদমান রহমান ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা কে এম আনিছুর রহমানের ছেলে। তিনিও চবির একই বিভাগের শিক্ষার্থী। তারা চবির শহীদ মো.
অরিত্র হাসান বগুড়ার দক্ষিণ সনসনিয়া গ্রামের আমিনুল ইসলামের ছেলে। তার বাবা আমিনুল ইসলাম। তিনি জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য নিউএজ’-এর জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক। আমিনুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখনো ছেলের সন্ধান পাইনি। আমার ছেলেকে খুঁজে বের করার অভিযান চলছে, আমরা তাকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।”
সন্তানের অপেক্ষায় কক্সবাজার সমুদ্রপাড়ে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে অরিত্র হাসানের পরিবার। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন জানিয়েছেন, তারা আরিত্রকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। “আমাদের দলগুলো মহেশখালী পর্যন্ত উত্তাল সমুদ্রে টহল দিচ্ছে দেহ উদ্ধারের জন্য। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি,”বলেন জেলা প্রশাসক।
নিখোঁজ অরিত্র হাসানের সন্ধানে সাগরে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ। তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিস, লাইফগার্ড, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও বিচকর্মীদের সমন্বয়ে ঘটনার পর থেকেই উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় খবর দেওয়া হয়েছে।’’
সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান গনি জানান, নিখোঁজ শিক্ষার্থীর খোঁজে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের মহেশখালী থেকে টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা পর্যন্ত উদ্ধারকর্মীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে উদ্ধার কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘‘হিমছড়ি সৈকতে একাধিক গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে গোসল করা ঝুঁকিপূর্ণ।”
নিহত শিক্ষার্থীরাও গুপ্তখালে আটকা পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা/তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অর ত র হ স ন ল ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
সিলেটে অনেক শহীদের পরিবার চরম বিপাকে
‘আমার ভাই তারেক সমাজের বৈষম্য দূর করতে গিয়েছিলেন। আজ পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যের শিকার। জুলাই ফাউন্ডেশন বা প্রশাসনের একজন লোকও সরাসরি এসে আমাদের কোনো খবর নেয়নি। তারা ঢাকায় বসে আর্থিক সহায়তার ভাগ করে দিল। মা ২০ ভাগ, আর বউ (তারেকের স্ত্রী) ৮০ ভাগ পাবে।
এই ভাগবাটোয়ারার কারণে তারেকের স্ত্রী সামিয়া তার সন্তান রাফিকে নিয়ে পিতার বাড়ি চলে গেছেন। আমাদের কষ্ট থাকত না যদি মায়ের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে সমাধান করে দেওয়া হতো। ধৈর্য ধরে আছি, যদি কেউ ফিরে তাকায়।’
আন্দোলনে গিয়ে গত ৫ আগস্ট বিয়ানীবাজার থানার সামনে গুলিতে নিহত তারেক আহমদের বড় বোন বিএ (সম্মান) উত্তীর্ণ তান্নি আক্তার এমন অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন। সাত সদস্যের পরিবারে তারেক ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। কম বয়সে বিয়ে করেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুারিতে মারা যান বাবা। তাঁর ওপর আরও চাপ বাড়ে। ছয় মাস পর তিনিও (তারেক) প্রাণ হারানোয় পরিবারের সদস্যরা দিশেহারা।
শুধু তারেকের পরিবার নয়, গোলাপগঞ্জে শহীদ তাজউদ্দিন ও সিলেট সদরের ইনাতাবাদ গ্রামের ওয়াসিমের পরিবারসহ অনেক শহীদের পরিবার পড়েছে চরম বিপাকে। এ ছাড়া আর্থিক সহায়তার ভাগ নিয়েও দেখা দিয়েছে বিভক্তি। কোনো কোনো শহীদের পরিবারে বিভক্তি না দেখা দিলেও প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে আছে হতাশা। এর মধ্যে শহীদ চার কিশোর ও তরুণের পরিবার সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত। তারা এখনও কিছুই পাননি। স্বীকৃতি পাওয়া প্রধান প্রত্যাশা হলেও তা মেলেনি। কবে মিলবে, এর উত্তরও পাচ্ছেন না তারা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সিলেট নগরীতে সাংবাদিক তুরাবসহ চারজন, জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ছয়জন, বিয়ানীবাজারে তিনজন ও গোয়াইনঘাটে তিনজন মারা যান। সিলেট জেলায় ১৬ জন ছাড়াও জুলাই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা যান জেলার আরও তিনজন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় মারা যান সিলেট শহরতলির বাসিন্দা ওয়াসিম, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বিয়ানীবাজারের চারখাই কাকুরা গ্রামের সুহেল আহমদ ও হবিগঞ্জ সদরে মারা যান সিলেটের টুকেরবাজারের গৌরীপুরের মোস্তাক আহমদ। তাদের স্বীকৃতি মিললেও সহায়তার ভাগ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। শহীদ পরিবারের অনেকেই ইতোমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার চেক ও সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও বিএনপি, জামায়াত এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি পর্যায়ে অনুদান পাচ্ছেন।
