শান্তা কবীর একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন উদ্যোক্তা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল একজন মানুষ। একজন নারীর পরিচয়ের গণ্ডিতে তিনি কখনও নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি; বরং একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। একমুঠো উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব বলে দাবি করা যে মানুষটি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি যে সম্প্রতি ছেলে বিয়ে দিয়ে শাশুড়ি হয়েছেন এটি ভাবলেই অবাক লাগে। জানালেন, গত ২০ বছরে তিল তিল করে ‘আজুরা বাই শান্তা কবীর’ গড়ে তোলার পেছনে যে মানুষটা সবসময় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে গেছেন, তিনি তাঁর জীবনসঙ্গী। তিনি বলেন, ‘একজন বেগম রোকেয়া তৈরি হওয়ার পেছনে যেমন একজন সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন, তেমনি আমার আজকের আমি হয়ে ওঠার পেছনে একজন কবীরের অনেক বড় অবদান।’ মিরপুর-১২ নম্বরে একটি দারুণ আউটলেট আছে শান্তা কবীরের। তিনি জানান, বহুবার তাঁর এ ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রতিবারই তিনি তাঁর জীবনসঙ্গীর অনুপ্রেরণা আর নিজ পরিশ্রম ও চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মাত্র এক হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা ব্যবসা আজ কোটি টাকার বেশি।
শান্তা কবীর বলেন, ‘এত সহজ নয় নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করানো– শুধু পরিবারের সহযোগিতা বা জীবনসঙ্গীর আবেগীয় দক্ষতার সাপোর্ট ছাড়াও যা লাগে সেটি হলো নিজের পরিশ্রম, সততা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা।’
দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা শুনে কিছুটা অবাকই লাগল। তিনি তা বুঝতে পেরে বলেন, ‘আমার দেশ আমার মা, আমার দেশের জল-হাওয়া আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেশ আমার শিকড়। দেশ যদি না বাঁচে, দেশের পণ্য যদি না বাঁচে তবে আমি কি বাঁচতে পারব? আর দেশ তো আমার প্রকৃতির বাইরে নয়।’ জানালেন, এ কারণেই তিনি পরিবেশবান্ধব ন্যাচারাল ডাই, হ্যান্ডলুম তাঁতের কাপড়, প্রাকৃতিক রঙের টাইডাই, কলাগাছের তৈরি সুতার কাপড়– এসব নিয়ে কাজ করছেন।
খাবারকে শান্তা কবীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ ভাবেন। সেই সঙ্গে তাঁর কারখানায় কাজ করা প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। কিন্তু আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে কঠোর পরিশ্রমের গল্প, বারবার ঠকেও তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যখন করছিলেন এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম– কী করে সুস্থ থেকেছেন? শুধু তো শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানালেন, নিয়মিত মেডিটেশন আর ইয়োগা করেন। নিজের শরীর, মন, আত্মাকে তিনি এক সূত্রে গেঁথে নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতে পারেন। আরেকটি কাজ তিনি করেন, সেটি হলো দক্ষতা, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগান নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে, যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষেত্রে আরও দক্ষ ও যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন। তিনি একা চলায় বিশ্বাস করেন না; বরং আরও শত শত উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে চান।
এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘বহু বহুদিন এমন হয়েছে আমি চিৎকার করেছি, রাগ হয়েছে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছি, যেখানে কবীর কিছুই হয়তো জানে না। কিন্তু সে সারাদিন অফিস শেষে আমার সেই ক্ষোভ আর কষ্টের কথা ধৈর্য ধরে শুনেছে, আমি সঠিক না বেঠিক তা না দেখে আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছে। সে আমাকে তৈরি হওয়ার পথে একজন স্বামী নয়; বরং একজন বন্ধু হিসেবে অটল, অনড় থেকেছে।’
একজন উদ্যোক্তার মূলধন কী? এমন প্রশ্নের জবাবে শান্তা কবীর বলেন, ‘টাকা নয়, সময়। আপনার হাতে ২৪ ঘণ্টা সময় থাকে আর এ ২৪ ঘণ্টাকে যদি ভাগ করেন শক্তি আর বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে, তবে আপনার জয় নিশ্চিত। টাকা তো চলে যাবে; কিন্তু মেধা, দক্ষতা সঙ্গেই থাকবে। তাই সময়কে ব্যবহার করতে হবে নিজের সুস্থতা আর দক্ষতা বাড়াতে।’
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তাঁর পরামর্শ– ‘তাদের অবশ্যই দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশি পণ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা এবং সাহস থাকতে হবে আর অবশ্যই নিজের সময়কে খুব হিসাব করে খরচ করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা একজন শিল্পী। তাঁকে এই শিল্পচর্চাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে। আরেকটি গুণ তাঁকে শিখতে হবে– টাকা দিয়ে কীভাবে টাকা তৈরি করতে হয়, সেই কৌশলটি শেখা জরুরি।’
বর্তমানে শান্তা কবীর যুক্ত আছেন ‘পাওয়ার অব শি’ নামক একটি অনলাইন উদ্যোক্তাদের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে। সেখানে আরও নারী উদ্যোক্তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার পাশাপাশি সংগঠনটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছেন। তাঁর পোশাক দেশ ছাড়িয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশের মাটিতে। চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, আরব আমিরাত, ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশে পৌঁছে গেছে তাঁর সিগনেচার পোশাক ‘আজুরা বাই শান্তা কবীর’। তাঁর স্বপ্ন– বিদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে একদিন বাংলাদেশের কাপড় নিজ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কোনো দরিদ্র দেশ হিসেবে নয়, দুর্নীতির দেশ হিসেবে নয়; বরং আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বেতনের অর্ধেক যদি চলে যায় বাসা ভাড়ার পেছনে...
