বিশ্ববাজার থেকে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত (ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল, অকটেন) তেল আমদানি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বর্তমানে যে দামেই আমদানি করুক, নির্ধারিত মূল্যের (ট্যারিফ ভ্যালু) ওপর শুল্ক দেয় বিপিসি। জ্বালানি তেলের কেনা দামের ওপর (ইনভয়েস ভ্যালু) আমদানি শুল্ক আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এতে বিপিসির খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা। তাই খরচ একই রকম থাকতে আমদানি শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ ও পরিশোধিত বিভিন্ন জ্বালানি তেলের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সব মিলে শুল্ক আদায় একই রকম থাকতে পারে। তাতে বিপিসির খরচে তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে আনুপাতিক হারে শুল্ক আদায় বাড়বে এবং তাতে আমদানি খরচ বাড়বে বিপিসির।

বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে জ্বালানি তেল আমদানিতে ট্যারিফ মূল্য কার্যকর আছে। বর্তমানে আমদানি মূল্য তার চেয়ে বেশি। কাস্টমস আইন অনুসারে দাম বেশি হলে কেনা দামে শুল্কায়ন করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু বেসরকারি খাত কেনা দামে শুল্ক দিলেও বিপিসি ট্যারিফ মূল্যের ওপর শুল্ক দিচ্ছে। এর ফলে এনবিআরের পাওনা বাড়ছে, যা বিপিসি পরিশোধ করছে না। তাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কেনা দামে এমনভাবে শুল্কায়নের অনুরোধ করেছে, যাতে সরকারের রাজস্ব আদায় আগের মতো বা কাছাকাছি থাকে।

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানি খরচ একই রকম থাকলেও বেসরকারি খাতে আমদানি খরচ কমবে। বেসরকারি খাত আগে থেকেই কেনা দামে শুল্ক দেয়। তাই শুল্কহার কমায় তাদের আমদানি খরচ কমবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব সরক র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

কাফন

যেসব দিনে শাজিয়া ফজরের নামাজের জন্য সময়মতো উঠতে পারতেন না, সেসব দিনেই তিনি এ জন্য তাঁর উচ্চ রক্তচাপকে দোষ দিতেন। আর ওই সব জঘন্য ট্যাবলেটকে দায়ী করতেন। তাঁর মা বলতেন, ‘সবই তো শয়তানের খেলা! শয়তান ভোরে এসে তোমার পা চেপে ধরে, তোমার ওপর কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে তারপর আবার তোমাকে আরামের ঘুম পাড়িয়ে দেয় যাতে তুমি নামাজ পড়তে না পারো। তোমার তাকে লাত্থি মেরে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করা উচিত।’

ব্যক্তিগত সেবকের মতো শয়তান তাঁর পা টিপে দিচ্ছে, এই ধারণা শাজিয়ার মনে বেশ রোমান্টিক স্বপ্নের মতো আনন্দ দিত। মুচকি হেসে বেশ কয়েকবার লাথি মারার ভান করে রোমাঞ্চকর মধুর ভাবনায় ডুবে যেতেন। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা আর এর জন্য শয়তানকে দোষারোপ করা তাঁর অভ্যাস হয়ে গেল।

ওই দিনও শাজিয়া গভীর ঘুমে ডুবে ছিলেন। ফজরের ওয়াক্ত অনেকক্ষণ আগেই পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ অজান্তেই জেগে উঠলেন তিনি। চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন, কোথায় আছেন! পাশে স্বামীর মৃদু স্পর্শ পেয়ে মনে হলো, সব ঠিক আছে। তখনই তিনি দেখল, তাঁর মাথা নিজের বালিশে আর বিদেশি কম্বলটি চারপাশে ছড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলেন, তিনি নিজের ঘরে, নিজের বাড়িতে আছেন। পরিচিত পরিবেশে ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারটি তাঁকে আনন্দ আর আরাম দুটোই দিল। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। বাইরে কারও কান্নার শব্দ শোনা গেল। ধীরে ধীরে উঠে যখন দরজায় গেলেন, তখনই পুত্র ফরমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। তাড়াতাড়ি বারান্দায় এসে দেখলেন, আলতাফ দাঁড়িয়ে আছে বিমর্ষ চেহারায়। ফরমান তাকে শান্ত করছিল। ‘যা ঘটেছে, তা ঘটেছে। এসবে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। চিন্তার কিছু নেই। ফিরে যাও। আম্মি জাগলে আমি সবকিছু তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেব। এখন তিনি ঘুমাচ্ছেন। ওনাকে জাগাতে চাই না। শরীরটা ভালো নয়। চিকিৎসকও বলেছেন, অনেক বিশ্রাম নিতে।’

‘কিন্তু ভাইয়া, জামাত ঠিক করেছে যে আজই পাঁচটায় দাফন করা হবে। আমরা আর কারও জন্য অপেক্ষা করছি না। তাই গোসল আর অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত শেষ করতে হবে।’ আলতাফ আবার বলল। ফরমান মেজাজ হারিয়ে বলল, ‘দেখো, তুমি আমাকে তুলে রাখার জন্য কোনো কাফন দাওনি। আম্মি হজ থেকে ফিরে আসার পর ছয়-সাত বছর কেটে গেছে। এত বছর হয়ে গেল, ইয়াসিন বুয়া আম্মির কাছ থেকে তার কাফন কেন নিয়ে যায়নি? কিংবা হয়তো নিয়েছিল আর কোথাও রেখে দিয়েছে। আবার বাড়িতে খোঁজ করে দেখো।’ শাজিয়া তাঁর ছেলের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে গেলেন। ‘এখানে কী হচ্ছে?’ তিনি ডাকলেন, ‘ফরমান, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ, বাবা?’ ফরমান তার মায়ের দিকে ফিরে তাকাল। তাঁর মুখে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। সে মনে মনে ভাবল, মহিলারা চুপ করে থাকতে পারে না? নিজের খাওয়াদাওয়া, সাজগোজ নিয়ে থাকতে পারে না? নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারে না? অন্য কাজে না জড়ালে যেন তাঁদের খাবার হজম হয় না। কিন্তু সে তার মনের অসন্তোষ বুঝতে না দিয়ে বলল, ‘ঘুমাও, আম্মি। তুমি কেন উঠে এসেছ? আলতাফ এখানে এসেছে। সে বলছে যে সে ইয়াসিন বুয়ার ছেলে। কিছু কাফনের কাপড়ের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছে।’

শাজিয়ার মাথায় যেন বাজ পড়েছে। উদ্বিগ্ন চেহারায় তিনি ছুটে এগিয়ে গেলেন। ছেলেটির দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সকাল সকাল এত হুলুস্থুল; কেন করছ এসব? কাফন কোথায় যাবে? তুমি কি বুঝতে পারছ না কার বাড়িতে কখন যাওয়া উচিত?’

মনে মনে স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, ফরমান এই সব পছন্দ করেনি। আলতাফ নিচু কণ্ঠে হতাশ মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মি আজ ফজরের নামাজের সময় মারা গেছেন। তাই আমি কাফনের কাপড় চাইতে এসেছি।’ খবরটা শুনতেই শাজিয়ার মনটা ভেঙে পড়ল। চাপ সামলাতে না পেরে, কাছের একটি চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন। ‘অবিশ্বাস্য, অসম্ভব! সবকিছু ঘটে গেছে! এখন কীভাবে সামলাব? কীভাবে সব ঠিক করব?’ প্রশ্নগুলো একের পর এক তাঁর মনে আসতে লাগল। বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। হায় আল্লাহ, এটা কী হলো! বিলাপ করে উঠলেন শাজিয়া। না চাইতেও মনটা অতীতের স্মৃতির দিকে ছুটে চলল তাঁর।

