বিশ্ব অর্থনীতি অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের মূল কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্কনীতি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথ এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ পরিস্থিতিকে ‘জমাট কুয়াশার মধ্যে পথচলা’ বলে অভিহিত করেছেন।

গীতার মতে, বর্তমান পরিস্থিতি মহামারি–পরবর্তী পুনরুদ্ধারের চেয়ে জটিল ও বিপজ্জনক। কোভিড-১৯ সংকটকালে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সমন্বিতভাবে সুদের হার কমানো এবং আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন বাণিজ্যযুদ্ধের হুমকিতে তেমন কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ সম্ভব হচ্ছে না। খবর রয়টার্স।

গীতা বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে একতরফা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে নীতিনির্ধারণ করা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। তাদের পরিস্থিতি বেশ গুরুতর। গীতার ভাষায়, শুধু সুদের হার কমিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদায় গতি আনার সুযোগ তাদের নেই। কারণ, মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে উচ্চ সুদের হার ধরে রাখতে হচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার তুলনামূলকভাবে উচ্চপর্যায়েই রেখেছে। ফলে অনেক দেশই সুদ না কমাতে কিংবা উল্টো বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।

ফলে একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও চাহিদা সংকট—দুই বিপরীতমুখী চাপের মধ্যে পড়ে গেছে অর্থনীতি। যার প্রভাব শুধু বাজার নয়, বৃহত্তর সমাজ ও কর্মসংস্থানের ওপরও পড়ছে বলে মন্তব্য করেন গীতা গোপীনাথ।

ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা পদক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কঠিন হয়ে উঠছে। চীনের মতো দেশ ইতিমধ্যে পাল্টা শুল্ক বসিয়েছে মার্কিন পণ্যে। ভারতও রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা নিয়ে চাপে রয়েছে। এই দ্বিপক্ষীয় চাপ ও উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।

বিশ্ব অর্থনীতির এই জটিল মুহূর্তে গীতা গোপীনাথ মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে প্রতিনিয়ত নীতিগত রূপরেখা পাল্টাতে হচ্ছে। একদিকে ঘরোয়া চাহিদা, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা—উভয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও দুরূহ হয়ে উঠছে।

একই আশঙ্কার সুর শোনা গেছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ফলে এসব দেশের প্রবৃদ্ধিতে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের খরচ এখনো সাম্প্রতিক অতীতের সর্বোচ্চ স্তরের কাছাকাছি। ফলে উচ্চ শুল্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা কমে যাওয়ার ধাক্কা সরাসরি উদীয়মান অর্থনীতির গায়ে লাগছে—এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক ন্যাটিক্সিসের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ আলিশিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলেন, সাধারণভাবে ডলারের মান কমলে উদীয়মান দেশগুলোর রপ্তানি আয় কমে যায়; ঋণ সংগ্রহের খরচও কমে যায়। কিন্তু এখন হচ্ছে উল্টোটা, রপ্তানি কমছে আবার ঋণের খরচ কমছে না; সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ডের সুদ এখনো অনেক বেশি।

গীতা গোপীনাথ বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির সহনশীলতা বা স্থিতি এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ব্যাংকের বাইরের আর্থিক প্রবাহের ওপর। তার ওপর নতুন করে ক্রিপ্টোমুদ্রার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

সব মিলিয়ে গীতা গোপীনাথের সতর্কবার্তা কেবল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নয়, বরং ভবিষ্যৎ ঝুঁকির বাস্তবভিত্তিক পূর্বাভাস বলেই ধারণা করা হচ্ছে। শিগগিরই শুল্ক–যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে আইএমএফ

ব্যাংকিং খাতে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে, প্রকৃত খেলাপির চিত্র প্রকাশ করায় তা ইতিবাচক ভাবে দেখছে সংস্থাটি।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যংকে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধি দল খেলাপি ঋণসহ নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। 

আরো পড়ুন:

১১ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৮৮০ অফিসার নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক

বিদ্যুৎ আমদানির অর্থ পরিশোধে নিয়ম সহজ করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আইএমএফের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক (গ্রেড–১) ড. এজাজুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, আইএমএফের পঞ্চম রিভিউ মিশন নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবে তথ্য নিচ্ছে। তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপ, সুদের হার নির্ধারণ, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের অগ্রগতি সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছে।

বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দল রিজার্ভ থেকে ইডিএফ গঠনসহ ব্যবহারের ধরন, বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন ও প্রাক–অর্থায়ন সুবিধা এবং এসব তহবিলের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। কেন্দ্রীয় ব‌্যাংক এ সম্পর্কে আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে বিস্তারিত জানায়।

বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দল মুদ্রানীতির কাঠামো, মূল্যস্ফীতি, সুদের হার, তারল্য সহায়তা, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণ কমাতে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেয়। তারা মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এছাড়া, ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ও তা কমানোর পদক্ষেপসহ জলবায়ু ও টেকসই বিনিয়োগ এবং সবুজ অর্থায়ন বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল।  

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা। তবে, গত বছরের আগস্টে সরকারের পরিবর্তনের পর গোপন করে রাখা বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, মাত্র এক বছরে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বেড়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায়। 

ঢাকা/নাজমুল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে আইএমএফ