ইমান মানুষের হৃদয়ের সেই আলো, যা তাকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে, যা সুস্থ থাকলে পুরো শরীর সুস্থ থাকে, আর যা নষ্ট হলে পুরো শরীর নষ্ট হয়। সেটি হলো হৃদয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২)
ইমানের শক্তি হৃদয়ের পবিত্রতা ও সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। তাই ইমানকে শক্তিশালী করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। আমরা এখানে ইমান বৃদ্ধির ১০ গুরুত্বপূর্ণ উপায় উল্লেখ করেছি।
১.
আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের জ্ঞান অর্জন
আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ (আসমাউল হুসনা) জানা এবং তা বোঝা ইমানের মূল ভিত্তি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, যে তা সংরক্ষণ করবে, তাদের অর্থ বুঝবে, বিশ্বাস করবে এবং তা দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৭৩৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে, যা সুস্থ থাকলে পুরো শরীর সুস্থ থাকে, আর যা নষ্ট হলে পুরো শরীর নষ্ট হয়। সেটি হলো হৃদয়।’সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২আল্লাহর নাম ও গুণাবলির গভীর জ্ঞান মানুষের হৃদয়ে ইমানের শিকড় গভীর করে এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করে। এই জ্ঞান হৃদয়ে প্রশান্তি এনে ইমানকে অটুট রাখে।
আরও পড়ুনইমান কাকে বলে১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫২. কোরআনের আয়াত নিয়ে গভীরভাবে ভাবা
কোরআন আল্লাহর কালাম, যা হৃদয়ের খোরাক এবং আত্মার প্রশান্তি। কোরআনের আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা ইমানকে শক্তিশালী করে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাঁর আয়াতসমূহ তাদের সামনে তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ইমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২)
কোরআনের শিক্ষা, উপদেশ ও গল্প মনের সন্দেহ ও প্ররোচনা দূর করে। এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র—ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—জন্য পথনির্দেশ প্রদান করে। নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত ও তা বোঝার চেষ্টা ইমানের আলো উজ্জ্বল করে।
৩. মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত জানা
রাসুল (সা.)-এর জীবনী ও তাঁর উত্তম গুণাবলি সম্পর্কে জানাশোনা ইমানের শক্তি বাড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি তাদের রাসুলকে চেনেনি, তাই তারা তাঁকে অস্বীকার করছে?’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত: ৬৯)
তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কালাম, আয়াত: ৪)
মহানবী (সা.)-এর সত্যবাদিতা, ধৈর্য, দয়া ও উত্তম আচরণ জানলে তাঁর প্রতি ভালোবাসা বাড়ে, যা ইমানের ভিত্তি। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আমাদের জীবনে ইমানের প্রকাশ ঘটায় এবং তাঁকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণের প্রেরণা জোগায়।
নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত ও তা বোঝার চেষ্টা ইমানের আলো উজ্জ্বল করে।আরও পড়ুনআল্লাহর ভয়ে কাতর থাকা ০৭ মার্চ ২০২৪৪. সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা
মহাবিশ্বের সৃষ্টি, আকাশ-পৃথিবী, মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে চিন্তাভাবনা ইমান শক্তিশালী করে। এই সৃষ্টির সৌন্দর্য, নিখুঁত বিন্যাস ও অপার উপকারিতা আল্লাহর কুদরত, জ্ঞান ও রহমতের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০)
প্রকৃতি আল্লাহর মহিমা উপলব্ধি করতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
৫. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির ও দোয়া করা
জিকির ও দোয়া ইমানের প্রাণ। আল্লাহর জিকির হৃদয়ে ইমানের বৃক্ষ রোপণ করে এবং তা বৃদ্ধি করে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ইমান এনেছে, তাদের হৃদয় আল্লাহর জিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই হৃদয় প্রশান্তি পায়।’ (সুরা রা’দ, আয়াত: ২৮)
জিকির হৃদয়কে আল্লাহর নুরে জীবন্ত করে। শরীর ও মনকে শক্তি দেয়। রাসুল (সা.) হজরত ফাতিমা ও আলী (রা.)-কে রাতে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়তে বলেছিলেন, যা তাদের দৈনন্দিন কাজে শক্তি জোগায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭২৭)
যখন তাঁর আয়াতসমূহ তাদের সামনে তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ইমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে।সুরা আনফাল, আয়াত: ২আরও পড়ুনমরিয়ম (আ.)-এর অলৌকিক ঘটনা০৯ মে ২০২৫৬. ইসলামের সৌন্দর্য জানা
