বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনের মাঠে যেন ক্রিকেটের বইয়ে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত করল ইংল্যান্ড। বৃহস্পতিবারের (২৯ মে) ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এমন এক নজির গড়েছে তারা, যা শুনলে যে কেউ চোখ কপালে তুলবেন। তাদের একজন ব্যাটারও শতক হাঁকাতে পারেননি। অথচ দলীয় স্কোর গিয়ে ঠেকেছে ৪০০ তে! আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বোলিংয়ে বিধ্বংসী পারফরম্যান্স। ফলাফল, ২৩৮ রানের দুর্দান্ত জয় এবং সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়া।

টস জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাট করতে আমন্ত্রণ জানান ক্যারিবীয় অধিনায়ক শাই হোপ। প্রথম দশ ওভারেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই সিদ্ধান্ত বড় ভুল হতে চলেছে। ইংলিশ ইনিংসের ভিত্তিপ্রস্তর রাখেন জেমি স্মিথ ও বেন ডাকেট। তাদের ঝড়ো সূচনা এনে দেয় ৭ ওভারে ৬৪ রানের জুটি। ডাকেট খেলেন ৪৮ বলে ৬০ রানের স্বচ্ছন্দ এক ইনিংস।

এরপর শুরু হয় মিডল-অর্ডারের সম্মিলিত কনসার্ট। জো রুটের দায়িত্বশীল ৫৭, অধিনায়ক হ্যারি ব্রুকের অনুপ্রেরণাদায়ী ৫৮ এবং জ্যাকব বেথেলের বিস্ফোরক ৮২ রানের ইনিংস এই রান পাহাড়ের মূল ভিত্তি। বেথেল মাত্র ৫৩ বলে এই ইনিংসে হাঁকান ৮টি চার ও ৫টি ছক্কা। পাশে ছিলেন উইল জ্যাকস, যিনি ২৪ বলে যোগ করেন মূল্যবান ৩৯ রান।

আরো পড়ুন:

আইপিএলে ইতিহাস গড়া ছয় বলে ছয় ছক্কা

৬৪ বছর বয়সে অভিষেক, ইতিহাস গড়লেন জোয়ানা চাইল্ড

শেষ পর্যন্ত ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে উঠে ৪০০ রান। এটি একটি এমন ইনিংস, যেখানে চারজন হাফ-সেঞ্চুরি পেলেও কারো ব্যাট ছুঁতে পারেনি শতকের মাইলফলক। এটাই ছিল ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ঘটনা যেখানে কোনো সেঞ্চুরি ছাড়া ৪০০ রান করেছে কোনো দল।

এই রান তাড়া করতে নেমে ক্যারিবীয় ব্যাটাররা যেন ছায়া হয়ে ছিলেন নিজেদেরই। একে একে ফিরেছেন প্রায় সবাই। সবচেয়ে লজ্জার পরিসংখ্যান সর্বোচ্চ স্কোর এসেছে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান জাইডেন সিলসের ব্যাট থেকে (২৯ রান)। অধিনায়ক হোপ ২৫ ও কিসি কার্টি ২২ রান করলেও তা কেবল পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়েছে। শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৬.

২ ওভারেই গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৬২ রানে।

সাকিব মাহমুদ ও জেমি ওভার্টনের আগুনঝরা স্পেলে তুলে নেন ৩টি করে উইকেট। আদিল রশিদ নেন ২টি উইকেট। পুরো ইনিংসজুড়ে ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে প্রতিরোধের সুযোগই পায়নি সফরকারীরা।

সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে ১ জুন, কার্ডিফে। প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের এমন তাণ্ডবের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে দাঁড়াতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ঢাকা/আমিনুল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক র ক ট র কর ড

এছাড়াও পড়ুন:

ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন

কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ। 

এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।

একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।

দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।

পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।

ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।

এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।

বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।

এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”

যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।

বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”

তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।

প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।

এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।

ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”

শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন