গবেষণা সূত্রে খাগড়াছড়ির এক দুর্গম পাড়ার অধিবাসী ধনময় চাকমার সঙ্গে পরিচয় হয় ২০২৩ সালে। এক উদ্যমী তরুণ, স্বপ্ন ছিল কলেজে পড়বে; কিন্তু বাঘাইছড়ির ওই দুর্গম এলাকা থেকে শহরে এসে কলেজে পড়ার সাহস করতে পারেননি। পরিবারকে সাহায্য করতে জুমে কাজ করেন। সময় পেলে নানা কাজে কাসালং পাহাড়ের গহিন বনে যান। তাঁর গ্রামে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। পাশের একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে জরুরি ফোনকল করেন। ধনময় মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন করে প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে নানা কথা জানতে চান। মুঠোফোনে তোলা বনের প্রাণীর ছবি পাঠান হোয়াটসঅ্যাপে। কিছু ছবি দেখে বেশ আহত হই। চোরা শিকারের কারণে দেশের দুর্লভ সব প্রাণী পাহাড় থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারি। একদিন গুলিতে আহত একটি সাম্বার হরিণের বাচ্চার কাতরানোর ছবি দেখে আঁতকে উঠি।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের কিছু গহিন জঙ্গলে এখনো যেসব বিরল প্রাণী কোনো রকমে টিকে আছে, তার মধ্যে সাম্বার হরিণ অন্যতম। সাম্বার আকারে বেশ বড়, কাঁধ বরাবর উচ্চতা চার ফুটের বেশি। লেজ ছাড়া লম্বায় সাত ফুটের মতো। ঘন বাদামি দেহে কোনো ছোপ নেই, সারা দেহ গাঢ় বাদামি, বেশি বয়সী সাম্বার অনেকটা কালচে। কান বেশ বড়। স্ত্রী আকারে পুরুষের চেয়ে কিছুটা ছোট হয়। শুধু পুরুষের শিং থাকে, পাশাপাশি কিছুটা ছড়ানো। শিং লম্বায় তিন ফুটের মতো। প্রতিটি শিঙে শাখা শিং থাকে তিনটি করে। অন্যান্য হরিণের শিং প্রতিবছর ঝরে পড়লেও সাম্বারের শিং একাধিক বছর টিকে থাকতে পারে। আধিপত্য বিস্তারে পুরুষে পুরুষে যখন লড়াই চলে, তখন এই শক্তিশালী শিং প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করে।
সাম্বার গহিন বনের বাসিন্দা। ঘাস, লতাপাতা, ফলমূল আহার করে। একাকী কিংবা জোড়ায় বিচরণ করতে দেখা যায়। সাধারণত রাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে যে বনে বাঘ বা চিতার মতো বড় আকারের শিকারি প্রাণী নেই, তেমন বনাঞ্চলে দিনেও আহারের জন্য বেরিয়ে পড়ে। পানির খোঁজে বহুদূর পর্যন্ত চলাচল করে। শীতকালে পাহাড়ে পানির সংকট থাকে, ফলে পানির জন্য পাহাড়ি ছড়ায় ছড়ায় ঘুরে বেড়ায়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের বনাঞ্চলে সাম্বারের দেখা মেলে। অতীতে বাংলাদেশের সব পাহাড়ি বনাঞ্চলে সাম্বারের উপস্থিতি ছিল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের দু–একটি খণ্ড বন ছাড়া দেশে এই প্রাণী আর কোথাও দেখা যায় না। এশীয় বনাঞ্চলে এটি সংকটাপন্ন হলেও বাংলাদেশে সাম্বারকে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রাখা হয়েছে। চোরা শিকার ও বাসস্থানের অবক্ষয়ের কারণে এই প্রাণী দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আকারে বড় হওয়ায় শিকারিদের পছন্দের তালিকায় এটি ওপরের দিকে থাকে।
গত বছর কাসালং বনে অল্প পরিসরে কিছু স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ট্র্যাপ স্থাপন করি। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে ক্যামেরায় সাম্বারের ছবি দেখে আনন্দে আপ্লুত হই। বারবার ছবিটি দেখি, সত্যিই ক্যামেরায় সাম্বার হরিণ ধরা পড়েছে! কারণ, আমাদের কোনো প্রাকৃতিক বনে এই হরিণ সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ফলে এটি যে আমাদের কোনো বনে এখনো আছে, তা সহজে মানসপটে ভাসে না। ক্যামেরা-ট্র্যাপে ছবি পাওয়ার কয়েক মাস পরেই ধনময় চাকমার পাঠানো সাম্বারের বাচ্চার ছবিটি দেখে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। সত্যিই কি আমাদের জীবদ্দশায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন সুন্দর প্রাণীটি?
বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া কিছু প্রাণীকে আবার তাদের আবাসে ফিরিয়ে আনা যায় কি না, তা নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি খুবই আশার কথা। তবে বিলুপ্ত প্রাণী আবার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি অতটা সহজ নয়, সরলও নয়। এমন উদ্যোগের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নিয়মিত অর্থের জোগান, ক্যাপটিভ পরিবেশে বন্য প্রাণী প্রজননে দক্ষতা ও হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর আবাসস্থল পুনরুদ্ধার। আমাদের এই সব কটি বিষয়েই ঘাটতি আছে। তা ছাড়া যে কারণে বুনো পরিবেশ থেকে ওই প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল, সেসব হুমকি নির্মূল করতে না পারলে ফিরিয়ে আনা প্রাণী আবারও হারিয়ে যাবে।
খাগড়াছড়ির কাসালং বনে ক্যামেরা-ট্র্যাপে ধারণ করা পুরুষ সাম্বার হরিণ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
বিরল সাম্বার কি হারিয়ে যাবে
গবেষণা সূত্রে খাগড়াছড়ির এক দুর্গম পাড়ার অধিবাসী ধনময় চাকমার সঙ্গে পরিচয় হয় ২০২৩ সালে। এক উদ্যমী তরুণ, স্বপ্ন ছিল কলেজে পড়বে; কিন্তু বাঘাইছড়ির ওই দুর্গম এলাকা থেকে শহরে এসে কলেজে পড়ার সাহস করতে পারেননি। পরিবারকে সাহায্য করতে জুমে কাজ করেন। সময় পেলে নানা কাজে কাসালং পাহাড়ের গহিন বনে যান। তাঁর গ্রামে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। পাশের একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে জরুরি ফোনকল করেন। ধনময় মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন করে প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে নানা কথা জানতে চান। মুঠোফোনে তোলা বনের প্রাণীর ছবি পাঠান হোয়াটসঅ্যাপে। কিছু ছবি দেখে বেশ আহত হই। চোরা শিকারের কারণে দেশের দুর্লভ সব প্রাণী পাহাড় থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারি। একদিন গুলিতে আহত একটি সাম্বার হরিণের বাচ্চার কাতরানোর ছবি দেখে আঁতকে উঠি।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের কিছু গহিন জঙ্গলে এখনো যেসব বিরল প্রাণী কোনো রকমে টিকে আছে, তার মধ্যে সাম্বার হরিণ অন্যতম। সাম্বার আকারে বেশ বড়, কাঁধ বরাবর উচ্চতা চার ফুটের বেশি। লেজ ছাড়া লম্বায় সাত ফুটের মতো। ঘন বাদামি দেহে কোনো ছোপ নেই, সারা দেহ গাঢ় বাদামি, বেশি বয়সী সাম্বার অনেকটা কালচে। কান বেশ বড়। স্ত্রী আকারে পুরুষের চেয়ে কিছুটা ছোট হয়। শুধু পুরুষের শিং থাকে, পাশাপাশি কিছুটা ছড়ানো। শিং লম্বায় তিন ফুটের মতো। প্রতিটি শিঙে শাখা শিং থাকে তিনটি করে। অন্যান্য হরিণের শিং প্রতিবছর ঝরে পড়লেও সাম্বারের শিং একাধিক বছর টিকে থাকতে পারে। আধিপত্য বিস্তারে পুরুষে পুরুষে যখন লড়াই চলে, তখন এই শক্তিশালী শিং প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করে।
সাম্বার গহিন বনের বাসিন্দা। ঘাস, লতাপাতা, ফলমূল আহার করে। একাকী কিংবা জোড়ায় বিচরণ করতে দেখা যায়। সাধারণত রাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে যে বনে বাঘ বা চিতার মতো বড় আকারের শিকারি প্রাণী নেই, তেমন বনাঞ্চলে দিনেও আহারের জন্য বেরিয়ে পড়ে। পানির খোঁজে বহুদূর পর্যন্ত চলাচল করে। শীতকালে পাহাড়ে পানির সংকট থাকে, ফলে পানির জন্য পাহাড়ি ছড়ায় ছড়ায় ঘুরে বেড়ায়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের বনাঞ্চলে সাম্বারের দেখা মেলে। অতীতে বাংলাদেশের সব পাহাড়ি বনাঞ্চলে সাম্বারের উপস্থিতি ছিল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের দু–একটি খণ্ড বন ছাড়া দেশে এই প্রাণী আর কোথাও দেখা যায় না। এশীয় বনাঞ্চলে এটি সংকটাপন্ন হলেও বাংলাদেশে সাম্বারকে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রাখা হয়েছে। চোরা শিকার ও বাসস্থানের অবক্ষয়ের কারণে এই প্রাণী দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আকারে বড় হওয়ায় শিকারিদের পছন্দের তালিকায় এটি ওপরের দিকে থাকে।
গত বছর কাসালং বনে অল্প পরিসরে কিছু স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ট্র্যাপ স্থাপন করি। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে ক্যামেরায় সাম্বারের ছবি দেখে আনন্দে আপ্লুত হই। বারবার ছবিটি দেখি, সত্যিই ক্যামেরায় সাম্বার হরিণ ধরা পড়েছে! কারণ, আমাদের কোনো প্রাকৃতিক বনে এই হরিণ সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ফলে এটি যে আমাদের কোনো বনে এখনো আছে, তা সহজে মানসপটে ভাসে না। ক্যামেরা-ট্র্যাপে ছবি পাওয়ার কয়েক মাস পরেই ধনময় চাকমার পাঠানো সাম্বারের বাচ্চার ছবিটি দেখে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। সত্যিই কি আমাদের জীবদ্দশায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন সুন্দর প্রাণীটি?
বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া কিছু প্রাণীকে আবার তাদের আবাসে ফিরিয়ে আনা যায় কি না, তা নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি খুবই আশার কথা। তবে বিলুপ্ত প্রাণী আবার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি অতটা সহজ নয়, সরলও নয়। এমন উদ্যোগের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নিয়মিত অর্থের জোগান, ক্যাপটিভ পরিবেশে বন্য প্রাণী প্রজননে দক্ষতা ও হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর আবাসস্থল পুনরুদ্ধার। আমাদের এই সব কটি বিষয়েই ঘাটতি আছে। তা ছাড়া যে কারণে বুনো পরিবেশ থেকে ওই প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল, সেসব হুমকি নির্মূল করতে না পারলে ফিরিয়ে আনা প্রাণী আবারও হারিয়ে যাবে।
খাগড়াছড়ির কাসালং বনে ক্যামেরা-ট্র্যাপে ধারণ করা পুরুষ সাম্বার হরিণ