তবে জেলায় নিহত ১৬ জনের মধ্যে চারজনের ভাগ্যে জোটেনি সহায়তা ও স্বীকৃতি। তারা হলেন– গোয়াইনঘাট সদরের ফেনাই কোনা গ্রামের তরুণ ব্যবসায়ী সুমন মিয়া, পশ্চিম জাফলংয়ের ইসলামবাদ গ্রামের শ্রমিক নাহেদুল, পান্থুমাই গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম আহমদ রাহিম ও নগরীর ঝালোপাড়ার নিখিল চন্দ্র করের ছেলে সিএনজি অটোরিকশাচালক পংকজ কুমার কর। তাদের মধ্যে পংকজের নাম তালিকায়ই আসেনি। অন্য তিনজন ৫ আগস্ট স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় মারা যাওয়ার কারণে আপত্তি তোলেন স্থানীয় প্রশাসন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিনিধিরা। তাই তাদের স্বীকৃতি জোটেনি।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলার সদস্য সচিব ও সেই সময়ের ছাত্র প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম জানান, মূলত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করে মতামত দেন। সেখানে তাদের আন্দোলনে নিহত বলে উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে মামলা চলছে।
সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব ১৯ জুলাই নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় বিএনপির সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যান। তুরাবের মৃত্যুর আগের দিন ১৮ জুলাই শাবিপ্রবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন মারা যান।
নগরীতে শহীদদের আরেকজন সিএনজি অটোরিকশাচালক পংকজ কুমার কর। ৫ আগস্ট কোতোয়ালি থানার সামনে গুলিতে মারা যান তিনি। পরদিন তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তাঁর নাম তালিকায়ই আসেনি। এ জন্য তাঁর পিতা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন। একই দিন সিলেট সার্কিট হাউসের সামনে গুলিতে মারা যান পাবেল আহমদ কামরুল। তিনি গোলাপগঞ্জ ঢাকাদক্ষিণের কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে। জুলাই আন্দোলনে ৪ আগস্ট সবচেয়ে তুমুল সংঘর্ষ হয় গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। ওই দিন বিভিন্ন স্থানে গুলিতে মারা যান ছয়জন। তাদের একজন উপজেলার বারকোট গ্রামের মকবুল আলীর (প্রয়াত) ছেলে তাজউদ্দিন। সরকারি সহায়তার মধ্যে নিজের নামে ১০ লাখ টাকার প্রাইসবন্ড পেয়েছেন।
এ উপজেলার অন্য শহীদরা হলেন– ধারাবহর গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম, রায়গড় গ্রামের সুরাই মিয়ার ছেলে জয় আহমদ (হাসান), ঘোষগাঁওয়ের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন, পশ্চিম দত্তরাইল গ্রামে আলাউদ্দিনের ছেলে মিনহাজ আহমদ ও শিলঘাট লম্বাগাঁও গ্রামের কয়সর আহমদের ছেলে সানি আহমদ। মিনহাজের বড় ভাই আবুল কালাম অভিযোগ করেন, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় গোলাপগঞ্জে কোনো চত্বর বা সৌধ করা যায়নি।
বিয়ানীবাজারে ৫ আগস্ট তারেক ছাড়াও একই দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে গুলিতে মারা যান নয়াগ্রামের ময়নুল ইসলাম ও ফারুক আহমদের ছেলে রায়হান উদ্দিন। সবজি বিক্রেতা নিহত ময়নুলের স্ত্রী শিরিন বেগম একটি ঘরের ব্যবস্থা ও সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সহায়তা চান।
রাজধানীর বাড্ডায় শহীদ হন সিলেট সদরের ইনাতাবাদ গ্রামের কনর মিয়ার ছেলে ওয়াসিম। জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ৫ লাখ টাকার অনুদান এখনও জোটেনি শহীদ ওয়াসিমের পরিবারে। এর আগে ভাগ নিয়ে বিভক্তি শুরু হয় ওয়াসিমের বড় বোন শীপা বেগমের সঙ্গে। পিতার একাধিক সংসার থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিপা জানান, তাঁর মা মারা যাওয়ার পর পিতা কনর মিয়া আর কোনো খবর নেননি তাদের।
আর্থিক সহায়তার ভাগ নিয়ে পরিবারে বিভক্তি প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ সমকালকে জানান, বিষয়টি জুলাই ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখছে। শহীদের পরিবারের যারা অসহায় তাদের নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে আবেদন করতে বলেছি।
চারজনের স্বীকৃতি না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরুর দিকে স্থানীয় তদন্ত ও ছাত্র প্রতিনিধিদের আপত্তির কারণে তাদের নাম তালিকায় ওঠেনি। এ নিয়ে আদালতে নিহতদের পরিবার ও বিজিবির মধ্যে মামলা চলছে। এটা নিষ্পত্তির পরে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।