ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণ প্রবেশ না করতে দেওয়ার প্রতিবাদে উপত্যকাটির দিকে রওনা দিয়েছেন অন্তত ১ হাজার ৫০০ মানুষ। তাঁদের মধ্যে অধিকারকর্মী ও ফিলিস্তিনের সমর্থকেরা রয়েছেন। গত মঙ্গলবার লিবিয়ার জাবিয়া শহরে পৌঁছান তাঁরা। সেখান থেকে তাঁদের মিসরের রাজধানী কায়রোয় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

ইসরায়েলের আগ্রাসনবিরোধী এই বিপুলসংখ্যক মানুষ যাত্রা শুরু করেন আলজেরিয়া থেকে। এরপর তিউনিসিয়া হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান তাঁরা। এরই মধ্যে তাঁরা মিসর সীমান্তের সালোম ক্রসিংয়ে পৌঁছাতে গাড়ি ও বাসে করে লিবিয়ার ত্রিপোলি, মিসরাতা ও সিরাত ও বেনগাজি শহর পাড়ি দিয়েছেন। এই মানুষগুলোর লক্ষ্য কায়রো থেকে গাজা সীমান্তের রাফা ক্রসিংয়ে পৌঁছানো।

১ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার বাসিন্দা রয়েছেন। লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আরও অনেকে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যাত্রায় অংশ নেওয়া আলজেরিয়ার বাসিন্দা জামিলা শারিতাহ বলেন, এই যাত্রায় তিউনিসিয়া ও লিবিয়া সহযোগিতা করছে। জায়েদ আল–হামামি নামের আরেকজন বলেন, গাজায় খাবার প্রবেশের জন্য রাফা ক্রসিং খুলে দিতে চাপ দেবেন তাঁরা।

এদিকে যাত্রায় যোগ দিতে ইচ্ছুক দুই শতাধিক অধিকারকর্মীকে কায়রো থেকে আটক করা হয়েছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন যাত্রার আয়োজকেরা। আয়োজকদের মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক এএফপিকে বলেন, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, স্পেন, মরক্কো ও আলজেরিয়ার নাগরিকেরা রয়েছেন। বিমানবন্দর ও হোটেল থেকে তাঁদের আটক করা হয়েছে।

এর আগে বুধবার আয়োজকেরা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আজ শুক্রবার গাজা অভিমুখে মূল যাত্রাটি শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এতে অংশ নেওয়ার জন্য ৪০টির বেশি দেশের প্রায় চার হাজার মানুষ কায়রোগামী বিভিন্ন উড়োজাহাজের টিকিট কেটেছেন। যাত্রা শুরুর পর তাঁরা গাড়িতে করে মিসরের সিনাই উপদ্বীপের আল–আরিশ শহরে পৌঁছাবেন। সেখান থেকে ৫০ কিলোমিটার হেঁটে রাফা ক্রসিংয়ে যাবেন। ১৯ জুন ফিরে আসার আগপর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবেন তাঁরা।

এই যাত্রায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ‘জিহাদি বিক্ষোভকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছে ইসরায়েল। তাঁদের সীমান্তে পৌঁছানো ঠেকাতে মিসরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, সীমান্তে এই ব্যক্তিদের অবস্থান ইসরায়েলি সেনাদের নিরাপত্তা বিপদের মধ্যে ফেলবে। এমন কোনো কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেওয়া হবে না।

ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে হামলায় নিহত ৪০

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গাজায় খুবই সীমিত পরিমাণে ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এতে সেখানে খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বুধবার একমুঠো খাবারের আশায় গাজার দুটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

দুটি ত্রাণকেন্দ্রই পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)। গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ ‘সিভিল ডিফেন্সের’ বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, বুধবার মধ্য গাজার ‘নেতজারিম করিডর’ এলাকায় একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ৩১ জন নিহত ও প্রায় ২০০ আহত হন।

এ ছাড়া গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফা এলাকায় ত্রাণকেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে আল–জাজিরা জানিয়েছে। গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করে এক বিবৃতি দিয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, নেতজারিম করিডর এলাকায় রাতে সেনারা ‘সতর্কতামূলক গুলি’ চালিয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আলজ র য় ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল

যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে। 

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে। 

প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়। 

আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫

দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ। 

জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন? 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন। 

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের ওপরই ভরসা ট্রাম্পের
  • চীনে জন্মহার বাড়াতে বাবা-মাকে ১৫০০ ডলার দেওয়া হবে
  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল