খাগড়াছড়ি জেলায় পাহাড় ধসের সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সরেজমিন পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করেছে জেলা প্রশাসন। 

জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাসান মারুফের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার (২৯ মে) বিকেলে শহরের শালবন, কলাবাগানসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা ঘুরে দেখে একটি টিম। সেসময় মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করা হয়।

পরিদর্শনকালে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন যেন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কেউ বসবাস না করেন এবং প্রয়োজনে নিরাপদ স্থানে সরে যান। 

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন স্থানে মাইকিং ও সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

অভিযানে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন চন্দ্র রায়, সহকারী কমিশনাররাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিট্রেট হাসান মারুফ জানান, স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

ঢাকা/রূপায়ন/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

খুনির শাস্তি চাই, শাস্তি চাই অগ্নিসংযোগকারী-লুটপাটকারীর

২৭ মে গিয়েছিলাম যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটি গ্রামে। ২২ মে ২০২৫, ওই গ্রামে তরিকুল ইসলাম নামের বিএনপির নেতা সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হন। তিনি অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন। তাঁর খুন হওয়ার খবর পেয়ে ওই এলাকায় শত শত মানুষ জমায়েত হন এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮টি বাড়িতে লুটপাট করেন এবং অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী বাজারে কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। 

ডহর মশিয়াহাটি গ্রামে পাকা সড়ক–সংলগ্ন পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলোতে যখন প্রবেশ করি, তখন তীব্র পোড়া গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছিল। পোড়া বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখি, আধপোড়া কাপড়ের স্তূপ, পুড়ে যাওয়া আসবাব, মোটরসাইকেল, রান্নার ব্যবহার্য জিনিসপত্রসহ অনেক কিছু। 

প্রথমে বাড়িতে প্রবেশ করে পেলাম উষা বিশ্বাস নামের সেই ঘরের বয়স্ক এক বাসিন্দাকে। ঘরের বারান্দায় বসে থাকা উষার চোখেমুখে গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল সেদিন? তিনি ২২ মে হামলার ঘটনার বর্ণনা দিলেন। আগুন থেকে একটি ঘর রক্ষা পেলেও সেটিও লুটপাট হয়। হামলাকারীদের বাধা দিতে গেলে তারা তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। 

উষার ছেলের বউ রেখা বিশ্বাস আগুন দেওয়ার সময় বাড়ির পাশে ছিলেন। তিনি জানালেন, উত্তেজিত জনতাকে বলতে শুনেছেন, ‘মাইরে ফেলায় দেব, কাইটে ফেলায় দেব, আগুন লাগায় দেব।’ রেখার ছেলেরও বিয়ে হয়েছে, কয়েক মাস আগে। তিনি জানান, ছেলের বিয়ের সময় বানানো কয়েক ভরি গয়না ও বিয়েতে পাওয়া সেলাই মেশিন পাওয়া যায়নি। পানি সেচ দেওয়ার দুটি মোটর ছিল, সেগুলো পুড়ে গেছে। 

পাশের বাড়ি পান্না বিশ্বাসের। কয়েকজন নারীসহ তিনি বসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হলো। পান্না বললেন, তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে এবং স্কুলপড়ুয়া ছেলে বাড়িতে ছিল। যখন একটি কক্ষে লুটপাট শুরু হয়, তখন তাঁরা পাশের কক্ষ ভেতর থেকে আটকে দিয়ে খাটের নিচে আত্মগোপন করে ছিলেন। বাড়িতে আগুন দিলে প্রাণ নিয়ে তাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন। বাচ্চা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কি না, এই ভয়ে তিনি চিৎকার করে কান্নাকাটি করেছেন। আগুন লাগার পর কোনোরকমে দরজা ঠেলে তাঁরা বের হতে পেরেছেন। সেদিনের পরিস্থিতির পর তাঁর ছেলে এখন কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। কেউ ডাকলে কেবল তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকছেন। মেয়েটিকে তার বান্ধবীরা নিয়ে গেছে। তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে। 

