তথ্যপ্রযুক্তির প্রায় সব বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে। এর মধ্যে নারীর অবস্থান আরও পেছনে। দেশে পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেখানে ৫৮ শতাংশ, সেখানে নারীর মাত্র ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা মাত্র ২৪ শতাংশ। গ্রামের নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত না করা গেলে ডিজিটাল অগ্রগতি সমাজে নতুন বৈষম্য তৈরি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলো– ‘ডিজিটাল রূপান্তরে নারী-পুরুষের সমতায়ন’।
বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস শুরুর পেছনে রয়েছে টেলিগ্রাফের সম্পৃক্ততা। ১৮৬৫ সালের ১৭ মে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ কনভেনশনের মাধ্যমে গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন’। পরবর্তী সময়ে এটি রূপ নেয় আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ)। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৭ মে আন্তর্জাতিকভাবে পালন শুরু করে আইটিইউ। দিবসটি উপলক্ষে শুক্রবার দেওয়া এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
পিছিয়ে নারী
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ফাইভজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্লকচেইন এবং আইওটি প্রযুক্তি শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থারই উন্নয়ন ঘটায়নি, বরং কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাণিজ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীরা এ ক্ষেত্র অনেক পেছনে রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে এই বৈষম্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
আইটিইউর ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস ২০২৪’ অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৭০ শতাংশ পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে নারীর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ। এর মানে, ১৮ কোটি ৯০ লাখ পুরুষ নারীদের চেয়ে বেশি অনলাইনে রয়েছেন। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় বৈষম্য আরও প্রকট, সেখানে মাত্র ২৯ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে পুরুষদের হার ৪১ শতাংশ।
বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে এমন বৈষম্য দেখা যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর পিছিয়ে থাকার চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুসারে, দেশে শহুরে নারীদের ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। গ্রামে এই সংখ্যা ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। যেখানে পুরুষের মোবাইল ব্যবহারের হার ৮৬ শতাংশের বেশি।
গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) ‘মোবাইল ব্যবহারে লৈঙ্গিক পার্থক্য-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ নারী ইন্টারনেট সম্পর্কে জানলেও তা ব্যবহার করেন না। কারণ, তাদের মধ্যে শিক্ষা ও ডিজিটাল দক্ষতার অভাব রয়েছে।
ই-কমার্সসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ‘শি পাওয়ার’ ও ‘হার পাওয়ার’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এসব উদ্যোগ খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। সরকারি হিসাব বলছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে যারা পড়াশোনা করে, তাদের ২৯ শতাংশ নারী। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে মাত্র ১২ শতাংশ নারী তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যাদের অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কর্মী। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অবস্থান ১ শতাংশেরও কম। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিতে নারী উদ্যোক্তা ২ শতাংশেরও কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নরীদের দক্ষ করে গড়ে না তোলায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী কম। প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ যত বাড়বে, বৈষম্য তত কমবে। প্রযুক্তি খাতে নারীকে এগিয়ে নিতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন
এছাড়াও পড়ুন:
সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে বাদ যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের সুদ
সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদ, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বেশ কিছু কর্মসূচি বাদ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তাসহ নতুন কিছু প্রকল্প অন্তর্ভুক্তও হবে। সার্বিকভাবে এ খাত নিয়ে নতুন বাজেটে বেশ সংস্কারের ঘোষণা থাকছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তা খাতের চলমান আটটি কর্মসূচিতে ভাতা ও কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়লেও আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সার্বিকভাবে এ খাতে বরাদ্দ কমছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় থাকা ২১টি কর্মসূচিকে দরিদ্র মানুষের সুরক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মত দেওয়া হয়েছে। সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অবসরভোগী সরকারি কর্মচারীর পেনশন, কৃষি খাতে ভর্তুকি ও সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ। এ ধরনের কর্মসূচিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, যা এ খাতে মোট বরাদ্দের ৫৩ শতাংশ।
সরকারের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের (এনএসএসএস) সঙ্গে এই কর্মসূচিগুলোর মিলও নেই। তাই সামঞ্জস্যহীন কর্মসূচি বাদ দিয়ে প্রকৃত অর্থে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণবিষয়ক টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়। শুধু টাস্কফোর্সই নয়, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনীতিবিদরা বহুদিন থেকেই সামাজিক সুরক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
জানতে চাইলে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সম্প্রতি সচিবালয়ে উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে সাজানো হচ্ছে। এ খাতের পরিচালন বাজেটের অংশে সঞ্চয়পত্রে সুদ বাবদ যে বরাদ্দ রাখা হতো, তা অন্য খাতে দেখানো হবে– এমনটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সরকারি কর্মচারীর পেনশন, কৃষি খাতে ভর্তুকিসহ অন্যান্য কর্মসূচি এ খাতেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তাসহ এ খাতে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ খাত থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বেশ কিছু প্রকল্প বাদ যাবে। তবে এখন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত হয়নি। তাই কতগুলো প্রকল্প বাদ যাবে আর কতগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। নতুন করে অন্তর্ভুক্ত আর বাদ দেওয়ার পর সার্বিকভাবে এ খাতে মোট বরাদ্দ কিছুটা কমবে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের চলমান আটটি কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ও ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মা ও শিশু, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, বেদে এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতার পরিমাণ ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বেশি দেখানোর জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রতি অর্থবছরেই এ খাতের বরাদ্দ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে আসছিল। বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ জন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা জাতীয় বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রে সুদ বাবদ ব্যয় খাতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এটিসহ আরও কিছু কর্মসূচি বাদ যাওয়ায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ কমে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।