বাংলাদেশের শহুরে জীবন যেমন নানা সুযোগ এনে দিয়েছে, তেমনি সমস্যারও অন্ত নেই। ঝকঝকে ভবন, আধুনিক অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবকিছুই মানুষকে শহরমুখী করছে। কিন্তু এই আকর্ষণের আড়ালে সবচেয়ে বড় সংকট হলো ভাড়া বাড়ির ক্রমবর্ধমান চাপ। ঢাকার মতো মহানগরে, যেখানে কাজ, শিক্ষা ও ব্যবসার সুযোগ সবচেয়ে বেশি, সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে এ সমস্যা গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
প্রতিবছর ভাড়া বাড়ছে, কিন্তু আয়ের হার তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। একজন চাকরিজীবীর বেতনের অর্ধেক বা তার বেশিই চলে যায় ভাড়ার পেছনে। এরপর বাজার, বিদ্যুৎ-গ্যাস, চিকিৎসা ও সন্তানের পড়াশোনা সামলাতে গিয়ে পরিবারগুলোকে কঠিন চাপে পড়তে হয়। কেউ খরচ কমিয়ে চালায়, কেউ ঋণ নেয়। এ কারণে মানসিক অশান্তি বাড়ে, পারিবারিক দ্বন্দ্বও তৈরি হয়।
শহরে নতুন আসা শিক্ষার্থী বা চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও দুর্বিষহ। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ভালো এলাকায় থাকতে হলে মোটা অগ্রিম টাকা গুনতে হয়। অনেকে কয়েকজন মিলে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়, খরচ ভাগ করে। কিন্তু ঘন ঘন বাসাবদল, নতুন এলাকায় মানিয়ে নেওয়া কিংবা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক—সবই একেকটা চাপ।
এ কারণে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের ক্রমে শহরের প্রান্তিক বা অস্বাস্থ্যকর এলাকায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব এলাকায় স্কুল-কলেজ দূরে, পরিবেশ খারাপ, নিরাপত্তা অনিশ্চিত। এতে শিশুদের পড়াশোনার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বড়রা মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। জীবনযাত্রার মান পুরোপুরি নেমে যায়।
বাস্তব অভিজ্ঞতা
রাকিব নামের এক তরুণ চাকরিজীবী ঢাকায় একটি কক্ষে থাকেন। বেতনের অর্ধেক চলে যায় ভাড়ায়। বাকি টাকা দিয়ে বাজার, বিদ্যুৎ-গ্যাস, চিকিৎসা সব সামলাতে গিয়ে প্রতিদিন নতুন চাপে পড়েন। মানসিক চাপ এত বেড়ে যায় যে ঘুম কম হয়, কাজে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
শিরিন, একজন কলেজছাত্রী। পড়াশোনার জন্য শহরে এসে এক বন্ধুর সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করেন। ভাড়া ও খরচ সামলাতে গিয়ে প্রায়ই তাঁকে খাবার বা বইয়ের খরচ বাদ দিতে হয়। এতে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে।
তিন সন্তানের জনক মাহমুদ পরিবার নিয়ে শহরের কেন্দ্রে ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন। নিয়মিত ভাড়া বাড়ানোর কারণে স্কুল, চিকিৎসা ও দৈনন্দিন ব্যয় সামলানো দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারে স্থিতি নেই, চাপ কেবল বাড়ছেই।
সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
ভাড়া সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও মানসিক দিক থেকেও ভয়াবহ। পরিবারগুলো ঘন ঘন বাসাবদলের চিন্তায় থাকে। শিশুদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়, বড়রা কাজে মনোযোগ হারান। ভিড় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে ছোট জায়গায় একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকে, যা স্বাধীনতা কমায় এবং পারিবারিক টানাপোড়েন বাড়ায়।
সমাধান কী হতে পারে
সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প: সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে কম খরচের নিরাপদ ফ্ল্যাট বা সরকারি আবাসন বাড়াতে হবে।
আইনগত সুরক্ষা: ভাড়াটিয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়াতে না পারেন।
মানুষকেন্দ্রিক পরিকল্পনা: নতুন ফ্ল্যাট তৈরি যথেষ্ট নয়; বিদ্যমান আবাসনব্যবস্থায়ও নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা জরুরি।
ভাড়াটিয়া সমিতি: ভাড়াটিয়াদের অধিকার রক্ষায় স্থানীয় কমিটি বা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
শেষ কথা
শহুরে জীবনের এই ভাড়া সংকট অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করছে। এখনই প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিগত পদক্ষেপ। নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করা গেলে শহরের মানুষ আবার শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। শিশুরা ভালো শিক্ষা পাবে, পরিবারে স্থিরতা আসবে, মানসিক চাপ কমবে। শহর হবে আরও সুন্দর, মানবিক ও সবার জন্য বাসযোগ্য।
আরশী আক্তার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়