হামলার দিন গ্রামের যে বাড়িতে তিন দিনব্যাপী যজ্ঞানুষ্ঠান হচ্ছিল, সেই বাড়িতে প্রবেশ করে দেখি, রান্নার সবজি, বড় বড় পাতিল পড়ে আছে। পাশেই অনেকগুলো ডঙ্কা (বাদ্যযন্ত্র), ডঙ্কার পাশে পড়ে আছে পোড়া মোটরসাইকেল, কয়েকটি বাইসাইকেল। সে বাড়ির এক নারী বললেন, ‘মারটা আমাকে মাইরেছে বেশি। চ্যাপ্টা খুন্তি দিয়ে মাইরেছে।’ অনুষ্ঠানে আসা কয়েকজন মার খেয়েছেন। সেখানে কয়েক শ মানুষের রান্না হয়েছিল। মারপিট-লুটপাট-অগ্নিসংযোগে যজ্ঞানুষ্ঠান পণ্ড হয়। 

উপস্থিত একজন জানাচ্ছিলেন, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন প্রস্তুতি নিয়ে এক পথে আসার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। তাঁদের পথে আটকে দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁরা বিকল্প পথে অনেকখানি ঘুরে এসেছেন। 

ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার সরকারি সহায়তা পেয়েছে ৩০ কেজি চাল, ২ বান্ডিল টিন, ৬ হাজার টাকা, ২ করে কম্বল। বেসরকারি কিছু সহায়তা মিলেছে। বাড়িতে অনেকে থাকতে পারছেন না। থাকার অবস্থা হয়নি। আবার তাঁদের ভয়ও করছে। অনেকের পরনের পোশাক ছাড়া আর কিছুই নেই। পান্না বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট ও সপ্তসারথী ফাউন্ডেশন থেকে চাল-তেল-ডাল-সবজি দিয়ে গেছে। কিন্তু রাঁধব কোথায়, রান্নার পাত্র কোথায়?’ 

পান্না বিশ্বাসের বাড়ির পাশের বাড়িতে দেখলাম, একজন নারী বিষণ্ন মনে বসে আছেন। সবকিছু পুড়ে তাঁরা নিঃস্ব। তাঁদের ৪০ মণ ধান ছড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। করুণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। 

তরিকুল ইসলামকে খুন করা হয়েছে। যে খুন করেছে, তার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে হবে। তরিকুল ইসলাম যেহেতু বিএনপির নেতা, সেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, এখন তাঁর খুনিদের খুঁজে বের করা সহজ হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে। এটা আমরা চাই। মতুয়া সম্প্রদায়ের যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁরাও খুনের বিচার চান। সম্প্রদায় বিবেচনায় নয়, মানুষ হিসেবে এ খুনের বিচার না চাওয়ার কোনো কারণ নেই। তরিকুল ইসলামের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে খুনের বিচার না চেয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের বাড়িতে যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাট করেছে, তারা আর প্রকাশ্যে বিচার চাইতে পারবে কি? কারণ, তারা খুনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেক অপরাধ করেছে। 

প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে হামলা বা হানাহানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু সম্প্রদায় বিবেচনা করে যদি সেই হামলা হয়, তা আরও বেশি মেনে নেওয়া যায় না। এটিও তখন হয়ে পড়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আঘাত। সেই আঘাতের ক্ষত সহজে
সারে না। আমি রংপুরের তারাগঞ্জে ঠাকুরবাড়িতে, রংপুরের পীরগঞ্জে জেলেপাড়ায় এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লিতে আগুন দেওয়ার পরবর্তী ভুক্তভোগীদের কাছে থেকে দেখেছি। তাঁরা স্বাভাবিক হতে দীর্ঘদিন লেগেছে। 

এসব পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর আইনের কঠোর প্রয়োগ তো হতেই হবে। তরিকুল ইসলামের খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারপূর্বক শাস্তির আওতায় আনা হোক, যারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদেরও বিচার হোক। 

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