সেদিন শাজিয়াদের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠান ছিল। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনসহ প্রায় সবাই জমায়েত হয়েছিলেন। শাজিয়া আর তাঁর স্বামী সুবহান হজে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই বেশির ভাগ নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব তাঁদের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে শাজিয়া ও সুবহান অনুরোধ করেছিলেন, যেকোনো ‘কাহা-সুনা’ যেন মাফ করে দেন। এই দম্পতির অনিচ্ছাকৃত অপরাধ, প্রিয়জনকে বলা কোনো কটু কথা বা অভিযোগ এবং তাঁদের সম্পর্কে যেকোনো গুজব—সবকিছু ক্ষমা করে দেওয়া হোক। আত্মীয়রা শাজিয়া-সুবহানের জন্য বড়সড়ো খাওয়াদাওয়ারও আয়োজন করেছিলেন। দুজনকেই তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক ও উপহার দিয়েছিলেন। ক্ষমার আশ্বাস দিয়ে তাঁরাও অনুরোধ করেছিলেন যেন শাজিয়া ও সুবহান তাঁদের অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেন। ভুলগুলো পারস্পরিকভাবে ক্ষমা করা হয়েছে এবং অন্যান্য নিয়ম মেনে চলা হয়েছে, এই সন্তুষ্টি নিয়ে আত্মীয় ও বন্ধুরা আনন্দের সঙ্গে তাঁদের বিদায় জানিয়েছিলেন।

যদিও হজযাত্রার এখনো এক সপ্তাহ বাকি, তারপরও অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। স্বামী–স্ত্রী দুজনে মিলে দূরদূরান্তের আত্মীয়দের কাছে ফোন করে ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিলেন। সুবহান সাহেব ব্যস্ত ব্যবসায়ী। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো শাখা আছে। অন্যদিকে শাজিয়া সুবিশাল এক বাংলোবাড়ির মালকিন। পরিবারের সব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব—সবার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করার সময় পাননি। সে কারণেই পারস্পরিক ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সবাইকে একত্র করে একটি ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল।

বিনা আমন্ত্রণে কিন্তু মনের ভেতর কোনো রকম অহংকার বা বিদ্বেষ ছাড়া একজনই এসেছিলেন, তিনি হলেন ইয়াসিন বুয়া। বিয়ের মাত্র তিন বছরের মধ্যে দুই সন্তানের জন্মের পর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। আর কখনোই কোনো খোঁজখবর নেননি। লোকটি সরকারি এপিএমসির উঠানে লোডারের কাজ করতেন। একদিন ভার বহন করার সময় হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দতের বিধিবিধান পালন করেননি ইয়াসিন বুয়া। ওই সময়ের অল্প বয়সী তরুণীটি কোনোরকমে মাথায় একটুকরো কাপড় জড়িয়ে মানুষের বাড়ির সামনে আঙিনায় বসে বাসন মাজা, ধোয়াকাচা, ঝাড়ুপোছার কাজ করতেন। তাঁর ছোট দুই সন্তানের খালি পেটে দুটো খাবার দেওয়ার জন্য ওই সব বাসাবাড়ির যত বিয়ে, জন্মদিন, বার্ষিকী, উৎসব আয়োজনের সব বিশৃঙ্খলা আর আনন্দের ভার একাই নিজের ওপর নিয়ে নিতেন। ইদ্দতের দিনগুলোয় সদ্য বিধবা নারীরা সাধারণত একটি ঘরে মাথা ঢেকে বসে থেকে স্বামীর জন্য প্রার্থনা ও শোক পালন করেন। ইয়াসিন বুয়া সেই রীতি মেনে চলেননি।

অনেকেই নানা রকম কথা শুনিয়েছে তাঁকে।

কাদা–ছোড়াছুড়ি সত্ত্বেও, সন্তানদের কল্যাণ আর ক্ষুধার্ত পেট ইয়াসিন বুয়ার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর কঠোর পরিশ্রমের জন্য ছেলে–মেয়ে দুটো তাঁদের জীবন গড়ে নিতে পেরেছে। মেয়েটি অল্প কিছুদূর পড়াশোনা করার পর অন্য মেয়েদের কুরআন পড়িয়ে কিছু টাকা আয় করত। ইয়াসিন বুয়া এই টাকার সঙ্গে নিজের সঞ্চয় যোগ করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর অটোচালক ছেলের সঙ্গে থাকতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সামর্থ্য যখন ফুরিয়ে আসতে শুরু করল, জীর্ণ শরীরের হাড়গুলো শব্দ করতে শুরু করল আর হাতের শিরাগুলো ফুলে উঠতে শুরু করল, ইয়াসিন বুয়া তখন মানুষের বাসাবাড়ির কাজ কমিয়ে দিলেন।

ইয়াসিন বুয়া দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলেকে বিয়ে করানোর। কিন্তু এর চেয়ে বড় একটা আকাঙ্ক্ষা তার দেহ, মন, আত্মাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সারা দিন যেন আগুনের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো ঘুড়ির মতো হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

প্রতিটা পয়সা যত্ন করে জমিয়ে রাখার অভ্যাস ছিল ইয়াসিন বুয়ার। কৃপণতার জন্য নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্বেগে। যখন ছেলের বিয়ের জন্য সঞ্চিত টাকা থেকে কিছু বের করে নিজের কাফন কিনতে গেলেন, তাঁর মনে হলো যেন অন্য কারও টাকা চুরি করেছেন। অপরাধবোধে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর অস্থির লাগতে শুরু করল। টানা তিন দিন সেই টাকা শাড়ির আঁচলে শক্ত করে বেঁধে রাখলেন ইয়াসিন বুয়া।

কিন্তু মাতৃত্বের অনুভূতিও ইয়াসিন বুয়ার একান্ত নিজস্ব স্বপ্নকে হারাতে পারল না। এক অদ্ভুত জেদ তার ইচ্ছাকে দ্বিগুণ শক্তিশালী করল। আঁচলের শেষ প্রান্তে বাঁধা সেই টাকার গিঁট শক্ত করে ধরে নিয়ে দ্রুত শাজিয়ার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন তিনি।

ওখানে উৎসব চলছিল। অনেক লোক, আনন্দ-উল্লাস, আয়োজন...

কিন্তু ইয়াসিন বুয়ার জন্য কোনো আমন্ত্রণ ছিল না। কেউ এসে তাঁকে বলেনি, ‘আহ, আপনি এসেছেন!’ কেউ তাঁকে বসতে বলেনি। ‘খাবেন তো?’ বলে কেউ তাঁকে আপ্যায়ন করেনি।

ইয়াসিন বুয়া কখনোই জানতেন না, সম্মান ও মর্যাদা আসলে কী। কিন্তু তিনি অসম্মানও কখনো মেনে নেননি। যতটা সম্ভব, পরিশ্রম করেছেন। চীনামাটির বাসন, খাবারের প্লেট ধুতে ধুতে হাত প্রায়ই ক্ষয়ে আসত। বিরিয়ানির তেল তো এত সহজে ধুয়ে যায় না, তা–ই না?

সবাই খাওয়া শেষ করার পর, বাড়ির সামনের উঠানে সিমেন্টের ওপর বসে কয়েক লোকমা মুখে তুললেন ইয়াসিন বুয়া। তাঁর সব মনোযোগ শাজিয়ার দিকে।

‘ভাগ্যবতী নারী, সৌভাগ্যবতী নারী,’ ইয়াসিন বুয়া বিড়বিড় করে নিজেকে বললেন। ভাবতে লাগলেন, শাজিয়া কখন একটু ফাঁকা হবে, কখন নিজের ইচ্ছাটা প্রকাশ করবেন। সেই ভাবনায় ধৈর্য ধরে তাঁর প্রতিটি কাজ খেয়াল করতে লাগলেন।

শাজিয়ার কখন একটুখানি অবসর মিলবে? সকাল থেকে অসংখ্য আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে শুভেচ্ছা ও উপহার গ্রহণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেকে এসে শুধু শুভকামনা জানিয়েই থামেননি, তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিজের জীবনের সমস্যার কথাও তুলে ধরতে লাগলেন। হজের সময় যেন তাঁদের মঙ্গল কামনা করে দোয়া করে। ‘শাজিয়া আপা, আমার ছোট মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পাচ্ছি না। দয়া করে তার জন্য দোয়া করবেন,’ একজন অনুরোধ করল। আরেকজন বলল, ‘আমার ভাবি ক্যানসারে ভুগছেন। দয়া করে প্রার্থনা করুন যেন তিনি শিগগির সুস্থ হয়ে ওঠেন’, ‘আমার ছেলে চাকরি খুঁজে পাচ্ছে না। সে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। দয়া করে তার জন্য দোয়া করবেন’—দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। শাজিয়া হাসিমুখে উত্তর দিতে থাকেন, ‘ইনশা আল্লাহ, আমি দোয়া করব।’ যদিও তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন, কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে আনন্দের সঙ্গে সবাইকে বিদায় জানালেন। ভোজের আয়োজন মূলত দুপুরের জন্য করা হলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকজন আসতে থাকে। ওদিকে ইয়াসিন বুয়া হাঁড়িপাতিল ধুয়ে চললেন, প্লেট পরিষ্কার করলেন, বাড়ি ঝাঁট দিলেন। সবকিছু শেষ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন তাঁর পালা আসবে।

আরও পড়ুনআমি গুরুতর অন্তর্দৃষ্টির, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক — বানু মুশতাক২৪ মে ২০২৫

প্রায় রাত এগারোটার দিকে, যখন ক্লান্ত শাজিয়া অবশেষে সোফায় বসে নরম কার্পেটে পা ছড়িয়ে দিলেন, তখন লিভিং রুমের দরজার পাশে ইয়াসিন বুয়ার ছায়া দেখতে পেলেন। ইয়াসিন বুয়া উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘আইয়ু, বেচারা! কত ক্লান্ত হয়ে গেছে!’

ইয়াসিন বুয়া শাজিয়ার জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলেন। নিজের দুই হাত আঁচলে মুছে, সাবধানে পা ফেললেন, যেন ফাটল ধরা গোড়ালি আর পায়ের ময়লা দামি কার্পেটের ওপর না পড়ে।

‘কখন এলে, বুয়া?’ শাজিয়া অনিচ্ছাসহ জিজ্ঞাসা করলেন।

বুয়া মুখে আনন্দ ফুটিয়ে বললেন, ‘আমি অনেক আগেই এসেছি।’

‘ওহ, তাই? আজ সারা সন্ধ্যায় তোমাকে দেখতেই পেলাম না,’ কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন শাজিয়া, ‘খেয়েছ তো?’

বুয়া মুচকি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, খেয়েছি। আমার জীবন তো তোমার বাড়ির ভাতের ওপরই টিকে আছে। তুমি যা স্পর্শ করো, তা যেন সোনা হয়ে যায়। তোমার বাড়ি সব সময় রহমতে ভরে থাকুক।’

শাজিয়া তৃপ্তির হাসি দিলেন।

‘এত দেরি হয়ে গেছে, বুয়া। এখন কীভাবে বাড়িতে যাবে?’

এই উদ্বিগ্ন প্রশ্ন শুনে ইয়াসিন বুয়া বললেন, ‘আলতাফ বলেছে, সে আমাকে তার অটোতে করে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। সে এলেই আমি চলে যাব।’

সারা দিনই শাজিয়া দেখেছেন, ইয়াসিন বুয়া কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

তাই ধীরে ধীরে ভারী পা টেনে নিজের ঘরে গেলেন। কিছু টাকা বের করে এনে বললেন, ‘এই নাও, বুয়া, তোমার খরচের জন্য কিছু টাকা। আমরা তিন দিনের মধ্যে হজে যাচ্ছি, পঁয়তাল্লিশ দিন পর ফিরে আসব। আল্লাহ আমাদের হজ কবুল করুন। আমাদের জন্য একটু দোয়া কোরো।’

শাজিয়া ইয়াসিন বুয়ার দুই হাত নিজের দিকে টেনে নিয়ে টাকাগুলো দিলেন। ইয়াসিন বুয়া অভিভূত হয়ে গেলেন। শাজিয়াকে তাঁর মতো একজন হকির-ফকিরের সঙ্গেও এত সদয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে দেখে তাঁর চোখ ভরে উঠল। শাজিয়ার কাছ থেকে টাকাটা তিনি নিলেন না। বরং শাড়ির শেষের দু-তিনটি গিঁট খুলে কিছু ভাঙাচোরা নোট বের করলেন। শাজিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে প্রবল অনুরোধে বললেন, ‘এখানে ছয় হাজার টাকা আছে। তুমি হজে যাচ্ছ। পবিত্র জমজমের পানিতে ডুবিয়ে আমার জন্য একটা কাফন নিয়ে এসো। অন্তত সেই পবিত্র কাফনের কারণে আমি হয়তো বেহেশতে যেতে পারব।’ এক মুহূর্তের জন্য শাজিয়া বুঝতে পারলেন না, কী বলবেন। তখন এটাকে খুব একটা কঠিন কাজ মনে হয়নি। একটা কাফনই তো! একটু বেশি খরচ হলেও আমি তোমার জন্য আনতে পারব, তিনি মনে মনে ভাবলেন। হঠাৎ উদ্দীপনায় শাজিয়া দ্বিধা ছাড়াই সম্মতি জানিয়ে দিলেন।

নোটগুলো যখন ইয়াসিন বুয়ার হাত থেকে শাজিয়ার হাতে চলে গেল, তখনই শাজিয়া বুঝতে পেরে গেলেন। গরিব মানুষের পকেট থেকে আসা টাকাও ঠিক তাঁদের মতোই—ভাঙা, খণ্ডিত, ভাঁজে জটবদ্ধ; মর্মে ও রূপে ক্ষীণ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে শাজিয়া ভাবতেন, যদি গরিবদের নতুন চকচকে নোট দেওয়া হতো, তবু টাকাটা কীভাবে যেন অদ্ভুত, কুৎসিত রূপ নেয়। এবার তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন।

‘আচ্ছা, বুয়া, তুমি যাও। আবার এসো,’ শাজিয়া তৎক্ষণাৎ বুয়াকে বিদায় জানালেন।

শাজিয়া সঙ্গে সঙ্গে বসার ঘরের বাথরুমে গেলেন, টাকাটা সিঙ্কের ওপর রেখে দিলেন। বিছানায় শুয়ে পড়ার আগে জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিলেন।

শাজিয়ার মনে ছিল না, ইয়াসিন বুয়ার টাকাটা তিনি সিঙ্ক থেকে তুলেছিলেন কি না। হজ কমিটির আয়োজনে এক সকালের ফ্লাইটে উঠে মদিনায় পৌঁছে গেলেন তাঁরা। নতুন পরিবেশ, ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন এবং আট দিনের অবস্থানে বাধ্যতামূলক চল্লিশ নামাজ—এসবে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে সময় কখন কেটে গেল, শাজিয়া টেরই পেলেন না। সুবহান তাঁকে কেনাকাটা করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তো কখনো নিয়মকানুনের পরোয়া করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভাঙার জন্যই নিয়ম তৈরি হয়। তাই নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি, তা-ই করতেন। এই পরিস্থিতিও ছিল তেমনি। অন্য রকম নয়।

সুবহান নিয়তের বিষয়টি তুলে ধরেন। হজে যাওয়ার আগে তাঁদের হজ আর নামাজের জন্য নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ঠিক করা ছিল। শাজিয়াকে বলেছিলেন, ‘হজ শেষে তুমি কেনাকাটা করবে। হজের সময় কেনাকাটা করলে আমরা যে নিয়ত ঠিক করেছি, তা নষ্ট হয়ে যাবে।’ শাজিয়াকে এটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। মদিনা থেকে মক্কায় যাত্রা শাজিয়ার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে এল। এত সব নতুনের ভিড়ে শাজিয়া নিজের গ্রাম আর বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। মক্কায় কাটানো দিনগুলো ছিল এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা, যা আজীবন স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে।

ভারতের হজ কমিটি কয়েকটি ভবন ভাড়া নিয়েছিল। যাত্রীদের কিস্তিতে পরিশোধিত ভাড়ার ভিত্তিতে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। দুটি ঘরের বাসিন্দাদের একটি বাথরুম, সঙ্গে ছোট একটি রান্নাঘর ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হতো। গ্যাস সিলিন্ডার ও স্টোভ, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ও অন্যান্য সুবিধা ছিল। শাজিয়ার মায়ের বাড়ি থেকে চারজন আত্মীয় সফরসঙ্গী হওয়ায় তাঁদের জন্য একটি বড় ঘর বরাদ্দ করা হয়েছিল। যথারীতি দলের মহিলারা রান্নার কাজ দেখাশোনা করতেন।

শাজিয়াদের বেশির ভাগ সময় কেটে যেত নামাজ, দোয়া, কাবা প্রদক্ষিণ ও অন্যান্য ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে। হেরা গুহা পরিদর্শন, যেখানে নবী (সা.)-এর কাছে প্রথম ওহি নাজিল হয়েছিল এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ পরিদর্শনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করা ইত্যাদি তাঁদের সবাইকে ব্যস্ত রাখত। সৌদি সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা নামাজের পর হজযাত্রীদের কাছে বিশাল ট্রাক থেকে খাবারের প্যাকেট, জুস ও পানির বোতল বিতরণ করত। যেহেতু হজযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান ছিলেন, তাই তারা বিশ্বাস করত যে হজযাত্রীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করলে আল্লাহ খুশি হবেন। এভাবে, সবাই এমন আচরণ করত যেন আতিথেয়তাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

শাজিয়া ও তাঁর দল হজের বাকি রীতিনীতি শেষ করার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল। এক দুপুরে কাবায় নামাজ আদায় করে ফিরে আসার পর হয়তো প্রখর সূর্যের তাপে কিংবা দুপুরের খাবারের পরের আলস্যে শরীরটা ভারী হয়ে আসে। অজান্তেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন শাজিয়া। খানিকটা সময় ঘুমিয়ে জেগে উঠতেই কিছুটা সতেজ অনুভব করলেন। তখুনি দলের সবাইকে আসরের নামাজে অংশ নিতে মসজিদুল হারামে যাওয়ার জন্য রওনা দিতে হবে।

ওজু করতে বাথরুমে প্রবেশ করার সময় এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ল যা দেখে শাজিয়া থমকে দাঁড়ালেন। পাশের ঘর থেকে আসা জয়নব পানীয় জলের ডিসপেনসার থেকে পানি নিয়ে একটা দশ লিটারের বালতিতে ঢালছিলেন। শাজিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জয়নব, তুমি কী করছ?’

জয়নব চারদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে কাফন ধুতে হবে।’

‘কী বললে?’ রাগের স্রোতে শাজিয়া জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি পানীয় জল চুরি করছ! এটা কি ন্যায্য? তুমি হজে এসেও তোমার সস্তা আচরণ ছাড়তে পারছ না?’

শাজিয়া চিৎকার করতে লাগলেন। জয়নব দ্রুত বালতিটি নিয়ে নিজের ঘরে ছুটে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এদিকে শাজিয়া বুঝতে পারলেন, আসলে কী ঘটছে। সৌদি সরকার ছিল হজযাত্রীদের পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্বে। পানি কোম্পানিগুলো বিশাল প্লাস্টিকের টবে পানি আনত না। তার পরিবর্তে কাবা কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা জমজম কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে ট্যাংকারে ভরত। তারপর সেই পানি দিয়ে দুই রুমের জন্য বরাদ্দ ডিসপেনসারটি পূর্ণ করা হতো। ওই ডিসপেনসার দশ থেকে পনেরো লিটার পানি ধারণ করত। প্রতিদিন বেলা তিনটা নাগাদ আবার ভরা হতো। শাজিয়া খুব কমই এখান থেকে পানীয় জল গ্রহণ করতে পারতেন। বেশির ভাগ রাতে সুবহান নামাজ থেকে ফেরার পথে তাঁদের ব্যবহারের জন্য একটা পাঁচ লিটারের বোতল কিনে আনতেন।

শাজিয়া ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। জয়নবের দুর্বল উত্তর যেন তাঁর সারা দেহে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তাঁর বেহায়াপনা দেখে শাজিয়া হতবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, জয়নব কতগুলো কাফন চুরি করা পানীয় জলে ভিজিয়েছে? ইয়া আল্লাহ! সে কি তার পুরো পরিবারকে জমজমে ভেজানো কাফনে শুইয়ে রাখবে?

শাজিয়া এই সব ভাবছিলেন। তাঁর চিৎকার শুনে সুবহান ঘর থেকে ছুটে চলে এলেন। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন যে শাজিয়া হাসির ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছেন! একটুখানি সময়ের জন্য সন্দেহ হলো, ও কি একটু আগেই চিৎকার করছিল না? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার, শাজিয়া? তুমি এত হাসছ কেন?’

হাসতে হাসতে শাজিয়া সুবহানের কাছে পুরো ঘটনা বললেন, ‘দেখো, রি, এই সব মানুষ হজের মূল্যবোধ বুঝতেই পারে না। তারা এখানে এসে এমন ছোটখাটো ব্যাপারেও ঠকাচ্ছে।’

সুবহান একটু হাসলেন এবং বললেন, ‘আজ কি মাত্র তোমার নজরে এল? আমরা যখন এখানে এসেছি, তখন থেকেই আমি লক্ষ করছি। তবে আমি রেগে গিয়ে ঝগড়া করিনি; এ জন্যই আমি আমাদের ব্যবহারের জন্য পানি কিনতে শুরু করেছিলাম। ছেড়ে দাও, এত ছোট একটা ব্যাপারে লড়াই করার কিছু নেই।’

শাজিয়ার হঠাৎ করেই ইয়াসিন বুয়ার কাফনের কথা মনে পড়ল। তিনি বলল, ‘আরে রি, দেখো, আমাদের ইয়াসিন বুয়ার জন্য একটা কাফন কিনতে হবে। আজ সন্ধ্যার নামাজ শেষে ফেরার সময় তা করে নিই।’ প্রতিশ্রুতি মনে রেখে তাৎক্ষণিকভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিলেন শাজিয়া।

সুবহান মাথা নেড়ে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। কারণ, দেরি হয়ে যাচ্ছিল। যেমনটা তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে আল-হারাম মসজিদে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পুরুষ ও মহিলারা আলাদাভাবে জড়ো হয়েছিলেন। সবাই মসজিদের স্তম্ভের ভেতর দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে হাত ভাঁজ করে মাথা নিচু করে প্রার্থনা করছিলেন। দেরিতে পৌঁছানোর কারণে শাজিয়া ও সুবহান মসজিদের বিশাল উঠানে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। জায়গাটা দেরিতে আসা মানুষদের ভিড়ে দ্রুত ভরে যাচ্ছিল। রোদ ছিল উজ্জ্বল এবং সেই সব বৃহৎ ছাতা, যেগুলো সূর্যের আলো পড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়, ডানা প্রসারিত করে ছায়া দিচ্ছিল। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাতাগুলোর ডানা ভাঁজ হয়ে খুঁটির মতো রূপ নেয়; শাজিয়ার কাছে এই দৃশ্য সব সময় অসাধারণ মুগ্ধকর মনে হতো।

এশার নামাজের পরে শাজিয়া ও সুবহান কাবা কমপ্লেক্স থেকে ফেরার পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন। প্রধান সড়ক ও পার্শ্বসড়কে লাখো মানুষের ভিড়। সুবহান বুঝতেই পারছিলেন না, কোথায় পাওয়া যাবে এমন কোনো কাফনের কাপড়ের দোকান, যাতে শাজিয়া ইয়াসিন বুয়ার জন্য একটা কিনতে পারে। স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরেই হাঁটছিলেন তিনি। পাশাপাশি চিন্তায় ছিলেন, ভিড়ের ভেতর যদি শাজিয়া হারিয়ে যায়, তাহলে খুঁজে বের করা কত কঠিন হবে। তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, হাতে হাত ধরা বা কোমরে হাত বেঁধে হাঁটা কোনো লজ্জা বা দ্বিধা ছাড়াই। শাজিয়ার অলস ছন্দে নিজেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হতো, একটু ধীরে হাঁটতে হতো। প্রতিটি দোকানে শাজিয়র ঢুকে পড়ার আগেই সামনে ঝাঁপ দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচাই করতেন যে এই কাফন বিক্রি হয় কি না।