ইসলামের আকিদা, নৈতিক বিধি ও আদেশ-নিষেধের সৌন্দর্য জানা ইমানকে শক্তিশালী করে। বিশুদ্ধ আকিদা হৃদয়কে সত্যের পথে রাখে, এর উত্তম নৈতিকতা জীবনকে সৌন্দর্যময় করে এবং এর ন্যায়বিচারপূর্ণ আইন জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদের জন্য ইমানকে প্রিয় করেছেন এবং তা তোমাদের হৃদয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ৭)
জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.) নাজাশির দরবারে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরে কুরাইশদের অন্ধকার জীবনের বিপরীতে ইসলামের আলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ইসলামের এই সৌন্দর্য হৃদয়ে ইমানের মাধুরী ছড়ায়।
৭. ‘ইহসান’ অর্জন
ইহসান হলো এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, যেন তিনি আমাদের দেখছেন। এটি ইমানের শ্রেষ্ঠ স্তর। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইহসান হলো তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ, আর যদি তুমি তাঁকে না দেখো, তিনি তোমাকে দেখছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)।
ইহসানের মাধ্যমে ইবাদত ও মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে নিখুঁততা আসে। মানুষের প্রতি দয়া, সহানুভূতি ও সাহায্য ইমানের প্রকাশ। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচার, ইহসান এবং আত্মীয়দের প্রতি দান করার নির্দেশ দেন।’ (সুরা নাহল, ১৬: ৯০)
৮. আল্লাহর পথে দাওয়াত
আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া এবং সত্যের পথে পরস্পরকে উৎসাহিত করা ইমানের শক্তি বাড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘তার চেয়ে উত্তম কথা কার, যে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, ‘আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’?’ (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৩)
আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া) ইমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দাওয়াতের কাজে প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে সত্য প্রচার করতে হয়, ফলে এটি দাঈর নিজের ইমানকে শক্তিশালী করে।
আরও পড়ুনপ্রাঞ্জল বাংলা অনুবাদে কোরআন১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইহসানের মাধ্যমে ইবাদত ও মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে নিখুঁততা আসে। মানুষের প্রতি দয়া, সহানুভূতি ও সাহায্য ইমানের প্রকাশ।৯. ইমানের বিপরীত বিষয়গুলো প্রতিরোধ করা
ইমানের শক্তি বাড়াতে কুফর, পাপাচার ও অবাধ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাপ থেকে দূরে থাকা, তাওবা করা এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে হারাম থেকে রক্ষা করা ইমানের জন্য অপরিহার্য।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কেউ কি চায় যে, তার খেজুর ও আঙুরের বাগান থাকবে, তার নিচে নদী প্রবাহিত হবে, তাতে সব ধরনের ফল থাকবে, কিন্তু তাকে বার্ধক্য গ্রাস করবে, তার দুর্বল সন্তান থাকবে, আর তখন আগুনের ঝড় এসে তা পুড়িয়ে দেবে?’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৬)
এই উপমা দিয়ে আল্লাহ সতর্ক করেন, শয়তানি প্ররোচনা ও পাপ ইমানকে ধ্বংস করতে পারে। তাই ইমানের শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা জরুরি।
১০. দুনিয়ার স্বরূপ জানা
দুনিয়ার স্বরূপ জানা ইমানকে শক্তিশালী করে। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী এবং এর সুখ-সম্ভোগ তুচ্ছ। আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত যেন আকাশ থেকে বর্ষিত পানি, যা দিয়ে পৃথিবীর গাছপালা মিশ্রিত হয়, যা মানুষ ও পশু খায়।
অবশেষে যখন পৃথিবী তার শোভা গ্রহণ করে এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, তখন তার অধিবাসীরা মনে করে তারা এর ওপর ক্ষমতাবান। তখন আমার আদেশ রাতে বা দিনে আসে, আর আমি তা শস্য কাটা মাঠে পরিণত করি, যেন গতকাল এর কিছুই ছিল না।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ২৪)
দুনিয়াকে আখিরাতের পথ হিসেবে দেখলে ইমান শক্তিশালী হয় এবং আখিরাতের প্রতি মনোযোগ বাড়ে।
ইমান হলো মুমিনের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ইমানের পথে অবিচল থাকলে মুমিন দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য লাভ করবে।
সূত্র: আল-জাজিরা ডটনেট। অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনযে ১০ কারণে ইমান নষ্ট হয়ে যায়১৮ আগস্ট ২০২৩উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার
এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।
আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২.
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।
আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৩.
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।
বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র