কিন্তু কাফন খোঁজার ফাঁকেই একটা কার্পেটের দোকানে শাজিয়ার চোখে পড়ে। দেখে শাজিয়া এতটাই মুগ্ধ হন যে মনে হচ্ছিল, ওই দোকান থেকে কোনো দিন বের হওয়ার ইচ্ছা নেই। কার্পেটের সৌন্দর্য, নকশা, রং আর মাঝখানের বুননের শিল্প তাঁকে এতটাই আকর্ষণ করেছিল যে স্বামীকে জিজ্ঞাসা না করেই নিজে থেকেই নিয়ে দর–কষাকষি শুরু করলেন শাজিয়া। এর ফলে সুবহানের কেনাকাটা বর্জনের পরিকল্পনা ধসে গেল। নিয়ত নষ্ট হয়ে যাওয়া বা উদ্দেশ্য সন্দেহের মুখোমুখি হওয়া—এসব আবেগঘন বিষয়কে বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলে যত খুশি কেনাকাটা করতে পারবে, এই প্রতিশ্রুতিতেও কোনো কাজ হলো না।

সুবহান সর্বাত্মক চেষ্টা করেও শাজিয়াকে ওই দোকান থেকে বের করে আনতে পারলেন না। সবকিছু ভুলে যেন নিজের পছন্দ করা তুর্কি কার্পেটে হারিয়ে গেছেন। একপর্যায়ে পরাজিত হয়ে সুবহান দোকানদারকে ফিসফিস করে বললেন, ‘এখানে কি কাফন পাওয়া যাবে?’ দোকানদার তৎক্ষণাৎ একটি কাফন বের করে আনলেন। প্লাস্টিকে মোড়া আর মৃতদেহের মতো ভারী।

সুবহান চেষ্টা করলেন শাজিয়ার দৃষ্টি এদিকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু শাজিয়া কার্পেটটি শক্ত করে ধরে রেখে বাঁ হাতে কাফনটা তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘কত ভারী! আমরা এটা কীভাবে নিয়ে যাব?’ কথাটি বলেই মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টিকে একদম উড়িয়ে দিয়ে আবার কার্পেটে মনোযোগ দিলেন তিনি।

অবশেষে কেনাকাটা শেষ হলো। সুবহান পকেট থেকে নোটগুলো গুনতে গুনতে বাইরে চললেন, দোকানদারের মুড়িয়ে দেওয়া কার্পেটটি কাঁধে রেখে। সেখানে কোনো অটো বা কুলি পাওয়ার আশা করা বৃথা। তাই নিজেই কার্পেটটি কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যদিও আশা করছিলেন যে কেউ তাঁকে দেখবে না। তবু পরিচিত অনেকের সামনে পড়তে লাগলেন। মধ্যপথে শাজিয়ারও খারাপ লাগছিল। কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘খুব বেশি ভারী নয় তো, রি?’ সুবহান একটা শব্দও করলেন না। এত ক্ষুব্ধ ছিলেন যে সহজেই শাজিয়াকে মারধর করে ফেলতে পারতেন। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে অভিশপ্ত কার্পেটটিকে ঘরের একটা কোণে ফেলে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্য কোনো পরিস্থিতিতে, অন্তত তিনি রেগে তাকাতে পারতেন বা হয়তো তিরস্কার করতেন। কিন্তু যেহেতু এটি হজ এবং ঘরের বাকি সবাই শাজিয়ার আত্মীয়স্বজন, তাই তিনি নিজেকে শান্ত রাখলেন।

তাঁদের হজ যাত্রা শেষ হলো। যদিও এদিক-ওদিক করা কিছু ভুলত্রুটি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তবু দুজনই সন্তুষ্ট বোধ করলেন।

আরও পড়ুনবানু মুশতাক : সাম্প্রতিক ভারতীয় সাহিত্যে মুসলিম জীবনধারার বর্ণনাকার২৩ মে ২০২৫

মিনা থেকে ফিরে আসার পর শাজিয়া বিছানায় পড়ে গেলেন। ব্যাপারটা কিছুটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রক্তচাপ অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। দুই দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হলো। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুরো এক দিন বেড রেস্ট। তারপর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করল। তবু কেনাকাটায় সময় নষ্ট হওয়ায় সুবহান বিরক্ত ছিলেন। তাঁর সামনে শাজিয়া জোর করে বলতেন, ‘আমার শরীর ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ আর দ্রুতই ভালো বোধ করছেন, এ রকম মনে হতো। সুবহান কেনাকাটা এড়ানোর নানা কৌশল ভাবলেন। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা ছিল না। কিন্তু অতিরিক্ত লাগেজ ফ্লাইটে কত ধরনের সমস্যা তৈরি করে তা দেখে, সেই ফাঁদে পড়তে চাননি। তবু শাজিয়াকে হতাশ করতে বা আবারও তার রক্তচাপ বেড়ে যাক, তা চাইতেন না। কেনাকাটা কমানোর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। শাজিয়াকে থামানোর কেউ ছিল না। কেনাকাটার ব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ ইয়াসিন বুয়ার কাফনের কথা শাজিয়ার মনে মৃদু ঝলকানির মতো আসত, আবার তা মিলিয়ে যেত। এভাবে একসময় ব্যাপারটি তিনি পুরোপুরি ভুলে যান। এই জাদুকরি স্থানে...কাফনের মতো একটা বিষণ্ন ও ভারী বোঝা যা এত জায়গা দখল করে, তা নিয়ে ভাবা ... হে আল্লাহ! ভারতে কি এটা পাওয়া যায় না? আমাদের গ্রামেও কি এটা পাওয়া যাবে না? আমি বলতে পারি, মক্কায় এ ধরনের কাফন খুঁজে পাইনি। আহ! হজ থেকে ফিরে কি আর এমন মিথ্যা কথা বলা যায়? তওবা, তওবা... বলে শাজিয়া নিজের দুগালে হালকা আঘাত করে মিথ্যাকে বিদায় জানান। শাজিয়া কখনোই ভাবেননি যে ইয়াসিন বুয়ার কাফনের আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত এতটা বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে।

ইয়াসিন বুয়ার মৃত্যুর খবর শুনে শাজিয়া ভীষণ হতভম্ব হয়ে গেলেন। ‘যদি আগে জানতাম, তাহলে আমি কথাটি ঠিকই রাখতাম,’ তিনি যন্ত্রণায় ভাবলেন, ‘যত কষ্টই হোক না কেন, আমি তা পালন করতাম।’

হজ থেকে ফিরে আসার পর, শাজিয়া এত কিছু কিনেছিলেন যে অতিরিক্ত জিনিসপত্র দলের অন্যদের ব্যাগে ভাগ করে দিতে হয়েছিল। এই বিশৃঙ্খলা সামলাতে গিয়ে সুবহান একদম ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

তারপর এল পাঁচ লিটারের জমজম পানির ক্যান, যা সবার মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কয়েক কেজি খেজুর—আর এগুলোও কি কম ভারী? শাজিয়া শুধু বোরকা পরে তাঁর হাতব্যাগটা ধরে ছোটাছুটি করেছেন। প্রতিটি ছোটখাটো ব্যাপারে স্বামীর ওপর ভরসা করেছিলেন যা সুবহানের বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

অবশেষে অনেক ঝক্কিঝামেলা সামলে তাঁরা ব্যাগগুলোসহ নিজেদের ফ্লাইটে তুলতে সফল হলেন।

এক মাস পেরিয়ে গেলেও, শাজিয়া সবার জিনিসপত্র বিতরণ শেষ করতে পারেননি। প্রথম তিন দিন অসুস্থতা ও জেট ল্যাগের কারণে তিনি বিছানা থেকেই উঠতে পারেননি।

এরপর এল আনপ্যাকিং পর্ব। কাছের স্বজনদের জন্য সোনা ও দামি উপহারগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তারপর সেই অসামান্য বিরল কার্পেট খুললেন। আনন্দে মেতে উঠলেন। সুবহানের বিরক্তি টেরও পেলেন না। সুবহান চুপচাপ হাঁটা দিলেন।

এরপর তো কাপড়, খেলনা ইত্যাদি বিতরণ করলেন যাদের জন্য এগুলো কেনা হয়েছিল।

কয়েকজন কাছের বন্ধু ও আত্মীয় জানিয়েছিলেন যে তাঁরা নির্দিষ্ট ডিজাইনের ও কসুটি কাজ করা বোরকা চান। নির্দিষ্ট রং ও কাট নির্দিষ্ট সুচিকর্মের। কেউ কেউ টাকা দিয়েছিলেন আবার কাউকে উপহার পাঠাতে হলো দায়বদ্ধতা থেকে।

শাজিয়া সবাইকে একটি করে জায়নামাজ, তসবি, একমুঠো খেজুর ও জমজমের পানির বোতল পাঠালেন।

সবকিছু শাজিয়া নিজে করেননি, তবে পুরো প্রক্রিয়া তদারক করতে হয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এভাবে এক মাসের বেশি সময় লাগল তাঁর কাজ শেষ হতে হতে।

একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, হজ থেকে আসা ব্যক্তিরা অসীম ইতিবাচক ও আধ্যাত্মিক শক্তি ধারণ করেন। এই শক্তি যাতে অপচয় না হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া-নামাজে ব্যয় হয়, এই উদ্দেশ্যে মুসলমানরা প্রায় চল্লিশ দিন বাড়িতে অবস্থান করেন। ঠিক যেন একটি শপথের মতো কঠোরভাবে নিয়মটি পালন করা হয়। শাজিয়াও এ নিয়ম মেনে চলতেন।

অভ্যাস অনুযায়ী, ইয়াসিন বুয়া কয়েকবার বাড়িতে এলেন। নীরবে এসে নীরবেই চলে যেতেন। প্রতিবার শাজিয়া হয় ঘুমাচ্ছেন বা বিশ্রামে নিচ্ছেন, নাহয় নামাজ আদায় করছেন কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। এভাবেই বার্তাগুলো পৌঁছাত ইয়াসিন বুয়ার কাছে। ভেজা চোখে বারবার ফিরে যেতেন তিনি।

ইয়াসিন বুয়া এক দিক থেকে তার কাফনটি দেখার জন্য অত্যন্ত অধীর ছিলেন। অন্যদিকে, হজফেরত শাজিয়ার হাত দুটি নিজের রুক্ষ হাতে স্পর্শ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে বিরাজ করত।

ইয়াসিন বুয়া কয়েকবার অপেক্ষা করলেন। আশা করছিলেন যে শাজিয়া হয়তো তাঁর জন্য কোনো উপহার নিয়ে এসেছেন।

অবশেষে ইয়াসিন বুয়ার দীর্ঘ বেদনাদায়ক অপেক্ষার সাক্ষী হয়ে শাজিয়া উপস্থিত হলেন। সদ্য গোসল করে আসায় তাঁর চুল অর্ধেক ভেজা। চমৎকার আকাশি-নীল চুরিদার সেট পরিহিত হয়ে। সঙ্গে মিল রেখে কসুতি সুচিকর্মযুক্ত দোপাট্টা মাথায় ঝুলিয়ে বের হলেন। ইয়াসিন বুয়া যেন খুশিতে ফেটে পড়লেন। তাঁর আনন্দের কোনো সীমা ছিল না। ছুটে এসে শাজিয়ার হাত টেনে নিয়ে নিজের চোখে ছোঁয়ালেন। যেন একজন হাজির হাত স্পর্শ করার মুহূর্তেই তিনি নিজেও আধ্যাত্মিকভাবে শুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। তাঁর বাহুগুলোয় রোমাঞ্চের কাঁপুনি জেগে উঠেছিল।

শাজিয়া ধীরে তাঁর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ছোট্ট করে বললেন, ‘কেমন আছ, বুয়া?’ তারপরই দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেলেন। একটি জায়নামাজ ও তসবি নিয়ে এসে বুয়াকে দিলেন, ‘নাও, এটা তোমার জন্য।’

কিন্তু এগুলো দেখার জন্য ইয়াসিন বুয়া অপেক্ষা করেছিলেন না। জমজমের পানিতে ভেজানো কাফনে মুড়ে আল্লাহর কাছে যাত্রার—তাঁর গভীর বাসনা পূরণের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই মুহূর্তটা। তিনি উপহারটি গ্রহণ করার জন্য হাত বাড়ালেন না। বরং শাজিয়াকে অবিশ্বাসের চোখে দেখলেন। একরাশ হতাশতায় ভোঁতা হয়ে ভেতরে কিছুটা সাহস জাগিয়ে দৃঢ় ও স্পষ্ট কণ্ঠে শাজিয়াকে বললেন, ‘আমি এগুলো চাই না; আমার কাফনটা দাও।’

কথাটি শাজিয়া প্রত্যাশা করেননি। ফলে অত্যন্ত রেগে উঠলেন। কোনো লজ্জা না করে, উচ্চস্বরে তিনি বুয়াকে তিরস্কার করলেন, ‘ছি! কেউ কি জায়নামাজ ফিরিয়ে দেয়?’ কিন্তু বুয়া এক ইঞ্চিও নড়লেন না। স্থিরভাবে নিজের অবস্থান বজায় রাখলেন।

পরে বুয়া বললেন, ‘তোমার শাশুড়ি হজ থেকে ফিরে আসার পর আমাকে যে জায়নামাজ দিয়েছিলেন, তা আমার কাছে এখনো আছে। আমি সময় পেলেই ওটাতে নামাজ পড়ি। এত নতুন সুন্দর জায়নামাজ আমি কোথায় রাখব? কয়দিনই বা বাঁচব? আর কত নামাজ পড়ব? দুনিয়া আমাকে যেতে বলছে আর ঘাসের জমিন আমাকে ডাকছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। আমি শুধু কাফন চাই।’

শাজিয়া আগে কখনোই ইয়াসিন বুয়াকে এভাবে দেখেননি। যে কিনা হাঁটার সময় শ্রদ্ধায় কোমর থেকে ঝুঁকে প্রতি মিনিটে আকাশের দিকে তাকিয়ে শাজিয়ার প্রশংসা করত, আঙুলের হাড় ফুটিয়ে দিত যাতে তাঁর সৌন্দর্যে বদনজর না লাগে, সব সময় তাঁর মঙ্গল কামনা করত—‘আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘায়ু দান করুন, সমৃদ্ধি প্রদান করুন, তোমার পরিবার সুস্থ থাকুক, তোমার বিবাহিত জীবন নিরাপদ থাকুক, আল্লাহ তোমাকে জান্নাতে প্রবালবাড়ি দান করুন,’ সেই বুয়া যে সব সময় শাজিয়াকে আশীর্বাদ বর্ষণ করত আর তাঁর জন্য দোয়া করত, সে কোথায় গেল? এই শক্ত জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বুয়া তাহলে কে?

শাজিয়া রাগে ফুঁসে উঠলেন। ভুলে গেলেন যে তিনি মাত্রই হজ থেকে ফিরেছেন। ‘কী কাফন? কোন কাফন পরে মরে যাওয়ার পর? কেউ না কেউ তোমাকে কোনো কাফনে বেঁধে দেবে। এত হইচই কেন করো? তোমার কী হয়েছে, বুয়া? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? তুমি আমাকে কত টাকা দিয়েছিলে? আমি তোমার মুখে দশ–বারো গুণ ছুড়ে মারব। দাঁড়াও এখানে, এরপর আর তোমার মুখ দেখাবে না।’ তিনি রাগে চিৎকার করতে করতে নিজের ঘরে ছুটে গেলেন। পাঁচ শ রুপির দুটো নোট হাতে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু, ইয়াসিন বুয়াকে কোথাও দেখতে পেলেন না। তাঁর মেজাজ দেখে মনে হচ্ছিল যে বুয়াকে এত সহজে যেতে দেবেন না। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকলেন। উঠানে গেলেন। কাছাকাছি গলিতে উঁকি দিলেন, কিন্তু যেদিকেই তাকান না কেন, বুয়াকে কোথাও দেখতে পেলেন না। ‘ও জাহান্নামে যাক’, এই ভেবে নোটগুলো সামনের তেপায়া টেবিলে ফেলে সোফায় শুয়ে পড়লেন। শাজিয়া যেমন চেয়েছিলেন, ইয়াসিন বুয়া আর কোনো দিন তাঁর সামনে আসেননি। এই বিদায়কে ভালো একপ্রকার মুক্তি মনে করে স্বস্তি ও তৃপ্তিতে নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু বুয়া এটা কীভাবে করতে পারে? এই প্রশ্ন মাঝেমধ্যে তাঁর মনে জাগত। স্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা রাগকে জাগিয়ে তুলত। কিন্তু বুয়া যখন মুখ দেখাবে না, তখন তিনি কীই–বা করতে পারেন! ছেড়ে দিয়ে দেখা যাক। হয়তো রমজান বা বকরির ঈদে বুয়া আবার আসবে ভিক্ষার জন্য। আশা করতেন যে বুয়া পিঠ বাঁকিয়ে নত হয়ে আসবে। হাতের এক মুষ্টির মধ্যে সেঁটে যাওয়ার মতো ছোট হয়ে রমজান মাসে আবার দেখা দেবে।

কিন্তু ইয়াসিন বুয়ার আত্মসম্মানবোধ অবহেলা করার মতো ছিল না। তিনি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন একবার তাঁর কাফনখানি দেখার জন্য। একটু ছুঁয়ে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, ঠিক যেমন কোনো বিয়ের কনে নিকাহ উপহারের অপেক্ষায় থাকে। দামি গহনা আর পোশাকে সজ্জিত হয়েও শাজিয়া তাঁর সঙ্গে নিঃস্বের মতো যে আচরণ করেছেন, তা ইয়াসিন বুয়ার হৃদয়ে একটা চিরস্থায়ী দাগ কেটে দিয়েছে।

শাজিয়া দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি যে মৃত্যুর পর ইয়াসিন বুয়া তাঁকে এভাবে তাড়া করবেন। হঠাৎ যন্ত্রণার ভারে শাজিয়া ভেঙে পড়েন। কী করা উচিত? কী করা উচিত নয়? বুয়া যদি এক লাখ টাকা দামের কাফনও চেয়ে থাকতেন, শাজিয়া তাঁকে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু মক্কার কাফন পবিত্র জমজমের জলে ভেজানো! ‘ইয়া আল্লাহ, কী করব?’ তিনি তাঁর ভুল কীভাবে সংশোধন করবেন? ‘আমি কী করব, আমি কী করব?’ চিন্তিত, উদ্বিগ্নভাবে মুঠোফোনটা ধরে তাড়াহুড়া করে ওপরে উঠে একটা খালি ঘরের কোণে আশ্রয় নেন। তাঁর শরীরের তাপমাত্রা কি বৃদ্ধি পাচ্ছে? তিনি কি কাঁপছে? অথবা কেন ঘামছেন, কিছুই জানতেন না। কী দুর্ভাগ্য! এই বেচারি মহিলা যদি কেয়ামতের দিন নিজের আঁচল ধরে আল্লাহর কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন? ‘যতই ভালো কাজ করি না কেন, আমি দোষী থাকব।’ আতঙ্কিত শাজিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে তিনি বুয়ার চেয়ে বেশি দরিদ্র, আরও বেশি দুর্ভাগ্যবান।

ওই কাফনই ছিল মৃত মহিলার শেষ ইচ্ছা। নইলে তার ছেলে কেন এটি খুঁজতে আসবে? কেন সে তার মৃত মায়ের হয়ে এটি ভিক্ষা চাইবে? সে নরম স্বরে কথা বললেও এটা স্পষ্ট যে সে মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শাজিয়া কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাবে? তাঁর মেরুদণ্ড বেয়ে একটা কাঁপুনি বয়ে গেল। যদি তিনি অন্য কোনো কাফন ব্যবহার করতে সম্মতি না দিয়ে থাকেন, তাহলে সেদিন তাঁর দাফন হবে না। জামাত তাঁর স্বামী ও ছেলেকে মসজিদে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাঁদের হাত ভাঁজ করে এবং মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভেবে শাজিয়া ভীত হয়ে পড়লেন। ফরমান অবশ্যই তাঁকে ছাড়বে না। সে তার মাকে ঠিক ততটাই নিষ্ঠুরভাবে অবজ্ঞা করতে পারে, ঠিক যতটা ভালোবাসে।

শাজিয়ার চিন্তাভাবনাগুলো এদিক থেকে অন্যদিকে উড়ে বেড়াতে লাগল ঘুড়ির মতো। তিনি বসে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর হৃৎপিণ্ড যেন আক্ষেপে, যন্ত্রণায় ফেটে পড়বে। কাঁদতে কাঁদতে দম ফুরিয়ে এল। এত কান্নার পর কি তিনি হালকা বোধ করছেন? না। তীব্র দুঃখ তাঁর গলায় আটকে আছে। এমন যন্ত্রণা যেন আল্লাহ তাঁর শত্রুদেরও না দেন। তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল।

এক-দুই ঘণ্টা একা বসে কাঁপতে কাঁপতে কান্না করার পর একটা আশার আলো জেগে উঠল শাজিয়ার মনে। নিচতলা থেকে সুবহানের গলার স্বর শোনা গেল। তিনি জোরে জোরে ডাকছিলেন। ‘শাজিয়া, শাজিয়া, আমার জামাকাপড় কোথায়? আমার কলম কোথায়? আমার নাশতা কি তৈরি?’ যদিও তাঁর কথা শুনতে পেলেন, কিন্তু শাজিয়ার গলা দিয়ে স্বর বেরোতে রাজি হলো না। কিন্তু সাবা সরাসরি উত্তর দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আব্বাজি, আম্মি বাড়িতে নেই। খুব ভোরে খবর এল যে কেউ মারা গেছে। সে নিশ্চয়ই সেখানে গেছে।’

‘কী? কে মারা গেছে? তোমাকে কে বলেছে?’ সুবহান জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ফরমান আমাকে বলেছে। চা–নাশতা না করেই বেরিয়ে গেছে। আম্মিও নিশ্চয়ই তার সঙ্গেই গেছে,’ সাবা মতামত দিল।

শাজিয়া স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাবা যতই ভয়ংকর হোক না কেন, পুত্রবধূ হওয়ার কারণে, চরিত্রের সঙ্গে আসা সব ধূর্ততা ছিল তার। এরপর শাজিয়া তার জন্য কিছুটা মমতা অনুভব করলেন। সাবা খাবার টেবিলে চীনামাটির বাসনে সুবহানের জন্য রুটি আর পাল্যা সাজিয়ে রাখছিল। রাঁধুনির তৈরি সকালের খাবার পরিবেশন করছিল। কিছুক্ষণ পর, শাজিয়া শুনতে পেল যে সুবহানের গাড়ি প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রাঙ্গণের দেয়াল ছাড়িয়ে ওপারে চলে গেছে। আর কান্না করে লাভ নেই। এখন তাঁর মনে হলো, কিছু একটা করার চেষ্টা করা দরকার।

অন্য কারও মৃত্যুতে শাজিয়া এত কাঁদেননি। এমনকি নিজের বাবার মৃত্যুতেও এত অশ্রু ঝরাননি। কারণ, ওই সময় তাঁর চারপাশে ছিল অসংখ্য মানুষ। যারা তাঁকে পানীয় দিত, গোলাপজলে মাখানো তুলা দিয়ে অশ্রু মুছত, পিঠে হাত বুলিয়ে আরাম দিত, বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে সান্ত্বনা দিত। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়রা একে অপরের পাশে ছুটে এসে সাহায্য করত। চারপাশে এসব ঘিরে থাকায় তাঁর দুঃখ অনেকটাই সহ্য হতো।

কিন্তু এখন, পুরো বাড়ির একটা কোণে একা, যেন এক নির্যাতিত অনাথের মতো লুকিয়ে থাকা এই অবস্থা তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন। এখন তাঁকে অবশ্যই এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। এটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, তিনি দ্রুত তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের ফোন করতে শুরু করলেন:

‘আমি জমজমের পানিতে ভেজানো কাফন খুঁজছি—’

তাঁর প্রশ্নই শেষ হওয়ার আগেই উত্তর এল, ‘হুম... এটা কি শাজিয়া? না, আমাদের বাড়িতে কোনো কাফন নেই। আমাদের মা হজে গেলে একটা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেটা যে অনুরোধ করেছিল, তাকে দিয়েছি।’

আরেকজন বলল, ‘কী, তুমি কাফন চাও?’ হাসির ধ্বনি উঠল, ‘আমরা আমাদের বাড়িতে কাফন রাখি না। কাউকে কাফন এনে দেওয়ার অঙ্গীকারও করি না। এটা খুবই বিরক্তিকর কাজ।’

তীব্র হাস্যকৌতুকের ভেতর আরেকজন বলল, ‘ওখানকার কাফনের কী দরকার? এখানকার কাফনে কী হবে? আমাদের কর্মফল অনুসারেই আমাদের পরকাল নির্ধারিত হয়, তা–ই না?’

সবার কাছ থেকে ‘না’ শোনার পর, শাজিয়া সাবার মাকে ফোন করলেন, যদিও তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না। ‘হ্যালো... হ্যালো...’ কুশলাদির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর, শাজিয়া তাঁর মর্যাদা ও আত্মসম্মান একপাশে রেখে সরাসরি মূল বিষয়টি তুলে ধরলেন, ‘আপনার কাছে কি মক্কা থেকে আনা কোনো কাফন আছে?’

সাবার মা শাজিয়াকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। সাবার নিয়মিত পাঠানো তথ্য অনুযায়ী শাজিয়া ছিলেন একজন বিড়বিড়কারী রাক্ষস। একজন নিষ্ঠুর মহিলা যে তাঁর পুত্রবধূর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। একজন ডাইনির মতো তাকে অনেক বেশি দুঃখ দিতেন। সাবার সুখ–শান্তির পথে একটি অজগর। এই সবকিছুর পরও, সাবার মা যেকোনো মূল্যে কাফনের ব্যবস্থা কর দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। যদি তা শাজিয়ার জন্যই হয়, তবু। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কী কাফন চান?’ তারপর কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেলেন যাতে গুরুত্বটা আরও স্পষ্ট হয়। ‘কিন্তু আপনি এটা কেন চান?’ জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠ স্পষ্ট ছিল। শাজিয়া কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলেন। তাঁর নিজের মাতৃগৃহ থেকে শুরু করে, কাফনের জন্য অনুরোধটি সব আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি কখনো কল্পনাও করেননি যে এতটা অসহায় হয়ে পড়বেন। আবারও কান্নার বন্যা বয়ে আসবে।

কান্না করে লাভ নেই বুঝতে পেরে শাজিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিছু একটা খেয়ে ওষুধ গ্রহণ করবেন। কিন্তু এসবেও তাঁর অবস্থা কিছুই ঠিক হলো না। পরাজিত বোধ করে তিনি ভাবতে লাগলেন, যদি স্থানীয়ভাবে একটি কাফন এনে, বাড়িতে সংরক্ষিত জমজমের পানিতে ভিজিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিই, তাতে কি কাজ চলবে? কিন্তু সেটা তো মক্কার কাফন হবে না। নিজেকে আবার সেই অতল গহ্বরে পড়তে দেখে তিনি বিরক্ত–অসহায়ভাবে অভিশাপ দিলেন, ‘ওহ, থু! শাজিয়া, তোমার জীবন অভিশপ্ত হোক।’ সেই মুহূর্তের যন্ত্রণা, বেদনা, মর্যাদা হারানো, অসহায়ত্ব আর কষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না।

বেলা তিনটার দিকে ফরমান বাড়িতে ফিরে এল। খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে সাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আম্মি কোথায়?’ সাবা অনুমান করেছিল, তার শাশুড়ি খুব খারাপ মেজাজে আছেন। তাই কোনো উত্তর না দিয়ে শাজিয়ার ঘরের দিকে চোখ তুলে ইশারা করল। ফরমান ছুটে ভেতরে ঢুকল এবং তার মা কথা না বলার পরও মুখ দেখেই সবকিছু বুঝতে পারল। পাশে বসে হাত ধরে বলল, ‘আম্মি।’

শাজিয়া যেন কান্নার জন্য একটা সান্ত্বনার কাঁধ পেলেন। যতই ফরমান তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করুক, শাজিয়া ক্রমাগত হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকলেন।

সাবা আশ্চর্য হয়ে ভাবল, ‘আমার শাশুড়ি কি এতই সংবেদনশীল, একজন কর্মচারীর মৃত্যুর শোকে এত কষ্ট পাচ্ছেন?’ সাবা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ফরমান ইশারায় তার স্ত্রীকে বিদায় জানাল।

সকালে শাজিয়ার ওপর ফরমান বিরক্ত ছিল। ‘ওনার এই ব্যাপারে রাজি হওয়া উচিত ছিল না...কিন্তু রাজি হওয়ার পর, প্রতিশ্রুতি কি রক্ষা করা উচিত ছিল না? একটা কাফন আনা কী এমন বড় ব্যাপার? সেটাও ওই গরিব বেচারির জন্য।’ তার খুব খারাপ লেগছিল। ‘গত বছর যখন সাবা আর আমি ওমরাহ করতে গিয়েছিলাম, তখন আম্মি কি আমাদেরও এটা আনতে বলতে পারত না? আমিও তো নিয়ে আসতে পারতাম।’ কাফন আনা কেন এত সমস্যা হয়ে উঠল? এই ভেবে সে তার মাকে দোষারোপ করা শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত হয়। তার কতটা কষ্ট হচ্ছে ভেবে দুঃখিত হয়ে বলে, ‘আম্মি, বাদ দাও, মাঝেমধ্যে এসব ঘটে। ভুলে যাওয়ার কারণে হোক বা দুর্ভাগ্যের কারণে, এসব ঘটেই যায়। এটাকে মনে রেখো না। আর আম্মি, সকালে আমি আলতাফের সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম, বুয়ার দাফনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এসেছি। আমি একটা কাফন, আগরবাতি, আতর আর অন্যান্য জিনিসপত্র সব কিনেছি, যা যা প্রয়োজন ছিল। তারপর কবরস্থানে আলতাফের পছন্দের জায়গায় কবর খনন করে, মৃতদেহকে গোসল করানোর ব্যবস্থা করেছি। আমি ভেবেছি, দুপুরের খাবার খাওয়ার পর তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। আমি জানি, না হলে তুমি শান্তিতে থাকবে না। আমার সঙ্গে দুপুরের খাবার খাও। তারপর আমরা শেষবারের মতো ইয়াসিন বুয়াকে দেখতে যাব।’

শাজিয়ার দুঃখ আবার বেড়ে গেল। ফরমান তার সামনে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিল। শাজিয়ার পেটে খানিকটা ভাত যাওয়ার পর, ফরমান সাবাকে বলল, ‘তোমাকে আসতে হবে না, আম্মি এলেই যথেষ্ট।’ তারপর মাকে ইয়াসিন বুয়ার বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে যা ঘটতে চলেছে, তা সে আগেই কল্পনা করে রেখেছিল। ইয়াসিন বুয়ার মুখ দেখার পর তিনি আবার কান্নায় ভেঙে পড়বেন। সম্ভবত ইয়াসিন বুয়ার পুত্র–কন্যার মতোই শাজিয়াও একই পরিমাণ অশ্রু ঝরিয়েছেন। কিন্তু তবু তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে রাজি হবেন না। ফরমান বুঝতে পারল, শাজিয়া তাঁর শোক প্রকাশ করা চালিয়ে যাবেন।

তারা যখন ইয়াসিন বুয়ার বাড়িতে পৌঁছাল, তখন সবকিছু ঠিক তেমনই ঘটল, যেমনটি ফরমান আগেই ভেবেছিল। শাজিয়ার দুঃখের কোনো শেষ ছিল না। যেন তাঁর অশ্রু শুকানোর কোনো কারণও ছিল না। যারা তার মুখ দেখেছিল, লালচে চোখ, ফুলে ওঠা ঠোঁট দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। অনেকেই সহানুভূতি প্রকাশ করল। এত বড় ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন মহিলাকে এক ভৃত্যের মৃত্যুতে এমনভাবে শোকাহত হতে তারা আগে কখনো দেখেনি। আল্লাহর ওপর সবকিছু জানার ভার ছেড়ে দেওয়ার আগে তারা ভাবল, ‘কে জানে এই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল!’ সত্য শুধু আল্লাহ জানেন। আর জানতেন একমাত্র শাজিয়া। এখানে ইয়াসিন বুয়ার অন্তিম অনুষ্ঠান হচ্ছে না, বরং তাঁর নিজেরও অন্তিম অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